বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী মেয়েকে স্কুল থেকে বের করে দেওয়ার ঘটনায় ক্ষোভে নিজেই স্কুল খুলেছিলেন রিক্তা আক্তার বানু। কুড়িগ্রামের চিলমারী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের জ্যেষ্ঠ নার্স রিক্তা উপজেলায় ২০০৯ সালে নিজ নামে ‘রিক্তা আক্তার বানু (লুৎফা) বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী বিদ্যালয়’ গড়ে তোলেন। স্কুলটিতে এখন ২৯৪ জন প্রতিবন্ধী শিশু পড়ছে। নিজস্ব জমিতে তৈরি আধা পাকা ঘরের স্কুলটি চার বছর আগে এমপিওভুক্ত হয়েছে।
রিক্তা আক্তারের মতো মো. রিয়াজুল ইসলাম নামের সাতক্ষীরার এক বাবাও নিজের অর্থায়ন ও দানশীল ব্যক্তিদের সহায়তায় প্রতিবন্ধীদের জন্য স্কুল গড়ে তোলেন। নিজের দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী মেয়েকে নিয়ে লড়াই তাঁকে শিখিয়েছিল প্রতিবন্ধী শিশুদের শিক্ষার গুরুত্ব। সেই থেকে এলাকার প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য সাতক্ষীরার দেবহাটা উপজেলায় ২০১১ সালে ‘শহীদ মুক্তিযোদ্ধা প্রতিবন্ধী স্কুলের’ প্রতিষ্ঠা। তবে স্কুলটি এখন আর্থিক অনটনের মুখে।
স্কুলটি গড়ে তোলার আগে এলাকায় বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের কোনো স্কুলই ছিল না। পুরো জেলায় এমন একটি স্কুল ছিল মাত্র। প্রতিবন্ধী শিশুরা অবহেলায় বড় হতো।মো. শাহীন শাহ, রিক্তা আক্তার বানু (লুৎফা) বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক
রিয়াজুল ইসলাম জানান, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপন অনুসারে স্কুলের এমপিওভুক্তির জন্য ২০২০ সালে আবেদন করেছেন। তবে এখন পর্যন্ত কোনো অগ্রগতি নেই।
বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষক–কর্মচারীদের বেতনের মূল অংশ ও কিছু ভাতা বাবদ যে অর্থ সরকার দিয়ে থাকে, সেটিকে এমপিও (মান্থলি পেমেন্ট অর্ডার) বলে।
এমপিওভুক্তি ও পাঠদানের স্বীকৃতির জন্য ২০১৯ সালের ২০ ডিসেম্বর সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় এক বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। তবে সাড়ে চার বছর হয়ে গেলেও এই স্বীকৃতির প্রক্রিয়া শেষ হয়নি। স্বীকৃতি পেতে ২ হাজার ৬৯৭টি আবেদন জমা হলেও এখনো তদন্ত পর্যায়ের কাজ শেষ করতে পারেনি মন্ত্রণালয়। ফলে দেবহাটার স্কুলটির মতো অনেক স্কুল আর্থিক সংকটে ধুঁকছে।
জানতে চাইলে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (প্রতিষ্ঠান ও প্রতিবন্ধিতা অনুবিভাগ) বিজয় কৃষ্ণ দেবনাথ প্রথম আলোকে বলেন, ‘তদন্ত চলছে। নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি যে কতটি স্কুল এমপিওভুক্তি ও পাঠদানের স্বীকৃতির অনুমোদন পাবে।’
মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুসারে, দেশে প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য এমপিওভুক্ত স্কুল আছে ৭৬টি। এর বাইরে পাঠদানের স্বীকৃতি রয়েছে ৫৬টি স্কুলের। বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পর জমা পড়া আবেদনের ৯২৫টি ছিল এমপিওভুক্তির ও ১ হাজার ৭৭২টি পাঠদান স্বীকৃতির।
বিজ্ঞপ্তিতে প্রতিবন্ধিতা সম্পর্কিত সমন্বিত বিশেষ নীতিমালা ২০১৯ অনুযায়ী বিশেষ বিদ্যালয়সমূহের পাঠদান স্বীকৃতি বা এমপিওভুক্তির জন্য অনলাইনে আবেদন করার আহ্বান জানানো হয়। ২০২০ সালের ১ থেকে ২০ জানুয়ারির মধ্যে আবেদনের জন্য সংশ্লিষ্ট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ও সিটি করপোরেশন এলাকার ক্ষেত্রে আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা মনোনীত কর্মকর্তার উপস্থিতিতে পাঁচ মিনিটের ভিডিও নির্দিষ্ট লিংকে আপলোড করতে বলা হয়। ভিডিওতে স্কুলে ছাত্রছাত্রীদের অ্যাসেম্বলি (ক্লাস শুরুর আগে শিক্ষার্থীদের শরীরচর্চা ও জাতীয় সংগীত পরিবেশন), শিক্ষকদের ছবি, প্রতিটি শ্রেণিকক্ষের ছবি ও সম্পূর্ণ স্কুলভবনের চিত্র থাকার শর্ত ছিল।
দেশে প্রতিবন্ধী শিশুদের ৬০ শতাংশ আনুষ্ঠানিক শিক্ষার বাইরে রয়েছে। আর প্রতিবন্ধী শিশুদের (৫-১৭ বছর) মধ্যে ৬৫ শতাংশ প্রাথমিক বিদ্যালয় ও ৩৫ শতাংশ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হিসেবে নথিভুক্ত আছে।
‘জাতীয় প্রতিবন্ধী ব্যক্তি জরিপ ২০২১’-এ এই তথ্য উঠে এসেছে। জাতিসংঘ শিশু তহবিল ইউনিসেফের সহায়তায় বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) এই জরিপ করে। প্রতিবন্ধীদের নিয়ে জাতীয় পর্যায়ের এটাই বিবিএসের প্রথম জরিপ।
সাড়ে চার বছরে আবেদনগুলোর তদন্ত পর্যায়ের কাজই শেষ করতে পারেনি সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়। ফলে আর্থিক সংকটে ধুঁকছে অনেক স্কুল।
মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুসারে, দেশে প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য এমপিওভুক্ত স্কুল আছে ৭৬টি। এর বাইরে পাঠদানের স্বীকৃতি রয়েছে ৫৬টি স্কুলের। বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পর জমা পড়া আবেদনের ৯২৫টি ছিল এমপিওভুক্তির ও ১ হাজার ৭৭২টি পাঠদান স্বীকৃতির। আবেদনগুলো তিন শ্রেণিতে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে।
নিজস্ব জমিতে স্কুলভবন ও শিক্ষক নিয়োগ করা হয়েছে উল্লেখ করা আবেদনগুলো ‘ক’ তালিকাভুক্ত করা হয়। যেসব স্কুলের নিজস্ব জমি থাকলেও সে–সংক্রান্ত সব কাগজপত্র দেওয়া হয়নি, সেগুলো ‘খ’ আর যেসব স্কুল চলছে ভাড়া করা ভবনে বা প্রয়োজনীয় তথ্যের ঘাটতি রয়েছে সেসব আবেদন ‘গ’ তালিকাভুক্ত করা হয়। এখন পর্যন্ত এমপিওভুক্তি ও পাঠদানের স্বীকৃতি মিলিয়ে ৪২৪টি স্কুলকে ‘ক’ তালিকাভুক্ত করে তদন্ত করা হচ্ছে। এর মধ্যে ২৯৯টির তদন্ত শেষ হয়েছে। উল্লেখ্য, শুধু পাঠদানের স্বীকৃতির আবেদন করতে ভাড়া করা ভবনে স্কুল হলেও চলে।
নিয়ম অনুসারে, মন্ত্রণালয় কতটি স্কুল এমপিওভুক্ত করতে চায়, তা চূড়ান্ত করার পর অর্থ মন্ত্রণালয়ের সম্মতি লাগে।
সাতক্ষীরার রিয়াজুল ইসলাম বলেন, দীর্ঘদিনের চিকিৎসায় তাঁর মেয়েটি এখন সুস্থ। তবে এলাকার প্রতিবন্ধী শিশুদের কথা চিন্তা করে তিনি স্কুলটি চালু রাখতে চান। অনেকে প্রতিবন্ধী শিশুদের ভিন্ন চোখে দেখেন। অথচ যত্ন ও শিক্ষার মাধ্যমে এই শিশুরা ভালো থাকে। তিনি জানান, আবেদন করার পর এখন পর্যন্ত তদন্তের জন্যও কেউ তাঁর স্কুলে আসেননি। এলাকার আরও দুটি প্রতিবন্ধী স্কুল অর্থসংকটে বন্ধ হয়ে গেছে। তাঁর স্কুলও অর্থসংকটে ভুগছে।
সাতক্ষীরা সদর উপজেলার ‘বাক্ ও শ্রবণপ্রতিবন্ধী স্কুল’–এর পরিচালক শেখ আফজাল হোসেন বলেন, নির্ধারিত মানদণ্ড পূরণ করতে পারেননি বলে তিনি স্কুলের স্বীকৃতির জন্য আবেদন করতে পারেননি। সুন্দরবন ফাউন্ডেশন নামের একটি বেসরকারি সংস্থার অধীন ভাড়া করা কক্ষে প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত বিনা মূল্যে স্কুলটি পরিচালনা করছেন তিনি।
প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য ১৫টি জেলায় পাঠদানের সরকারের স্বীকৃতি পাওয়া ও এমপিওভুক্ত কোনো স্কুল নেই। জেলাগুলো হচ্ছে মুন্সিগঞ্জ, রাজবাড়ী, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান, রাঙামাটি, লক্ষ্মীপুর, কক্সবাজার, মেহেরপুর, নড়াইল, চুয়াডাঙ্গা, মাগুরা, বরগুনা, নওগাঁ, হবিগঞ্জ ও সুনামগঞ্জ।
এর মধ্যে ১২টি জেলা থেকে নিউরো ডেভেলপমেন্ট ডিজঅর্ডার বা এনডিডি (মানসিক প্রতিবন্ধিতা) শ্রেণিতে ৩০টি এবং এনডিডি নয় এমন শ্রেণিতে ৪৭টি স্কুলের জন্য আবেদন জমা পড়েছে। এর মধ্যে ২১টি আবেদন ‘ক’ শ্রেণির তালিকাভুক্ত হয়েছে। আর রাঙামাটি, লক্ষ্মীপুর ও কক্সবাজারে প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের স্কুল না থাকলেও সেখান থেকে কোনো আবেদনপত্র জমা পড়েনি।
প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের স্কুল থাকার প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরে ‘রিক্তা আক্তার বানু (লুৎফা) বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী বিদ্যালয়’ এর প্রধান শিক্ষক মো. শাহীন শাহ প্রথম আলোকে বলেন, ‘স্কুলটি গড়ে তোলার আগে এলাকায় বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের কোনো স্কুলই ছিল না। পুরো জেলায় এমন একটি স্কুল ছিল মাত্র। প্রতিবন্ধী শিশুরা অবহেলায় বড় হতো।’
শাহীন শাহ বলেন, সরকারি অনুদান ছাড়া প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের স্কুল চালানো কঠিন। তাঁদের স্কুলে সরকারি অনুদান আর দানশীল ব্যক্তিদের সহায়তায় শিশু থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত বিনা মূল্যে পড়ানো হয়। শিশুরা নিজের কাজ নিজেরা করতে পারে, টাকার হিসাব বোঝে। কেউ কেউ এখান থেকে পাস করে মাধ্যমিক স্কুলে ভর্তি হয়। এই স্কুলে পড়ে ডিগ্রি পাস করেছেন এমন শিক্ষার্থীও আছেন।