সশস্ত্র বাহিনীর নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা কার্যক্রম শুরু হয়েছে। গতকাল বেলা সাড়ে ১১টায়
সশস্ত্র বাহিনীর নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা কার্যক্রম শুরু হয়েছে। গতকাল বেলা সাড়ে ১১টায়

সেনা-বিজিবি মোতায়েন, বহির্বিভাগ চালু

হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনে ও হাসপাতালের ভেতরে সেনাবাহিনী, বিজিবি, আনসারসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সতর্ক অবস্থানে দেখা গেছে। গলায় ঝোলানো কার্ড দেখিয়ে হাসপাতালে ঢুকতে হচ্ছে রোগীর স্বজনদের। চিকিৎসা নিতে আসা রোগী ও স্বজনদের মধ্যে উদ্বেগ ও অস্বস্তি দেখা গেল।

গতকাল সোমবার সকালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিত্র এটি। জরুরি বিভাগের কার্যক্রম শুরু হলেও আউটডোর বা বহির্বিভাগের সেবা গতকাল পর্যন্ত চালু হয়নি। অবশ্য আজ মঙ্গলবার থেকে সীমিত পরিসরে সকাল ১০টা থেকে বেলা ১টা পর্যন্ত বহির্বিভাগের চিকিৎসাসেবা চালু হবে বলে জানিয়েছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।

গত শনিবার হাসপাতালের নিউরোসার্জারি বিভাগে কর্মরত দুজন চিকিৎসকের ওপর হামলার ঘটনাকে কেন্দ্র করে চিকিৎসক ও চিকিৎসা শিক্ষার্থীরা চার দফা দাবিতে রোববার সকাল থেকে কর্মবিরতিতে যান। দেশব্যাপী চিকিৎসকেরাও কর্মবিরতি পালন করেন। দাবি পূরণের আশ্বাস পেয়ে ১২ ঘণ্টা পর রোববার রাত পৌনে আটটার দিকে চিকিৎসকেরা কাজে ফেরেন।

এদিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসকদের ওপর হামলার ঘটনায় জড়িত অভিযোগে একজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

চিকিৎসক ও রোগীদের কল্যাণ নিশ্চিত করতে স্বাস্থ্য সুরক্ষা আইন এবং হাসপাতালে স্বাস্থ্য পুলিশ নিয়োগের খসড়া প্রণয়ন করতে হবে।
আব্দুল আহাদ, আন্দোলনকারী চিকিৎসকদের মুখপাত্র

গতকাল দুপুর ১২টার দিকে জরুরি বিভাগের সামনে অভ্যর্থনাকক্ষের বাইরে স্বজনদের সঙ্গে বসে ছিলেন শাহীনা বেগম। তিনি ফরিদপুর ৫০০ শয্যার হাসপাতাল থেকে তিন বছর বয়সী নাতি রায়হানকে নিয়ে রোববার সন্ধ্যায় এ হাসপাতালে এসেছেন। ঘরে থাকা তরল রাসায়নিক খেয়ে ফেলেছে তাঁর নাতি। ফরিদপুর থেকে চিকিৎসকেরা এখানে পাঠিয়েছেন তাঁদের।

রোববার নাতিকে নিয়ে রাজধানীর কয়েকটি হাসপাতালে ঘুরেছেন; কিন্তু কোথাও ভর্তি করাতে পারেননি। পরে রাত ১০টার দিকে এই হাসপাতালে ভর্তি করতে পেরেছেন। রাতে এক আত্মীয়ের বাসায় ছিলেন। সকালে হাসপাতালে নাতিকে দেখতে এসেছেন। হাসপাতালে এমন অস্থিরতা চলছে, তা জানতেন না শাহীনা।

ভর্তি রোগীর স্বজনদের হাসপাতালে প্রবেশের জন্য গতকাল বিশেষ কার্ড গলায় ঝোলাতে হয়েছে। বিভিন্ন ওয়ার্ডে চিকিৎসক ও নার্সরা এসেছেন ঠিকই। তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে কোনো কোনো চিকিৎসক, নার্স জানিয়েছেন, তাঁরা কাজ করলেও মনে ভয় কাজ করছে। নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন অনেকে।

দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে কথা হয় ক্যাজুয়ালটি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক আরিফ হোসেইনের সঙ্গে। তিনি জানান, সকাল ৮টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত ৩৭ জন রোগী এসেছেন সেবা নেওয়ার জন্য।

হাসপাতালের চলমান অস্থিরতা প্রসঙ্গে আরিফ হোসেইন প্রথম আলোকে বলেন, গত বছরের হিসাব হচ্ছে, এখান থেকে সেবা নিয়েছেন ৫০ হাজার ৭৫৮ রোগী। অন্যান্য দেশের চিকিৎসকেরাও এ সংখ্যা শুনে অবাক হন। কম জনবলসহ বিভিন্ন সীমাবদ্ধতার মধ্যেও রোগীদের চাপ সামলাচ্ছেন চিকিৎসকেরা। সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষে ১৯ জুলাই, ৫ আগস্টসহ বিভিন্ন তারিখে অসংখ্য আহত রোগী সামলিয়েছেন চিকিৎসকেরা। আর এই হাসপাতালের অস্ত্রোপচারকক্ষ থেকে টেনে বের করে চিকিৎসকদের ওপর হামলা চালিয়েছে সন্ত্রাসীরা। এরপর আরও দুটি ঘটনা ঘটে গেছে, যা হাসপাতালে কর্মরতরা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছেন না।

গতকাল হাসপাতালের বহির্বিভাগ বন্ধ ছিল। ফলে এ বিভাগে সেবা নিতে আসা রোগীরা বিপাকে পড়েন। সাধারণত সকাল আটটা থেকে বেলা দুইটা পর্যন্ত বহির্বিভাগে কর্মরতদের দম ফেলার ফুরসত থাকে না। তবে গতকাল সেখানে ছিল সুনসান নীরবতা। কাউন্টারগুলো ছিল ফাঁকা। না জেনে যে রোগীরা সেবা নিতে এসেছেন, তাঁরা বিপাকে পড়েছেন। অবস্থা বেগতিক থাকলে হাসপাতালের কেউ কেউ তাঁদের জরুরি বিভাগে খোঁজ নিতে বলছিলেন।

আন্দোলনকারী চিকিৎসকদের মুখপাত্র ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিউরোসার্জারি বিভাগের আবাসিক সার্জন (রেসিডেন্ট) চিকিৎসক আব্দুল আহাদ জানান, আজ থেকে পরবর্তী ঘোষণা না দেওয়া পর্যন্ত সীমিত পরিসরে সকাল ১০টা থেকে বেলা ১টা পর্যন্ত হাসপাতালের বহির্বিভাগের সেবা চালু হবে এবং অন্যান্য সেবা সীমিত পরিসরে চালু থাকবে। গতকাল বিকেল চারটায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের প্রশাসনিক ব্লকে পরিচালকের কক্ষের সামনে বহির্বিভাগের সেবা চালুসহ অন্যান্য কর্মসূচি পড়ে শোনান আব্দুল আহাদ। বহির্বিভাগের সেবা চালুর পাশাপাশি সারা দেশের সব হাসপাতালে সকাল ৮টা থেকে ১০টা পর্যন্ত আন্দোলনকারী চিকিৎসকদের অবস্থান কর্মসূচিও চলবে বলে জানান এই চিকিৎসক।

চিকিৎসক আব্দুল আহাদ লিখিত বক্তব্যে বলেন, রোববার স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নুরজাহান বেগমের সঙ্গে বৈঠক হয়। স্বাস্থ্য উপদেষ্টার দেওয়া প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী কার্যক্রম শুরু হয়েছে। এর অংশ হিসেবে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসকদের হামলাকারীদের মধ্য থেকে একজনকে এবং শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে হামলাকারীদের মধ্য থেকে চারজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ঢাকা ডেন্টাল কলেজসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নিরাপত্তা বাহিনীও মোতায়েন করা হয়েছে। তাই রোববার থেকেই বিভিন্ন হাসপাতালের জরুরি সেবা চালু করা হয়েছে।

আব্দুল আহাদ বলেন, চিকিৎসক ও রোগীদের কল্যাণ নিশ্চিত করতে স্বাস্থ্য সুরক্ষা আইন এবং হাসপাতালে স্বাস্থ্য পুলিশ নিয়োগের খসড়া প্রণয়ন করতে হবে।

এর আগে গতকাল দুপুরে চিকিৎসকদের দাবি অনুযায়ী ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়েছে বলে জানান হাসপাতালটির পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান।

হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের স্বজনেরা রোগীর অস্ত্রোপচারের সময়সূচি পিছিয়ে যাওয়া নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। সাদিয়া মমতাজ জানান, তাঁর মায়ের পা ভেঙে যাওয়ার পর চট্টগ্রাম থেকে ১৪ দিন আগে মাকে এ হাসপাতালের ২০৬ নম্বর ওয়ার্ডে ভর্তি করা হয়েছে। ওয়ার্ডে চিকিৎসক সেবা দিচ্ছেন। দু–এক দিনের মধ্যে মায়ের পায়ে অস্ত্রোপচার হওয়ার কথা ছিল। এর মধ্যেই হাসপাতালে এ ধরনের অস্থিরতা শুরু হওয়ায় অস্ত্রোপচার কবে হবে, তা নিয়ে চিন্তায় পড়েছেন তাঁরা।