মৃত্যুদণ্ডাদেশ চূড়ান্ত হওয়ার আগে আসামিকে নির্জন কারাবাসে (কনডেমড সেল হিসেবে পরিচিত) রাখা যাবে না বলে রায় দিয়েছেন হাইকোর্ট। আদালত বলেছেন, মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিকে অন্য বন্দীদের মতোই দেখতে হবে। তবে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি বা অন্য বন্দীদের নিরাপত্তার স্বার্থে, সংক্রামক রোগ, স্বাস্থ্যগতসহ ব্যতিক্রম পরিস্থিতির কারণে তাঁকে কনডেমড সেলে রাখতে পারবে কারা কর্তৃপক্ষ। এ ক্ষেত্রে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত বন্দীর বক্তব্য শুনতে হবে।
একটি রিটের চূড়ান্ত শুনানি শেষে বিচারপতি শেখ হাসান আরিফ ও বিচারপতি মো. বজলুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ আজ সোমবার পর্যবেক্ষণ, নির্দেশনাসহ এ রায় দেন। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত বন্দীদের সাধারণ সেলে স্থানান্তরের জন্য অবকাঠামো ব্যবস্থাসহ উদ্যোগ শুরু করতে কারা কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আদালত বলেছেন, তবে তা দুই বছরের বেশি সময়ে নয়।
বিচারিক ও প্রশাসনিক ফোরামের মাধ্যমে মৃত্যুদণ্ডাদেশ চূড়ান্ত হওয়ার আগে দণ্ডিত আসামিকে কনডেমড সেলে রাখার বৈধতা নিয়ে ২০২১ সালে ওই রিট করেছিলেন বিচারিক আদালতে মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত হয়ে কনডেমড সেলে থাকা তিন আসামি। রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে ২০২২ সালের ৫ এপ্রিল হাইকোর্ট রুল দেন। বিচারিক ও প্রশাসনিক ফোরামে মৃত্যুদণ্ডাদেশ চূড়ান্ত হওয়ার আগে দণ্ডিতকে কনডেমড সেলে রাখা কেন আইনগত কর্তৃত্ববহির্ভূত ঘোষণা করা হবে না, তা রুলে জানতে চাওয়া হয়। চূড়ান্ত শুনানি শেষে রুল নিষ্পত্তি করে পর্যবেক্ষণ–নির্দেশনাসহ রায় দেন আদালত। সংশ্লিষ্ট আইনজীবীরা বলছেন, এ রায়ে ফৌজদারি বিচারব্যবস্থায় নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে।
রায়ের পর অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, রায়ের বিষয়টি সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জানানো হবে। নির্দেশনা অনুসারে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
এদিকে কারা কর্তৃপক্ষের ২০২২ সালের নভেম্বরের এক প্রতিবেদনের তথ্য অনুসারে, দেশের কারাগারগুলোতে মৃত্যুদণ্ডাদেশ পাওয়া ব্যক্তিদের জন্য ২ হাজার ৬৫৭টি সেল আছে। আর কনডেমড সেলে ২ হাজার ১৬২ জন বন্দী আছেন।
ফৌজদারি কোনো মামলায় বিচারিক আদালতের রায়ে আসামির মৃত্যুদণ্ড হলে ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৭৪ ধারা অনুসারে তা কার্যকরে হাইকোর্টের অনুমোদন নিতে হয়। এটি ডেথ রেফারেন্স (মৃত্যুদণ্ড অনুমোদন) হিসেবে পরিচিত। ফৌজদারি কার্যবিধির ৪১০ ধারা অনুসারে বিচারিক আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত আসামি হাইকোর্টে আপিল করতে পারেন। হাইকোর্টে মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকলে এর বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে আপিল করার সুযোগ আছে দণ্ডিতের। সংবিধানের ১০৫ অনুচ্ছেদ অনুসারে আপিল বিভাগের রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ (পুনর্বিবেচনা) আবেদন করার সুযোগ আছে। এ ছাড়া সংবিধানের ৪৯ অনুচ্ছেদ অনুসারে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করতে পারেন। ক্ষমার আবেদন রাষ্ট্রপতি যদি নামঞ্জুর করেন, তাহলে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরে আইনগত বৈধতা পায় বলে রিটে উল্লেখ করা হয়। রিট আবেদনকারী তিন আসামির ক্ষেত্রে পৃথক মামলায় বিচারিক আদালতের রায়ে মৃত্যুদণ্ড হয়েছে। এর বিরুদ্ধে তাঁদের করা আপিল ও ডেথ রেফারেন্স হাইকোর্টে নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে।
রায়ে হাইকোর্ট বলেছেন, দেখা যায় উচ্চ আদালতে ডেথ রেফারেন্স নিষ্পত্তির জন্য ছয় বছর অপেক্ষা করতে হয়। এর বিরুদ্ধে আপিল করা হলে সে ক্ষেত্রে শেষ হতে আরও আট বছর লেগে যায়। এরপর রিভিউ করা হলে তা নিষ্পত্তিতে দুই বছর লেগে যায়। এ হিসাবে চূড়ান্ত নিষ্পত্তির জন্য ১৫-২০ বছর অপেক্ষা করতে হয়। দণ্ডিবিধির ৭৩ ও ৭৪ ধারা অনুসারে আসামিকে নির্জন কারাবাসে (কনডেমড সেল হিসেবে পরিচিত) রাখা যায়। বিধান অনুসারে এই মেয়াদ ৩০ দিনের বেশি হবে না। এই ৩০ দিন মেয়াদে টানা ১৪ দিন এবং মাসে ৭ দিনের বেশি নির্জন কারাবাসে রাখা যাবে না। মৃত্যুদণ্ড চূড়ান্ত হওয়ার আগে দীর্ঘদিন নির্জন কারাবাসে রাখা দুবার সাজা প্রদানের শামিল।
মামলার বিচারপ্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রতার প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে আদালত বলেন, বিচারিক আদালতে হত্যা মামলার বিচার শেষ হতে ৫-৬ বছর লেগে যায়। সমাজের সচেতন নাগরিক ও সাংবাদিক সাগর-রুনি হত্যা মামলার তদন্ত ১২ বছরেও শেষ হয়নি। এটা দীর্ঘসূত্রতার জ্বলন্ত একটি উদাহরণ।
মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামির জামিনের নজির দেখা যায় না উল্লেখ করে হাইকোর্ট রায়ে বলেছেন, মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত বন্দী জামিন আবেদন করতে পারেন। সে ক্ষেত্রে ফৌজদারি কার্যবিধির ৪২৬ ধারা অনুসারে হাইকোর্ট বিভাগের জামিন আবেদন গ্রহণ করা উচিত।
তথ্য অধিকার আইন অনুসারে কারা কর্তৃপক্ষ মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত বন্দীর সংখ্যা এবং সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রি অফিস ডেথ রেফারেন্স মামলা, আসামির সাজা কমা ও খালাস বিষয়ে তথ্যাদি জানাতে বাধ্য বলে রায়ে এসেছে। ওই আইনে কেউ তথ্য চাইলে তা সরবরাহ করতে এবং সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে ও বার্ষিক প্রতিবেদনে প্রকাশ করতে বলা হয়েছে।
আদালতে রিট আবেদনকারীদের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির। রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন ও ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল অমিত তালুকদার, সঙ্গে ছিলেন সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল এম এম জি সারোয়ার। কারা কর্তৃপক্ষের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী খোন্দকার শাহরিয়ার শাকির। এ মামলায় অ্যামিকাস কিউরি (আদালতের আইনি সহায়তাকারী) হিসেবে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী প্রবীর নিয়োগী ও এস এম শাহজাহান মতামত তুলে ধরেন।
রায়ের পর রিট আবেদনকারীদের আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির প্রথম আলোকে বলেন, বিচারিক আদালতে মৃত্যুদণ্ড হলে আসামির মৃত্যুদণ্ড চূড়ান্ত বলা যাবে না। এ ক্ষেত্রে হাইকোর্ট বিভাগ, আপিল বিভাগ (আপিল ও রিভিউ) ও রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা প্রার্থনা—এই চারটি ধাপ শেষ হওয়ার মধ্য দিয়েই মৃত্যুদণ্ড চূড়ান্ত হবে। এসব ধাপ শেষ হওয়ার আগে মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকা আসামিকে কনডেমড সেলে রাখা যাবে না বলে রায় দিয়েছেন হাইকোর্ট। এ রায়ে ফৌজদারি বিচারব্যবস্থায় নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হলো।