বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন চলাকালে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে হতাহত হন বহু মানুষ
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন চলাকালে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে হতাহত হন বহু মানুষ

ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থান

ঘুমের মধ্যে শোনেন গুলির শব্দ

মানসিকভাবে চরম বিপর্যস্ত ২৯ জন জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে চিকিৎসা নিতে আসেন। ভর্তি আছেন দুজন।

এখনো ঘুমের মধ্যে মুহুর্মুহু গুলির আওয়াজ পান জাহিদুল ইসলাম। শোনেন গ্রেনেডের শব্দ। হঠাৎ জেগে উঠে শুরু করেন স্লোগান। কখনো কখনো নিজের শরীরে আঘাত করতে থাকেন। হাতের কাছে যা পান ভাঙচুর করেন। ঘর থেকে বের হয়ে যান। ‘আমার ভাই আবু সাঈদ’ কোথায় বলে চিৎকার করতে থাকেন।

নরসিংদীতে ছাত্র–জনতার আন্দোলনে অংশ নেওয়া জাহিদুল ইসলাম তিন মাস ধরে এমন পরিস্থিতির মধ্যে আছেন। জাহিদুলের গ্রামের বাড়ি ঝালকাঠির নলছিটিতে। আন্দোলনের পর মানসিকভাবে চরম বিপর্যস্ত অবস্থায় নরসিংদী থেকে গ্রামের বাড়িতে নেওয়া হয় তাঁকে। ধীরে ধীরে মানসিক অবস্থার চরম অবনতি হলে ৮ অক্টোবর তাঁকে রাজধানীর জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে ভর্তি করা হয়।

আন্দোলনের ঘটনায় মানসিক চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের অবস্থাভেদে সাইকোথেরাপি, কাউন্সেলিং এবং ওষুধ দিয়ে চিকিৎসা চলছে। এই রোগগুলো নিয়ন্ত্রণযোগ্য। যঁারা এ ধরনের মানসিক সমস্যায় ভুগছেন, তঁাদের উচিত দ্রুত চিকিৎসা গ্রহণ করা।
মুনতাসীর মারুফ,  সহযোগী অধ্যাপক, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট

বর্তমানে ইনস্টিটিউটের ৫ম তলার ১২৬ নম্বর বেডে চিকিৎসাধীন আছেন জাহিদুল ইসলাম। গতকাল সোমবার দুপুরে তাঁর মা রুমা বেগম প্রথম আলোকে বলেন, তিন সন্তান নিয়ে তাঁদের সংসার। স্বামী নারায়ণগঞ্জে দিনমজুরের কাজ করেন। টানাপোড়নের সংসারে বাবাকে সহযোগিতার জন্য ২০ বছর বয়সী জাহিদুল তিন মাস আগে নরসিংদী যান। সেখানে ১১ হাজার টাকা পারিশ্রমিকে একটি কারখানায় পোশাকে নকশার কাজ করছিলেন। এর মধ্যেই ঢাকা–সিলেট মহাসড়কে আন্দোলনে অংশ নেন তিনি।

ছেলের মানসিক অবস্থা নিয়ে রুমা বেগম বলেন, আন্দোলন শেষে বাড়ি ফিরে রাতে ঘুমাতে পারত না জাহিদ। শুধু বলতে থাকত, ‘আমার ভাই আবু সাঈদকে ওরা মেরে ফেলেছে।’ ছেলে আরও বলত, ‘পুলিশ এক পাশ দিয়ে গুলি করে আরেক পাশ দিয়ে বের করে ফেলছে। বাসায় ঢোকার পরেও গুলি করতে থাকে। এভাবে বলে আর চিৎকার করে। আর বলে মন্ত্রী–এমপি হয়ে সবাইকে সে দেখে নেবে।’

মা যখন কথা বলছিলেন, জাহিদুল তখন পাশেই বসা ছিলেন। দেখালেন হাতে স্প্লিন্টারের আঘাতের চিহ্ন। বলেন, এখনো উঠতে–বসতে হাঁটুতে ব্যথা অনুভব করেন। তবে কীভাবে ব্যথা পেয়েছেন, তা স্মরণ করতে পারেন না। একবার শুধু বললেন, ‘আমার ভাইদের ওরা গুলি করে মেরে ফেলছে। লাশ নিয়ে যখন মিছিল করছিলাম, তখন পায়ে ব্যথা পাইছি। এখনো পায়ে অনেক ব্যথা।’

মা রুমা বেগম জানালেন, ছেলের চাকরিটা আর নেই। তাঁকেও সারাক্ষণ ছেলের সঙ্গে হাসপাতালে থাকতে হচ্ছে।

জাহিদুলের চিকিৎসক জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের অনারারি মেডিকেল কর্মকর্তা তাহমিদ খান প্রথম আলোকে বলেন, শুরুতে তাঁর সঙ্গে কথাও বলা যেত না। চিকিৎসায় ধীরে ধীরে তাঁর অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়েছে।

ছাত্র–জনতার আন্দোলনে যাঁরা আহত হয়েছেন, তাঁদের জন্য জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে একটি বিশেষায়িত ইউনিট চালু করা হয়েছে। বহির্বিভাগেও তাঁদের জন্য রয়েছে আলাদা চিকিৎসার ব্যবস্থা। ৫ আগস্ট গণ–অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর জাহিদুলের মতো এমন আরও ২৮ জন জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে চিকিৎসা নিয়েছেন। চিকিৎসা নেওয়া মোট ২৯ জনের মধ্যে ২৭ জন বাসায় ফিরেছেন। এঁদের মধ্যে নয়জন নারী।

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট সূত্র জানায়, চিকিৎসা গ্রহণকারীদের তালিকায় আছেন বিভিন্ন বয়সী মানুষ। এঁদের সবাই আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী অথবা হতাহতদের স্বজন। তাঁদের প্রায় সবাই বাইপোলার কিংবা পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডার (পিটিএসডি) রোগে আক্রান্ত। তাঁদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর আন্দোলনসংক্রান্ত ঘটনাগুলোর প্রভাব পড়েছে।

শুরু থেকেই এই চিকিৎসাপ্রক্রিয়ার সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন ইনস্টিটিউটের কমিউনিটি ও সোশ্যাল সাইকিয়াট্রি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মুনতাসীর মারুফ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বাইপোলার ডিজ-অর্ডার আবেগজনিত একটি মানসিক রোগ। নির্যাতনের শিকার হওয়া এই রোগের অন্যতম লক্ষণ। এই রোগে আক্রান্ত রোগীরা নিজেকে অতি বিত্তশালী বা ক্ষমতাবান মনে করেন এবং এলোমেলো কথা বলেন। এটি বিষণ্ণতা পর্যায়ে গেলে মারাত্মক হয়ে উঠতে পারে।

জাহিদুলের সঙ্গে মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে একই ওয়ার্ডে ভর্তি আছেন মো. সজীব। নোয়াখালীর মাইজদীর বাসিন্দা সজীব পেশায় একজন হকার। দু–তিন বছর ধরে রাজধানীর গুলিস্তান ও নিউমার্কেট এলাকায় হেডফোন, হিজাব ও তোয়ালে বিক্রি করতেন। সজীবের বাবা প্রতিবন্ধী। তিন বোন, দুই ভাই ও মাকে নিয়ে সংসার চলত সজীবের টাকায়। গত ৫ আগস্ট মতিঝিল এলাকায় আন্দোলনে ছিলেন তিনি।

হাসপাতালের ইউনিটে গিয়ে দেখা যায়, সজীব দুই কানে হাত দিয়ে বসে আছেন। বারবার বলছেন, ‘ওরা বুলেট মারছে, বোমা মারছে। ওদের থামাও।’ কর্তব্যরত চিকিৎসক, সজীবের মা–সহ অন্যরা জানান, রাতে হঠাৎ করে মিছিল শুরু করে সজীব। সবার কাছে গিয়ে গিয়ে মিছিলে আসতে বলেন। আর বলতে থাকেন, ‘ছাত্ররা রাস্তায় আন্দোলন করছে। আমাদের দ্রুত যেতে হবে।’

সজীব পিটিএসডি রোগে আক্রান্ত। এই রোগের বিষয় ডা. মুনতাসীর মারুফ বলেন, ‘এ রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির মনে ভয়ংকর বিপর্যয় বা আঘাতটির দুঃসহ স্মৃতি বারবার ফিরে আসে। ঘটনার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত কোনো শব্দ, দৃশ্য বা আলোচনা ব্যক্তির মনে সে স্মৃতি জাগিয়ে তোলে। ব্যক্তি একই রকম ভয়, আতঙ্ক, বেদনা অনুভব করেন।’

মুনতাসীর মারুফ বলেন, আন্দোলনের ঘটনায় মানসিক চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের অবস্থাভেদে সাইকোথেরাপি, কাউন্সেলিং এবং ওষুধ দিয়ে চিকিৎসা চলছে। এই রোগগুলো নিয়ন্ত্রণযোগ্য। যঁারা এ ধরনের মানসিক সমস্যায় ভুগছেন, তঁাদের উচিত দ্রুত চিকিৎসা গ্রহণ করা।