মুহূর্তের অসতর্কতায় পানিতে ডুবে প্রাণ যাচ্ছে শিশুদের

বাড়ির পেছনের পুকুরে শেওলা মাখানো সোলায়মান সা’দকে ভাসতে দেখে পুরোনো পুতুল ভেবেছিলেন মামা তাজুল ইসলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই অন্যদের চিৎকারে বোঝেন ভাসতে থাকা ‘পুরোনো পুতুল’ তাঁর আদরের ভাগনে।

দুই ঘণ্টা ধরে খোঁজাখুঁজির পর পুকুরটিতে পাওয়া যায় শিশুটির মরদেহ। ঈদের ছুটিতে ঢাকা থেকে লক্ষ্মীপুরে দাদার বাড়ি বেড়াতে গিয়ে পানিতে ডুবে মৃত্যু হয় আড়াই বছরের সোলায়মানের। বাড়িটির আশপাশে ১০টির মতো পুকুর আছে। বাড়ির সামনের পুকুরে ঘাট থাকলেও পেছনের পুকুরের চারপাশে বস্তা ফেলা ছিল।

তাজুল ইসলাম গতকাল সোমবার প্রথম আলোকে জানান, তাঁদের বাড়ি ও বোনের শ্বশুরবাড়ি লক্ষ্মীপুরের রামগঞ্জ উপজেলার ৫ নম্বর চণ্ডীপুর ইউনিয়নের পূর্ব মাসিমপুর গ্রামে। ঈদের পরদিন শুক্রবার (১২ এপ্রিল) দুপুর ১২টার দিকে সবার অগোচরে সা’দ বাড়ির পেছনে পুকুরে পড়ে যায়। সা’দ তাঁর ছোট বোন তাহমিনা আক্তারের দ্বিতীয় সন্তান।

নজরদারি ও সচেতনতার অভাব, সাঁতার না জানা এবং ডুবে যাওয়ার পর তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়ে অজ্ঞতার কারণে এত শিশুর পানিতে ডুবে মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

একদিকে শোক, অন্যদিকে ছোট্ট সা’দকে দেখে রাখতে না পারার অনুশোচনা কাজ করছে পরিবারের সবার মধ্যে—জানান তাজুল।  

ঈদ ও নববর্ষের ছুটিতে পরিবারের অসতর্কতায় সা’দের মতো পানিতে ডুবে আরও শিশুর মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। প্রথম আলোতে প্রকাশিত খবর অনুসারে, সরকারিভাবে ঈদের ছুটি শুরুর দিন গত বুধবার (১০ এপ্রিল) থেকে গত রোববার (১৪ এপ্রিল, বাংলা নববর্ষ) পর্যন্ত পাঁচ দিনে পানিতে ডুবে মৃত্যু হয়েছে ১৬ জনের। এর মধ্যে ১৪টি শিশু। আর ছুটির আগে–পরে ৯ ও ১৫ এপ্রিল আরও ৭ জন পানিতে ডুবে মারা গেছে। এর মধ্যেও শিশু ৬ জন।

এসব ঘটনার মধ্যে ঈদের পরদিন জামালপুরের ইসলামপুরে মিনাল (৪ বছর ৬ মাস) ও মিনহাজ (৩) নামের দুই ভাইয়ের ডুবে মৃত্যু হয়েছে। শিশু দুটির চাচা মো. হাসান আলী গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর ভাই আজহার আলী ও ভাবি চায়না আক্তার তিন ছেলেকে নিয়ে উপজেলার ৭ নম্বর পার্থশী ইউনিয়নে বসবাস করেন। ঈদের ছুটিতে সন্তানদের নিয়ে তাঁদের নানাবাড়ি একই উপজেলার সাপধরী ইউনিয়নে যান ভাই–ভাবি।

হাসান আলী জানান, গত শুক্রবার দুপুরে শিশু দুটির মা ও নানি যমুনা নদীর শাখায় (খালে) গোসল করতে যান। ওই সময় তাঁরা খালে মাছ দেখে মাছ ধরা শুরু করেন। এর আগে তাঁদের পিছু পিছু দুই শিশুও যে চলে এসেছিল, সেটা তাঁরা খেয়াল করেননি। মাছ ধরার একপর্যায়ে পায়ে কিছু আটকালে নানি তুলে দেখেন সেটি দুই শিশুর একজন। তখন তাঁরা চিৎকার করে তাঁদের পেছনে অপর শিশুকে খুঁজতে থাকেন। একসময় দ্বিতীয় শিশুটিকে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়।

শিশুদের চাচা হাসান আলী বলেন, ‘সন্তানদের হারিয়ে ভাই–ভাবি পাগলের মতো আচরণ করছেন। তাঁদের সঙ্গে এখন কারও কথা বলা সম্ভব নয়।’

প্রথম আলোর তথ্য অনুসারে, ৯ এপ্রিল কিশোরগঞ্জে দুজন, ১০ এপ্রিল বগুড়ায় একজন, ১২ এপ্রিল মুন্সিগঞ্জে তিনজন (দুজন প্রাপ্তবয়স্ক), ১৩ এপ্রিল ফেনীতে একজন, জামালপুরে দুজন, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় একজন ও নাটোরে দুজন, ১৪ এপ্রিল বগুড়ায় একজন, ঠাকুরগাঁওয়ে দুজন, চট্টগ্রামে দুজন ও সুনামগঞ্জে একজন এবং ১৫ এপ্রিল শেরপুরে দুজন ও বরিশালে তিনজন (একজন প্রাপ্তবয়স্ক) ডুবে মারা গেছে।

ডুবে মৃত্যু প্রতিরোধে প্রথমত, প্রাতিষ্ঠানিক নজরদারি প্রয়োজন। সকাল নয়টা থেকে বেলা একটা পর্যন্ত ডুবে মৃত্যুর ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটে। ওই সময়ে মায়েরা কাজে ব্যস্ত থাকেন। তাই শিশুদের দিবা-যত্ন কেন্দ্রে রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। দ্বিতীয়ত, ৬ থেকে ১০ বছরের শিশুদের অবশ্যই সাঁতার শেখাতে হবে।
আমিনুর রহমান, আইডিআরসি বাংলাদেশের পরিচালক  

‘এটা অবহেলাজনিত হত্যা’

লেখক ও গবেষক গওহার নঈম ওয়ারার মতে, পানিতে ডুবে শিশুর মৃত্যু ‘অবহেলাজনিত হত্যা’। গতকাল প্রথম আলোকে তিনি বলেন, সন্তানের এমন করুণ মৃত্যুর জন্য এককভাবে মাকে দোষারোপ করা হয়। অথচ দোষ বাবাসহ পরিবারের প্রত্যেকের। একটা শিশুকে দেখভালের দায়িত্ব পরিবারের সবার। কিন্তু এ নিয়ে সচেতনতার অভাব রয়ে যায়।

গওহার নঈম ওয়ারা বলেন, দেখা যায়, ছুটিতে মাকে রান্নার কাজেই ব্যস্ত রাখা হয়। ছুটিতে বাবার কাজ তো শুধু ঘোরা আর ঘুমানো নয়। শিশুটি দুর্ঘটনাবশতই মারা গেছে নাকি তাকে পানিতে ফেলে দেওয়া হয়েছে, সেসব কিছুই খোঁজা হয় না। পুলিশের উচিত লাশের ময়নাতদন্ত করা। অথচ পুলিশ ‘পরিবারের অনুরোধে’ ময়নাতদন্ত ছাড়াই লাশ হস্তান্তর করে এবং দায়সারা গোছের ‘অপমৃত্যুর মামলা’ হিসেবে ঘটনাগুলো নথিভুক্ত করে।

জামালপুরে শিশু মিনাল ও মিনহাজের মৃত্যুর ঘটনায় ৭ নম্বর পার্থশী ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সদস্য হাসান হাবিবুল্লাহ খান প্রথম আলোকে বলেন, তিনি শিশু দুটির মৃত্যুর ঘটনা শুনে ঘটনাস্থলে যান। পুলিশও এসেছিল। শিশুটির বাবা বলছিলেন, তাঁর কারও বিরুদ্ধে ‘দাবি’ (অভিযোগ) নেই। তিনি ময়নাতদন্ত চান না। পরে সবাই অনুরোধ করলে পুলিশ চলে যায়।

লক্ষ্মীপুরে মৃত শিশু সা’দের মামা তাজুল ইসলাম জানান, তাঁরাও ময়নাতদন্ত ছাড়া লাশ দাফন করেছেন। তিনি বলেন, ‘একটি শিশুর ওপর কোনো মা–বাবা কাটাছেঁড়া করতে চায়, বলেন?’

গওহার নঈম ওয়ারা নিজেও গণমাধ্যম থেকে পানিতে ডোবার ঘটনাগুলো সংকলন করেছেন। তাঁর হিসাবে, ঈদের ছুটিতে (১৫ এপ্রিল দুপুর ১২টা পর্যন্ত) ১১ জেলায় ১৯ জন ডুবে মারা গেছে। এর মধ্যে শিশু ১৭টি। শিশুদের ৬ জন মেয়ে ও ১১ জন ছেলে। প্রাপ্তবয়স্ক দুজন প্রকৌশলী রিয়াদ আহমেদ (৪৫) ও ব্যাংক কর্মকর্তা জুয়েল রানা (৪০) মারা যান শুক্রবার মুন্সিগঞ্জের টঙ্গিবাড়ী উপজেলায় পদ্মা নদীতে গোসল করতে নেমে। ওই সময় বাবা ও খালুর সঙ্গে গোসল করতে নেমে মারা যায় রিয়াদ আহমেদের কিশোর সন্তান আরিফ আহমেদও (১৬)।

গওহার নঈম ওয়ারা বলেন, দীর্ঘ ছুটিতে পানিতে ডুবে শিশুর মৃত্যুর আশঙ্কা থাকে। এ ধরনের ঘটনা প্রতিরোধে ছুটি শুরুর বেশ আগে থেকে সরকারি–বেসরকারি পর্যায়ে সচেতনতামূলক প্রচারাভিযান চালানো উচিত।

জোর দিতে হবে তিনটি বিষয়ে

নজরদারি ও সচেতনতার অভাব, সাঁতার না জানা এবং ডুবে যাওয়ার পর তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়ে অজ্ঞতার কারণে এত শিশুর ডুবে মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

ইন্টারন্যাশনাল ড্রাউনিং রিসার্চ সেন্টার (আইডিআরসি) বাংলাদেশের পরিচালক আমিনুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ডুবে মৃত্যু তিনভাবে প্রতিরোধ করা সম্ভব। প্রথমত, প্রাতিষ্ঠানিক নজরদারি প্রয়োজন। সকাল নয়টা থেকে বেলা একটা পর্যন্ত ডুবে মৃত্যুর ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটে। ওই সময়ে মায়েরা কাজে ব্যস্ত থাকেন। তাই শিশুদের দিবা-যত্ন কেন্দ্রে রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। দ্বিতীয়ত, ৬ থেকে ১০ বছরের শিশুদের অবশ্যই সাঁতার শেখাতে হবে। তৃতীয়ত, ডুবে যাওয়ার ১০ মিনিটের মধ্যে কী করতে হবে, সে সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। ডুবে যাওয়া শিশু বা ব্যক্তির মুখে মুখ লাগিয়ে শ্বাস দিতে হবে এবং হৃৎপিণ্ড বরাবর এক ইঞ্চি পর্যন্ত দেবে যায় এমনভাবে চাপ দিতে হবে।

ডুবে মৃত্যু রোধে আইইডিআরসি দেশের ১০টি উপজেলায় ৫০০ দিবাযত্ন কেন্দ্র পরিচালনা করছে বলে জানান আমিনুর রহমান।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ‘বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস ২০২২’ প্রতিবেদন অনুসারে, পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশু মৃত্যুর ৭ শতাংশের বেশি ঘটে পানিতে ডুবে।

গণমাধ্যম উন্নয়ন ও যোগাযোগবিষয়ক বেসরকারি সংগঠন সমষ্টির প্রতিবেদন অনুসারে, ২০২৩ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত গণমাধ্যমে পানিতে ডুবে ৮৮০টি মৃত্যুর ঘটনা প্রকাশিত হয়েছে। এর মধ্যে ৮৭ শতাংশ ঘটনায় ভুক্তভোগীর বয়স ছিল ৯ বছরের নিচে। এ হার ২০২২ সালের তুলনায় ৬ শতাংশ বেশি। মোট মৃত্যুর এক–তৃতীয়াংশের বেশি ঘটেছে সকাল থেকে দুপুরের মধ্যে।

সরকার কী করছে

পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যু ঠেকাতে সরকারের জোরালো কোনো পদক্ষেপ নেই। ‘সমাজভিত্তিক সমন্বিত শিশু-যত্ন কেন্দ্রের মাধ্যমে শিশুর প্রারম্ভিক বিকাশ ও সুরক্ষা এবং সাঁতারসুবিধা প্রদান’ শীর্ষক একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়। দুই বছর মেয়াদি প্রকল্পটি ২০২২ সালে শুরু হওয়ার কথা থাকলেও এখনো শুরু হয়নি। প্রকল্পের মাধ্যমে ১৬টি জেলার ৪৫টি উপজেলায় আট হাজার দিবাযত্ন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা হবে। সেখানে দুই লাখ শিশুর যত্ন নেওয়া হবে এবং নির্দিষ্ট বয়সে সাঁতার প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। ২৭১ কোটি টাকা ব্যয়ের প্রকল্পটির পরিচালনায় রয়েছে বাংলাদেশ শিশু একাডেমি।

বাংলাদেশ শিশু একাডেমির মহাপরিচালক আনজীর লিটন প্রথম আলোকে বলেন, একটু দেরি হলেও প্রকল্পটি শুরু করার সব প্রক্রিয়া শেষ করা হয়েছে। শিগগিরই শুরু হবে। প্রকল্পের আওতায় শিশুদের দেখভাল করার দায়িত্ব যাঁদের, তাঁদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। যেসব বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে প্রকল্প পরিচালনা করা হবে, সেসবও নির্ধারণ করা হয়েছে। এ প্রকল্পের মাধ্যমে বছরজুড়ে ডুবে শিশুমৃত্যু ঠেকাতে প্রচারাভিযান চালানো হবে। এ ছাড়া শহরের শিশুদের সাঁতার শেখানোর জন্য শিশু একাডেমিতে তৃতীয় মেয়াদে তিন মাসের সাঁতার প্রশিক্ষণ মে মাস থেকে শুরু হবে বলেও জানান তিনি।