চট্টগ্রাম নগরের একমাত্র সরকারি দিবাযত্ন কেন্দ্রটি যেমন

চট্টগ্রামে একমাত্র দিবাযত্ন কেন্দ্রটি পরিচালিত হচ্ছে ভাড়া বাসায়। পর্যাপ্ত স্থান না থাকায় একটি কক্ষেই খেলাধুলা করতে হয় শিশুদের
ছবি: জুয়েল শীল, চট্টগ্রাম

ভবনের নিচতলায় বদ্ধ একটি কক্ষে খেলাধুলা করছে ১২ থেকে ১৫ জন শিশু। কেউ কানামাছি খেলছে, কেউ ব্যস্ত পুতুল নিয়ে। চট্টগ্রাম নগরের মোমেনবাগ এলাকায় অবস্থিত সরকারি শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্রের চিত্র এটি। পর্যাপ্ত স্থান না থাকায় দিবাযত্ন কেন্দ্রটির একটি কক্ষেই খেলাধুলা করতে হয় শিশুদের। রয়েছে জনবলসংকটও।

মুরাদপুর মূল সড়ক থেকে হামজারবাগ হয়ে মোমেনবাগ এলাকায় ঢুকতেই বাঁ দিকে একটি গলি। সেই গলির শেষ মাথায় একটি ভবনের নিচতলায় দিবাযত্ন কেন্দ্রটি পরিচালনা করে মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তর। এটি চট্টগ্রাম নগরের একমাত্র সরকারি দিবাযত্ন কেন্দ্র। মূলত নিম্নবিত্ত কর্মজীবী মা–বাবারা তাঁদের শিশুসন্তানদের দিনের বেলায় এ দিবাযত্ন কেন্দ্রে রেখে যান।

মোমেনবাগ এলাকার বাসিন্দা সুফিয়া বেগম বলেন, তাঁর স্বামী গাড়িচালক। তিনি গৃহকর্মীর কাজ করেন। কাজে যাওয়ার সময় তিনি তাঁর তিন বছরের সন্তান সিফাত ইসলামকে দিবাযত্ন কেন্দ্রে রেখে যান। বিকেলে কাজ থেকে ফিরে সন্তানকে বাসায় নিয়ে আসেন।

নেই পর্যাপ্ত কক্ষ ও জনবল

দিবাযত্ন কেন্দ্রটিতে শিশু ভর্তি ও মাসিক ফি ১০০ টাকা করে। কর্মদিবসে সকাল সাড়ে আটটা থেকে বিকেল চারটা পর্যন্ত শিশুরা এই কেন্দ্রে থাকতে পারে। ছয় মাস থেকে ছয় বছর বয়সী শিশুদের সেখানে রাখা যায়। সেখানে তাদের প্রাক্‌-প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষাও দেওয়া হয়। কেন্দ্রটিতে ৬০ জন শিশুকে ভর্তির সুযোগ রাখা হলেও বর্তমানে রয়েছে ৪২ জন। বিভিন্ন বয়সের শিশুদের একই ধরনের খাবার দেওয়া হয়।

নগরের নাসিরাবাদ আবাসিক এলাকায় মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তর চট্টগ্রামের প্রধান কার্যালয় অবস্থিত। সেখানে ১০ তলা একটি ভবন নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে। তখন ডে কেয়ার সেন্টারটিও সেখানেই স্থানান্তর করা হবে। নগরের অন্যান্য এলাকায়ও ডে কেয়ার সেন্টার স্থাপনের পরিকল্পনা রয়েছে
—মাধবী বড়ুয়া, উপপরিচালক, মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তর, চট্টগ্রাম

সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, দিবাযত্ন কেন্দ্রটিতে একটি রান্নাঘর, একটি অফিস কক্ষ, একটি স্টোররুম, একটি খেলাধুলা ও পড়ার কক্ষ এবং একটি বিশ্রাম কক্ষ রয়েছে। দিবাযত্ন কেন্দ্রে ঢুকতেই খেলাধুলা ও পড়ার কক্ষ। সেখানেই সারা দিন থাকে শিশুরা। একটি টেবিলেই পড়ালেখা, খাওয়াদাওয়া সব হচ্ছে। কক্ষটি পার হলেই শিক্ষকদের বসার কক্ষ। তাঁর পাশে রান্না ঘর। রান্নাঘরের পাশেই স্টোররুম। এর বিপরীত পাশের কক্ষটি বিশ্রামের জন্য নির্ধারিত।

বিশ্রামের কক্ষটিতে চারটি তোশককে একসঙ্গে করে একটি চাদর দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে। জানা গেছে, শিশুরা দুপুরে ঘুমায় না, তাই এভাবে রাখা হয়েছে। কোনো খাটের ব্যবস্থা রাখা হয়নি। এ ছাড়া স্থান না থাকায় দোলনাসহ আরও অনেক ধরনের খেলনা স্টোররুমেই পড়ে আছে।

বিশ্রামের কক্ষটিতে চারটি তোশককে একসঙ্গে করে একটি চাদর দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে। জানা গেছে, শিশুরা দুপুরে ঘুমায় না, তাই এভাবে রাখা হয়েছে। কোনো খাটের ব্যবস্থা রাখা হয়নি। এ ছাড়া স্থান না থাকায় দোলনাসহ আরও অনেক ধরনের খেলনা স্টোররুমেই পড়ে আছে।

দিবাযত্ন কেন্দ্রের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বলছেন, ভাড়া বাসা হওয়ায় কার্যক্রম পরিচালনা করতে তাঁদের সমস্যায় পড়তে হয়। বিশেষ করে কক্ষসংকটের কারণে শিশুরা খেলাধুলার জন্য পর্যাপ্ত জায়গা পাচ্ছে না।

জনবলসংকটও রয়েছে কেন্দ্রটিতে। সেখানে দুজন নিরাপত্তাকর্মী ও দুজন আয়ার পদ পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে শূন্য রয়েছে। শিক্ষিকা বকুল রানী দাশ ও রাশেদা সুলতানাই পড়ালেখার পাশাপাশি প্রশাসনিক কাজ, শিশুদের যত্ন ও খাওয়ার বিষয় দেখাশোনা করছেন। একজন রাঁধুনি রয়েছেন, তিনি শিশুদের যত্নে দুই শিক্ষককে সহায়তা করেন। নিরাপত্তার জন্য বেসরকারি ভিত্তিতে একজন নিরাপত্তাকর্মী নিয়োগ দেওয়া হয়েছে বছরখানেক আগে।

মোমেনবাগ এলাকায় একটি ভবনের নিচতলায় দিবাযত্ন কেন্দ্রটি পরিচালনা করে মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তর

দিবাযত্ন কেন্দ্রটির শিক্ষিকা রাশেদা সুলতানা বলেন, জনবলসংকটের কারণে কিছুটা কষ্ট হচ্ছে। তবে শিশুদের যাতে কোনো সমস্যা না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখা হচ্ছে।
দিবাযত্ন কেন্দ্রের বদ্ধ পরিবেশ শিশুদের বেড়ে ওঠার জন্য উপযুক্ত নয় বলে মনে করেন শিশুবিশেষজ্ঞ সুশান্ত বড়ুয়া। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বদ্ধ ঘরে শিশুর বেড়ে ওঠা তাদের মানসিক বিকাশে বাধা দেবে, প্রকৃতির সঙ্গে তাদের পরিচিত হওয়ার সুযোগও থাকবে না। শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্রের জন্য খোলামেলা, নিরিবিলি ও প্রাকৃতিক পরিবেশই আদর্শ।

নগরে আর কোনো সরকারি দিবাযত্ন কেন্দ্র নেই

চট্টগ্রাম নগরে সরকারি দিবাযত্ন কেন্দ্রের সংখ্যা এ একটিই। বেসরকারি পর্যায়ে কিছু দিবাযত্ন কেন্দ্র থাকলেও সেখানে শিশুদের জন্য প্রতি মাসে খরচ করতে হয় ১২ থেকে ১৫ হাজার টাকা।

২০২১ সালের জুলাই মাসে তৈরি পোশাকসহ বিভিন্ন কারখানার নারী শ্রমিকদের সন্তানদের জন্য নগরে তিনটি ডে-কেয়ার সেন্টার চালু করেছিল জাতীয় মহিলা সংস্থা। এসব কেন্দ্রের প্রতিটিতে ৩০ জন শিশুকে স্বাস্থ্যসেবা, অক্ষরজ্ঞান, অভ্যন্তরীণ খেলাধুলার ব্যবস্থা রাখা হয়। গত বছরের জুন মাসে কর্মসূচির মেয়াদ শেষ হলে বন্ধ হয়ে যায় এসব কেন্দ্র।

নগরের ইপিজেড এলাকার পোশাকশ্রমিক আলেয়া বেগম বলেন, তিনি সকালে কাজে যান। সন্ধ্যায় ফিরে এলে তারপর তাঁর স্বামী সিএনজিচালিত অটোরিকশা নিয়ে বের হন। ঘরে চার বছরের শিশু রয়েছে তাঁদের। তাই পালা করে কাজে যেতে হচ্ছে দুজনকে। ইপিজেড এলাকায় সরকারি দিবাযত্ন কেন্দ্র থাকলে তাঁদের সুবিধা হতো।

মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তর চট্টগ্রামের উপপরিচালক মাধবী বড়ুয়া প্রথম আলোকে বলেন, নগরের নাসিরাবাদ আবাসিক এলাকায় মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তর চট্টগ্রামের প্রধান কার্যালয় অবস্থিত। সেখানে ১০ তলা একটি ভবন নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে। তখন ডে কেয়ার সেন্টারটিও সেখানেই স্থানান্তর করা হবে। নগরের অন্যান্য এলাকায়ও ডে কেয়ার সেন্টার স্থাপনের পরিকল্পনা রয়েছে।