ডেঙ্গুর প্রকোপ

ছোট মেয়ে আইসিইউতে, হাসপাতালে বড় মেয়ে ও স্ত্রী, দিশাহারা নাহিদ

হাসপাতালে প্রতিদিন আসছে নতুন ডেঙ্গু রোগী। রোগীর চাপ সামলাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন ওয়ার্ডের বারান্দায়ও রাখা হচ্ছে ডেঙ্গু রোগীদের। শনিবার বিকেল ৫টায়
ছবি: সৌরভ দাশ

নুসরাত আলম কেজি ওয়ানের ছাত্রী। বয়স সাতের কাছাকাছি। উচ্ছল, প্রাণবন্ত মেয়েটি সারা দিন বাসায় ছোটাছুটি করত। কিন্তু ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে এখন তার দিন কাটছে হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রের (আইসিইউ) শয্যায়।

নুসরাত যখন আইসিইউতে, তখন তার তৃতীয় শ্রেণি পড়ুয়া বোন নাজিহা আলম (১০) ও মা বদরুন নাহার (৩৯) শুয়ে আছেন হাসপাতালের শয্যায়। তাঁরাও ডেঙ্গু আক্রান্ত। এমন পরিস্থিতিতে দিশাহারা নুসরাত-নাজিহার বাবা প্রকৌশলী মো. নাহিদ আলম। কখনো তিনি চিকিৎসকের কাছে, কখনো ওষুধের দোকানে, আবার কখনো ছুটছেন খাবারের দোকানে।

গত শুক্রবার রাতে চট্টগ্রাম নগরের পার্কভিউ হাসপাতালের নবম তলায় কথা হয় মো. নাহিদ আলমের সঙ্গে। তিনি চট্টগ্রামের কর্ণফুলী গ্যাস বিতরণ কোম্পানির উপমহাব্যবস্থাপক। যখন তাঁর সঙ্গে কথা হচ্ছিল, তখন তাঁর চোখে-মুখে উৎকণ্ঠার ছাপ। কখন চিকিৎসক কিংবা নার্সের ডাক পড়ে, তাঁর নজর সেদিকে।

ডেঙ্গুর সঙ্গে যুদ্ধ শুরু হয় কবে—এই প্রশ্নে নাহিদ আলম জানান, ৩০ জুন জ্বর আসে দুই মেয়ের। জ্বর উঠে গিয়েছিল ১০৪ ডিগ্রিতে। কী ছটফটানিটাই না করেছে তারা! পরে পরীক্ষায় ডেঙ্গু ধরা পড়ে।

নাহিদ আলম বলেন, চিকিৎসকের পরামর্শে বাসায় চিকিৎসা চলছিল দুই মেয়ের। শারীরিক অবস্থার অবনতি হওয়ায় নুসরাত ও নাজিহাকে ৪ জুলাই ভর্তি করা হয় পার্কভিউ হাসপাতালে। এর মধ্যে স্ত্রীরও ডেঙ্গুর উপসর্গ দেখা দেয়। পরে তিনিও চিকিৎসকের পরামর্শে ওষুধ খাওয়া শুরু করেন। গত বৃহস্পতিবার আইসিইউতে নেওয়া হয় নুসরাতকে। সে এখনো দুর্বল। রক্তের প্লাটিলেট কখনো কমছে, কখনো বাড়ছে।

পার্কভিউ হাসপাতালের নির্বাহী কর্মকর্তা সরফুদ্দিন আহমেদ চিকিৎসকের বরাত দিয়ে জানান, নুসরাতের অবস্থা ধীরে ধীরে ভালোর দিকে যাচ্ছে। নাজিহার অবস্থাও ভালো। তারা চিকিৎসকের পর্যবেক্ষণে আছে।

নাহিদ আলমের বাড়ি বগুড়ায়। চট্টগ্রামের রহমান নগর এলাকার ২ নম্বর সড়কের একটি ভাড়া বাসায় থাকেন তিনি। গতকাল শনিবার বেলা ১১টার দিকে রহমান নগর এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, এলাকার বিভিন্ন অলিগলিতে ময়লা-আবর্জনা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। নালায়ও জমে আছে ময়লা।

এলাকার বাসিন্দা মোহাম্মদ সাইদুল ইসলাম ও রাকিব উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ডেঙ্গুর ভয়ে তাঁরা দিনের বেলায়ও মশারি টাঙাচ্ছেন। বিকেল হতে হতেই মশা তাড়াতে কয়েল জ্বালাচ্ছেন। তাঁদের অভিযোগ, এলাকার নালা-নর্দমা ঠিকভাবে পরিষ্কার করা হয় না।

রহমান নগর এলাকাটি চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ৮ নম্বর ওয়ার্ডে পড়েছে। পরিচ্ছন্নতার বিষয়ে ওই ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মো. মোরশেদ আলম প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর ওয়ার্ডের আয়তন বেশ বড়। জনবলের সংকটও আছে। তবু তাঁরা নিয়মিত পরিচ্ছন্নতার কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন।

আক্রান্ত ৩০ শতাংশই শিশু

সিভিল সার্জন কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, চট্টগ্রামের হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ডেঙ্গু রোগীদের বড় একটি অংশ শিশু, কিশোর ও তরুণ। আক্রান্ত রোগীদের ৩০ শতাংশই শিশু। এ ছাড়া মোট আক্রান্তের অর্ধেকই ১ থেকে ৩০ বছর বয়সী। কার্যালয়ের হিসাব অনুযায়ী, চট্টগ্রামে গতকাল নতুন করে ২৭ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন। ২৪ ঘণ্টায় মারা গেছেন একজন। এ নিয়ে চট্টগ্রাম জেলায় মোট আক্রান্তের সংখ্যা ৭৪৮। তাঁদের মধ্যে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ১৭১ জন। মোট মৃত্যু হয়েছে ১৩ জনের।

চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন মোহাম্মদ ইলিয়াছ চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, শিশু-কিশোরেরা মশা নিয়ে অতটা সচেতন নয়। তাই অভিভাবকদের সচেতন হতে হবে। ঘরের আশপাশ পরিষ্কার রাখতে হবে। মশারি ব্যবহার করতে হবে। এ ছাড়া মশার প্রজননক্ষেত্র যেন অজান্তে ঘরের আশপাশে গড়ে না ওঠে, সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে।