এস এম আশিকুর রহমান
এস এম আশিকুর রহমান

মৎস্য অধিদপ্তর

নিজের গাড়ি ঠিকাদারের মাধ্যমে ভাড়া নেন প্রকল্প পরিচালক, পেলেন শুধু ‘তিরস্কার’

মৎস্য অধিদপ্তরের দেশীয় প্রজাতির মাছ এবং শামুক সংরক্ষণ ও উন্নয়ন প্রকল্প, গোপালগঞ্জের প্রকল্প পরিচালক এস এম আশিকুর রহমান। তাঁর একটি ব্যক্তিগত জিপ রয়েছে। গাড়িটি তিনি মাসিক ৫০ হাজার টাকা চুক্তিতে তাঁরই প্রকল্পে গাড়ি সরবরাহকারী ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কাছে ভাড়া দেন। পরে প্রকল্প পরিচালক হিসেবে ব্যবহারের জন্য নিজের সেই জিপ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ভাড়ায় নেন তিনি।

আশিকুরের এই ‘জালিয়াতি’ সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত বিধিমালার লঙ্ঘন বলে প্রমাণিত হয়েছে। এরপরও তাঁকে শুধু ‘তিরস্কার’ করা হয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধে এ লঘুদণ্ডের বিষয়টি প্রজ্ঞাপন দিয়ে জানিয়েছে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়। প্রজ্ঞাপনটি গত ২৮ জানুয়ারি জারি করা হয়েছে।

আশিকুরকে ‘অসদাচরণ’-এর দায়ে সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা, ২০১৮-এর ৩(খ) বিধির ৪(২)(ক) অনুযায়ী তিরস্কার করা হয়েছে। বিধিমালায় যাকে লঘুদণ্ড হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।

আশিকুর এখনো প্রকল্প পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। প্রকল্পটির প্রধান কার্যালয় গোপালগঞ্জ জেলায়। প্রকল্প দপ্তর জানায়, প্রকল্পটি শুরু হয় ২০২০ সালের জুলাইয়ে। এরপর করোনাভাইরাসসহ অর্থনৈতিক সংকট দেখা দিলে নতুন গাড়ি কেনায় সরকার নিষেধাজ্ঞা দেয়। ফলে এই প্রকল্পের আওতায় ১১টি ডাবল কেবিন পিকআপ ও প্রকল্প পরিচালকের জন্য বরাদ্দ জিপ কেনা বন্ধ হয়ে যায়। তবে প্রকল্পের জন্য গাড়ি ভাড়া নেওয়ার সুযোগ থাকায় তখন উন্মুক্ত দরপত্র আহ্বান করা হয়। একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান গাড়ি সরবরাহের কাজ পায়।

মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, প্রকল্প পরিচালকের দায়িত্ব পালনের সময় আশিকুর নিজ নামে নিবন্ধন করা ব্যক্তিগত জিপ গাড়ি (ঢাকা মেট্রো-ঘ-২২-১৪১৬) প্রকল্পের কাজে ব্যবহারের জন্য গাড়ি সরবরাহকারী ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের কাছে মাসিক ৫০ হাজার টাকায় চুক্তিভিত্তিক ভাড়া দেন। ভাড়া দেওয়ার এ প্রক্রিয়া সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত বিধিমালার লঙ্ঘন। এ ধরনের কর্মকাণ্ডকে ‘সরবরাহকারীর সঙ্গে যোগসাজশ’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে প্রজ্ঞাপনে।

আশিকুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের যে স্পেসিফিকেশন (গাড়ি দেওয়ার যেসব শর্ত) ছিল, সে অনুযায়ী গাড়ি দিতে একটু গড়িমসি করছিলেন ঠিকাদার। সে ক্ষেত্রে এটা (নিজের গাড়ি ঠিকাদারের কাছে ভাড়া দেওয়া এবং পরে ঠিকাদারের কাছ থেকে ভাড়ায় নেওয়া) হয়েছিল। তবে সেটা মাত্র ছয় মাসের জন্য।’

প্রকল্প দপ্তর জানিয়েছে, এখন পুরোনো একটি পাজেরো গাড়ি প্রকল্প পরিচালক হিসেবে ব্যবহার করছেন আশিকুর।

‘(প্রকল্প পরিচালক আশিকুর) গাড়ি কিনেছেন, সেটা আবার তাঁর নামে নিয়েছেন (নিবন্ধন করেছেন)। সেটা যদি তাঁর স্ত্রী বা অন্য কারও নামে নিতেন, তখন এমনটা হতো না। পিডি (প্রকল্প পরিচালক) হয়ে নিজের প্রকল্পেই গাড়ি ভাড়া দিয়েছেন, ওই জন্য তিরস্কার পেয়েছেন।’
আনিছুর রহমান তালুকদার, অতিরিক্ত মহাপরিচালক, মৎস্য অধিদপ্তর

‘ত্রুটি বড় করে দেখানো হয়েছে’

আশিকুরকে ‘অসদাচরণ’-এর দায়ে সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা, ২০১৮-এর ৩(খ) বিধির ৪(২)(ক) অনুযায়ী তিরস্কার করা হয়েছে। বিধিমালায় যাকে লঘুদণ্ড হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।

বিধিমালা অনুযায়ী, অসদাচরণের দায়ে দোষী হলে দুই ধরনের দণ্ড দেওয়া যায়—লঘু ও গুরু। লঘুদণ্ডের মধ্যে রয়েছে তিরস্কার; চাকরি বা পদসম্পর্কিত বিধি বা আদেশ অনুযায়ী পদোন্নতি বা আর্থিক সুবিধা বৃদ্ধির অযোগ্যতার ক্ষেত্র ব্যতীত নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য পদোন্নতি বা বেতন বৃদ্ধি স্থগিত রাখা; কর্তব্যে অবহেলা বা সরকারি আদেশ অমান্য করার কারণে সংঘটিত সরকারের আর্থিক ক্ষতির সম্পূর্ণ অংশ বা উহার অংশবিশেষ, বেতন বা আনুতোষিক থেকে আদায় করা এবং বেতন গ্রেডের নিম্নতর ধাপে অবনতিকরণ।

একইভাবে গুরুদণ্ডও রয়েছ চার ধরনের। এর মধ্যে রয়েছে নিম্নপদ বা নিম্ন বেতন গ্রেডে অবনমিতকরণ, বাধ্যতামূলক অবসর প্রদান, চাকরি থেকে অপসারণ এবং চাকরি থেকে বরখাস্ত করা।

মৎস্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক আনিছুর রহমান তালুকদার প্রথম আলোকে বলেন, ‘ত্রুটি তো একটু আছেই। যেটুকু আছে, সেটাকে বড় করে দেখানো হয়েছে।’ গাড়ি ভাড়া দেওয়ার পদ্ধতি আছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘(প্রকল্প পরিচালক আশিকুর) গাড়ি কিনেছেন, সেটা আবার তাঁর নামে নিয়েছেন (নিবন্ধন করেছে)। সেটা যদি তাঁর স্ত্রী বা অন্য কারও নামে নিতেন, তখন এমনটা হতো না। পিডি (প্রকল্প পরিচালক) হয়ে নিজের প্রকল্পেই গাড়ি ভাড়া দিয়েছেন, ওই জন্য তিরস্কার পেয়েছেন।’

ঢাকা, বরিশাল ও খুলনা বিভাগের ১০টি জেলার ৪৯টি উপজেলায় দেশীয় প্রজাতির মাছ এবং শামুক সংরক্ষণ ও উন্নয়নের এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। সাড়ে ৩ বছর আগে শুরু হওয়া ২০৭ কোটি ৯৮ লাখ টাকার প্রকল্পটি চলতি বছরের জুনে শেষ হওয়ার কথা। তবে সময় বাড়ছে বলে জানা গেছে। এতে প্রকল্প ব্যয়ও ১৫-২০ ভাগ বাড়তে পারে।

খাল, বিলের মতো উন্মুক্ত জলাশয় শুকিয়ে মাছ ধরে ফেলা হয়। দেশীয় মাছ রক্ষায় এ প্রকল্পের আওতায় জলাশয়ে মৎস্য অভয়ারণ্য তৈরি করা হয়, যেখানে সারা বছর পানি থাকে এবং মাছ ধরতে দেওয়া হয় না। এ ছাড়া দরিদ্র মৎস্যজীবীদের বিকল্প কর্মসংস্থানের জন্য গরু, ছাগল, ভ্যান প্রভৃতি দেওয়া হয় এই প্রকল্পের আওতায়। যাতে তাঁরা মৎস্য আইন অবৈধভাবে মাছ না ধরেন। চাষিদের দেশি প্রজাতির মাছ চাষেও উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে। এ ছাড়া জলাশয় কমে আসা ও অতিমাত্রায় শামুক আহরণের কারণে যেন তা বিলুপ্ত না হয়ে যায়, সেই কাজও করা হচ্ছে এ প্রকল্পের আওতায়।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশি প্রজাতির মাছ ও শামুক সংরক্ষণ, উৎপাদন বৃদ্ধিতে এই প্রকল্প গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু স্বচ্ছতার সঙ্গে এর যথাযথ বাস্তবায়ন জরুরি।