বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক অচলাবস্থার সমাধান এবং বাস্তবসম্মত, দীর্ঘস্থায়ী ও বিশ্বাসযোগ্য পরিবর্তনের লক্ষ্যে রাজনৈতিক দলগুলোকে খোলামনে আলোচনার আহ্বান জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক্-নির্বাচন পর্যবেক্ষক দল।
পর্যবেক্ষক দলটি মনে করে, বাংলাদেশ এখন এক সন্ধিক্ষণে রয়েছে। এ দেশের আসন্ন জাতীয় নির্বাচন গণতান্ত্রিক, অংশগ্রহণমূলক ও প্রতিযোগিতামূলক রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার প্রতি দেশটির অঙ্গীকারের ক্ষেত্রে একটি ‘লিটমাস টেস্ট’। রাজনীতিতে ‘লিটমাস টেস্ট’ বলতে বোঝায় এমন একটি প্রশ্নকে, যার উত্তরের ওপর উত্তীর্ণ অথবা অনুত্তীর্ণ হওয়ার বিষয়টি নির্ভর করে।
বাংলাদেশে মিশন শেষে শনিবার ওয়াশিংটন থেকে প্রচারিত যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক্-নির্বাচন পর্যবেক্ষক দলের এক বিজ্ঞপ্তিতে এসব কথা বলা হয়েছে। বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ নির্বাচন পর্যবেক্ষণে পূর্ণাঙ্গ পর্যবেক্ষক মিশন পাঠানোর বিষয়টি মূল্যায়ন করতে ৭ অক্টোবর ঢাকায় এসেছিল মার্কিন প্রতিনিধিদলটি।
প্রাক্-নির্বাচন পর্যবেক্ষক দলের বিজ্ঞপ্তিতে বাংলাদেশে একটি বিশ্বাসযোগ্য, অংশগ্রহণমূলক ও সহিংসতামুক্ত জাতীয় নির্বাচন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সংলাপসহ সরকার, রাজনৈতিক দল, নির্বাচন কমিশন ও অন্য অংশীজনদের প্রতি পাঁচটি সুপারিশ করা হয়। তবে তারা বাংলাদেশের নির্বাচনে পর্যবেক্ষক পাঠাবে কি না, সে বিষয়ে স্পষ্ট করে কিছু বলেনি।
বাংলাদেশে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরিবেশসহ নির্বাচনপূর্ব রাজনৈতিক পরিস্থিতি পর্যালোচনায় গত জুলাইয়ে ঢাকা সফর করেছিল ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রাক্-নির্বাচন পর্যবেক্ষক দল। তাদের সুপারিশের ভিত্তিতে নির্বাচনে পূর্ণাঙ্গ পর্যবেক্ষক দল না পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)।
বাংলাদেশে আসা যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক্-নির্বাচনী পর্যবেক্ষক দলটি সে দেশের দুই গবেষণাপ্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইনস্টিটিউট (আইআরআই) ও ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ইনস্টিটিউটের (এনডিআই) প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গঠিত। বাংলাদেশ সফরে তারা মন্ত্রিসভার কয়েকজন জ্যেষ্ঠ সদস্য, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, নির্বাচন কমিশন, আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি, বিদেশি কূটনীতিকসহ অংশীজনদের সঙ্গে অন্তত ২০টি বৈঠক করে।
ওয়াশিংটন থেকে শনিবার প্রচারিত প্রাক্-নির্বাচন পর্যবেক্ষক দলটির বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বাংলাদেশের শক্তিশালী অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের ঐতিহ্য ২০৪১ সালে উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত হওয়ার রূপকল্প অর্জনের ক্ষেত্রে একটি শক্তিশালী ভিত্তি স্থাপন করেছে। তারপরও বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক অভিযাত্রা বেশ কিছু চ্যালেঞ্জের মুখে রয়েছে।
চ্যালেঞ্জের মধ্যে রয়েছে আপসহীন রাজনৈতিক মানসিকতা, আক্রমণাত্মক বক্তৃতা, রাজনৈতিক সহিংসতা, অনিশ্চয়তা, ভয়ের একটি বিস্তৃত পরিবেশ, নাগরিক সমাজ ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ক্ষেত্র সংকুচিত হওয়া, নাগরিক, রাজনৈতিক নেতা ও অন্য অংশীজনদের মধ্যে আস্থার ঘাটতি। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে নারী, যুবক ও অন্যান্য প্রান্তিক গোষ্ঠীও উল্লেখযোগ্য বাধার সম্মুখীন হয়। দলটি বলেছে, চ্যালেঞ্জগুলো গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে, যা টেকসই উন্নয়নের দিকে বাংলাদেশের ইতিবাচক অগ্রযাত্রাকে বিঘ্নিত করতে পারে।
পর্যবেক্ষক দলের সুপারিশগুলো হলো বক্তব্যের ক্ষেত্রে সহনশীলতা ও নির্বাচনী মুখ্য বিষয়ে খোলামেলা ও অর্থবহ সংলাপে বসা; মতপ্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষা ও নাগরিকদের জন্য খোলামেলা পরিবেশ নিশ্চিত করা, যেখানে ভিন্নমতকে সম্মান করা হয়; সহিংসতার বিরুদ্ধে অঙ্গীকার ও রাজনৈতিক সহিংসতায় জড়িত ব্যক্তিদের জবাবদিহি নিশ্চিত করা; স্বাধীনভাবে নির্বাচন পরিচালনাকে শক্তিশালী করাসহ সব দলের অর্থবহ রাজনৈতিক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের ক্ষেত্র তৈরি করা এবং নাগরিকদের মধ্যে অন্তর্ভুক্তিমূলক ও সক্রিয় নির্বাচনী অংশগ্রহণের সংস্কৃতি উৎসাহিত করা।
দলটি মনে করে, সুপারিশগুলো একটি পথনকশা তৈরি করবে। এই পথনকশা নির্বাচনের আগের বাকি সময়টুকু এবং নির্বাচনের পরে নেওয়া হলে বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে এগিয়ে নিতে পারে এমন বিশ্বাসযোগ্য, অন্তর্ভুক্তিমূলক, অংশগ্রহণমূলক এবং সহিংসতামুক্ত নির্বাচনের লক্ষ্য অর্জনে সহায়তা করতে পারে।
২০১৮ সালেও যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে আইআরআই ও এনডিআইয়ের সমন্বয়ে গঠিত প্রতিনিধিদল বাংলাদেশ সফর করেছিল। তখনকার সফর শেষে প্রচারিত বিজ্ঞপ্তিতে এবারের মতো সুপারিশ করেছিল। পরে নির্বাচনের আগেভাগে একটি পর্যবেক্ষক পাঠানোর কথা জানিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র থেকে কোনো নির্বাচন পর্যবেক্ষক দল ২০১৮ সালে বাংলাদেশে আসেনি।
সাবেক পররাষ্ট্রসচিব মো. তৌহিদ হোসেন গতকাল সন্ধ্যায় প্রথম আলোকে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক্-নির্বাচন পর্যবেক্ষক দলের পক্ষ থেকে রাজনৈতিক দলগুলোকে যে খোলামনে আলোচনা করার কথা বলা হয়েছে, সে পরিবেশ কি আছে? না থাকার কারণ সরকার ও বিরোধী দল একে অন্যের বিরুদ্ধে বিষোদ্গারে ব্যস্ত।
তৌহিদ হোসেন বলেন, ‘সংলাপে বসার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোর মাঝে আস্থার সংকট রয়েছে। এমন একটা পরিস্থিতিতে আমি সংলাপের সুযোগ দেখি না।’
সামগ্রিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিদল যেসব সুপারিশ করেছে, সে অনুযায়ী পরিস্থিতি উন্নয়নের প্রধান দায়িত্ব সরকারের বলে মনে করেন তৌহিদ হোসেন। তিনি বলেন, ‘পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে আমরা হয়তো একতরফা একটি নির্বাচনের দিকেই এগোচ্ছি। কারণ, রাজনৈতিক দলগুলোর মাঝে মানসিকতার কোনো পরিবর্তন দেখছি না। আর নির্বাচন সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ হবে এমন কোনো লক্ষণও দেখছি না।’