মানুষ একসঙ্গে থাকা বা সংসার করার জন্য বিয়ে করেন। এ কারণে সাধারণত ডিভোর্স বা বিবাহবিচ্ছেদ কারও কাম্য নয়। কিন্তু বিশেষ পরিস্থিতিতে বিচ্ছেদ অনিবার্য হয়ে ওঠে। স্বামী বা স্ত্রী যে কেউ ডিভোর্স দিতে পারেন। তবে স্ত্রী ডিভোর্স দেওয়ার ক্ষেত্রে একটি শর্ত রয়েছে। বিয়ে নিবন্ধনের সময় নিকাহনামার ১৮ নম্বর কলামে যদি স্ত্রীকে ডিভোর্সের অধিকার দেওয়া থাকে, তবে স্ত্রী ডিভোর্স দিতে পারবেন। এ ক্ষেত্রে স্বামীর জন্য যে প্রক্রিয়া বলা হয়েছে, একই বিধান স্ত্রীর জন্যও প্রযোজ্য। তবে ডিভোর্সের অধিকার না দেওয়া থাকলে স্ত্রী পারিবারিক আদালতে আবেদন করে ডিভোর্স দিতে পারবেন।
স্বামী বা স্ত্রী তালাক দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, পৌরসভা বা সিটি করপোরেশনের মেয়রকে লিখিতভাবে নোটিশ পাঠাতে হয়। স্বামী বা স্ত্রীকেও নোটিশের কপি পাঠাতে হবে। চেয়ারম্যান বা মেয়র নোটিশপ্রাপ্তির তারিখ থেকে ৯০ দিন অতিবাহিত না হওয়া পর্যন্ত কোনো বিবাহবিচ্ছেদ কার্যকর হবে না। নোটিশপ্রাপ্তির ৩০ দিনের মধ্যে চেয়ারম্যান বা মেয়র সংশ্লিষ্ট পক্ষদ্বয়ের মধ্যে আপস বা সমঝোতার উদ্দেশ্যে সালিসি পরিষদ গঠন করবেন। এ সালিসি পরিষদ দুই পক্ষের মধ্যে সমঝোতার চেষ্টা করবেন। ৩০ দিন সময় চেয়ারম্যান বা মেয়র কর্তৃক নোটিশপ্রাপ্তির তারিখ থেকে হিসাব করতে হবে।
পারস্পরিক সম্মতিতে বিবাহবিচ্ছেদের মধ্যে বেশি প্রচলিত হচ্ছে ‘খুলা’। এই পদ্ধতিতে স্বামী-স্ত্রী পরস্পরের সম্মতিতে স্ত্রীকে প্রদেয় দেনমোহর ও ভরণপোষণ প্রদান করে একই বৈঠকে বিবাহবিচ্ছেদ করে তা রেজিস্ট্রেশন করা হয়। এ ক্ষেত্রে ৯০ দিনের নোটিশ প্রদানের প্রয়োজন হয় না। তবে এই প্রক্রিয়ায় বিচ্ছেদের পর স্ত্রীর নতুন করে বিয়ে করার ক্ষেত্রে ইদ্দতকালীন তিন মাস সময় পার হওয়ার পর বিয়ে করতে হবে।
মুসলিম পারিবারিক আইন অনুসারে স্বামী তাঁর স্ত্রীকে ডিভোর্স দিতে চাইলে আদালতে যাওয়ার প্রয়োজন হয় না। তবে নিকাহনামার ১৮ নম্বর দফা বা কলামে স্ত্রীকে ডিভোর্স দেওয়ার অধিকার না দিলে বিবাহবিচ্ছেদের জন্য স্ত্রীকে আদালতে আবেদন করতে হয়। ১৯৩৯ সালের মুসলিম বিবাহবিচ্ছেদ আইন অনুসারে স্ত্রী আদালতে বিবাহবিচ্ছেদের আবেদন করতে পারবেন। আদালত বিবাহবিচ্ছেদের ডিক্রি প্রদান করলে ওই ডিক্রি প্রদানের সাত দিনের মধ্যে একটি সত্যায়িত কপি আদালতের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট চেয়ারম্যান বা মেয়রের কাছে পাঠানো হবে। চেয়ারম্যান বা মেয়র যেদিন নোটিশ পাবেন, সেদিন থেকে ঠিক ৯০ দিন পর তালাক চূড়ান্তভাবে কার্যকর হবে।
তালাক ঘোষণার সময় স্ত্রী যদি অন্তঃসত্ত্বা থাকেন, সে ক্ষেত্রে নিয়ম একটু ভিন্নতর। তালাকের নোটিশ পাঠানোর ৯০ দিন পরও যদি স্ত্রী অন্তঃসত্ত্বা থাকেন, তাহলে যেদিন সন্তান ভূমিষ্ঠ হবে, সেদিন তালাক কার্যকর হবে। এর আগে নয়। কিন্তু নোটিশ পাঠানোর ৯০ দিন আগেই যদি সন্তান ভূমিষ্ঠ হয়, তবে স্বাভাবিক নিয়মে, অর্থাৎ ৯০ দিন পর তালাক কার্যকর হবে।
মুসলিম বিবাহ ও তালাক রেজিস্ট্রেশন আইন ১৯৭৪–এর ৬ ধারামতে তালাক রেজিস্ট্রি করতে হয়। তালাক প্রদানকারী তালাক রেজিস্ট্রেশনের জন্য সংশ্লিষ্ট কাজি বরাবর আবেদন করবেন। কাজি নির্ধারিত ফি নিয়ে তালাক রেজিস্ট্রি করবেন এবং ফি ব্যতীত প্রত্যয়িত কপি প্রদান করবেন।
আইনগত সব প্রক্রিয়া মেনে একতরফা অথবা দুই পক্ষের সম্মতিতে ডিভোর্স সম্পন্ন হওয়ার পর যেকোনো দিন পুনরায় বিয়ে করা যায়। তবে নারীদের ক্ষেত্রে খুলা তালাক সম্পন্ন হলেও পুনরায় বিয়ে করার আগে তিন মাস অপেক্ষা করতে হবে।
তালাক কার্যকরের পর যদি তালাক দেওয়া স্ত্রীকে আবার গ্রহণ করতে চান, তবে আগের মতো নিয়ম মেনে পুনরায় বিয়ে করতে হবে। তবে তালাক দেওয়ার পর যে ৯০ দিন সময় হাতে থাকে, ওই দিনের মধ্যে যদি তালাক দেওয়া স্বামী বা স্ত্রীকে গ্রহণ করতে চান, তাহলে তালাক প্রত্যাহার করে নিলেই হবে। এ ক্ষেত্রে কোনো বাধা থাকবে না। আগের মতো সংসার করতে পারবেন। কারণ, তালাক সম্পূর্ণ কার্যকর না হওয়া পর্যন্ত দুই পক্ষ আইনসম্মতভাবে স্বামী-স্ত্রী হিসেবেই থেকে যান। (শফিকুল ইসলাম এবং অন্যান্য বনাম রাষ্ট্র, ৪৬ ডিএলআর, পৃষ্ঠা ৭০০)। তাই এই ৯০ দিন পর্যন্ত স্বামী তাঁর স্ত্রীকে ভরণপোষণও দিতে বাধ্য।
আমাদের দেশে একটি ভুল ধারণার প্রচলন রয়েছে, স্ত্রী যদি তালাক প্রদান করেন, তাহলে দেনমোহর পাবেন না। এ ধারণা ভুল। স্ত্রী তালাক দিলেও তিনি দেনমোহর পাবেন। বিবাহবিচ্ছেদ যেভাবেই হোক, স্ত্রী অবশ্যই দেনমোহর পাবেন। তবে নিকাহনামায় কোনো উশুল লেখা থাকলে বকেয়া টাকা পাবেন। বিয়ে যত দিন চলমান থাকবে, তত দিন স্বামী তাঁর স্ত্রীকে উপযুক্ত পরিমাণে ভরণপোষণ দিতে বাধ্য থাকবেন। এর ব্যত্যয় ঘটলে স্ত্রী যেকোনো সময় আইনের আশ্রয় নিতে পারবেন।
হিন্দু আইনে বিবাহবিচ্ছেদের কোনো বিধান নেই। দাম্পত্য সম্পর্ক তিক্ত পর্যায়ে গেলে একজন হিন্দু স্ত্রী তাঁর স্বামী থেকে পৃথক ভরণপোষণ এবং পৃথক বাসস্থান দাবি করে মামলা করতে পারেন। তবে বর্তমানে আমাদের দেশে হিন্দুধর্মাবলম্বীদের অনেকেই দেওয়ানি আদালতে বিবাহবিচ্ছেদ চেয়ে ঘোষণামূলক মামলা করে থাকেন।
খ্রিষ্টান দম্পতি ডিভোর্স দিতে চাইলে জেলা জজ অথবা হাইকোর্ট বিভাগে আবেদন করতে হয়। দ্য ডিভোর্স অ্যাক্ট, ১৮৬৯-এর ধারা ১৭ ও ২০-এর অধীন বিবাহবিচ্ছেদ ও বাতিল–সম্পর্কিত রায় হাইকোর্ট বিভাগের মাধ্যমে নিশ্চিত করতে হয়, যা অনেক বিচারপ্রার্থীর জন্য ঝামেলাপূর্ণ। আদালতের মাধ্যমে বিবাহবিচ্ছেদের প্রক্রিয়া জটিল বলে খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের মধ্যে অনেকে অ্যাফিডেভিট করে বিবাহবিচ্ছেদ ও আবার বিয়ে করে থাকেন। তবে এটা আইনসিদ্ধ নয়।
বিশেষ বিবাহ আইনে বিয়ে হলে স্বামী বা স্ত্রী চাইলেই বিবাহবিচ্ছেদ ঘটাতে পারবেন না। এ আইন অনুযায়ী কোনো পক্ষ বিবাহবিচ্ছেদ ঘটাতে চাইলে তাঁকে ১৮৬৯ সালের ডিভোর্স অ্যাক্ট অনুযায়ী এ বিচ্ছেদ ঘটাতে হবে। এর জন্য আদালতের শরণাপন্ন হতে হবে এবং আদালতের অনুমতিক্রমে বিবাহবিচ্ছেদ ঘটাতে হবে। বিবাহবিচ্ছেদের নামে একটি হলফনামা পাঠিয়ে দিলেই বিচ্ছেদ হয়ে যাবে, সেটি বলা যাবে না। আদালতের অনুমতি ছাড়া বিবাহবিচ্ছেদ সম্পন্ন করতে চাইলে অপর পক্ষ তা চ্যালেঞ্জ করতে পারবে।
বিয়েসংক্রান্ত অপরাধগুলোর সংজ্ঞা ও দণ্ড সম্পর্কে দণ্ডবিধি, ১৮৬০-এর ৪৯৩ থেকে ৪৯৮ ধারা পর্যন্ত বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। এ আইনের ৪৯৪ ধারা অনুসারে, স্বামী বা স্ত্রী বর্তমান থাকা অবস্থায় পুনরায় বিয়ে করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। ওই ধারা মোতাবেক, স্বামী বা স্ত্রী বর্তমান থাকা অবস্থায় পুনরায় বিয়ে করলে তা সম্পূর্ণ বাতিল বলে গণ্য হবে। এ অপরাধ প্রমাণিত হলে প্রতারণাকারী স্বামী বা স্ত্রী সাত বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড এবং অর্থদণ্ডেও দণ্ডিত হবেন। তবে এর ব্যতিক্রমও রয়েছে। যদি স্বামী বা স্ত্রী সাত বছর পর্যন্ত নিরুদ্দেশ থাকেন এবং জীবিত আছেন মর্মে কোনো তথ্য না পাওয়া যায়—এমন পরিস্থিতিতে পুনরায় বিয়ে করলে তা অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে না। এ ছাড়া কোনো স্বামী বর্তমান স্ত্রীর অনুমতি সাপেক্ষে বিশেষ কোনো পরিস্থিতিতে সালিসি পরিষদের কাছে পুনরায় বিয়ের আবেদন করতে পারেন। সালিসি পরিষদ তা যাচাই–বাছাই করে বিয়ের অনুমতি দিতে পারে। সে ক্ষেত্রে পুনরায় বিয়ে অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে না। আগের বিয়ের কথা গোপন রেখে প্রতারণার মাধ্যমে পুনরায় বিয়ে করলে তা ৪৯৫ ধারা মোতাবেক শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এ ধারায় অপরাধ প্রমাণিত হলে ১০ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড এবং অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন। আবার কেউ জেনেশুনে অন্যের স্ত্রীকে বিয়ে করলে দণ্ডবিধির ৪৯৪ ধারা মোতাবেক সেটি বাতিল হয়ে যাবে। এ ক্ষেত্রে তা দণ্ডবিধির ৪৯৭ ধারা মোতাবেক ব্যভিচার হিসেবে শাস্তিযোগ্য অপরাধ। অপরাধ প্রমাণিত হলে পাঁচ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড এবং অর্থদণ্ড হতে পারে।
বিয়েসংক্রান্ত অপরাধ ঘটলে সরাসরি আদালতে মামলা করতে হবে। এ ক্ষেত্রে মামলার প্রমাণ হিসেবে বিয়ের কাবিননামা ও অন্যান্য প্রমাণ সঙ্গে জমা দিতে হবে এবং আইনজীবী নিয়োগ করতে হবে। মামলা চালানোর সামর্থ্য না থাকলে জেলা লিগ্যাল এইড অফিসার বরাবর আবেদন করতে হবে।
ইশরাত হাসান সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী