প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে আজ সোমবার সচিব সভায় সভাপতিত্ব করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে আজ সোমবার সচিব সভায় সভাপতিত্ব করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা

পণ্য পরিবহনে চাঁদাবাজি ঠেকাতে শক্ত ব্যবস্থার নির্দেশ প্রধানমন্ত্রীর

দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির একটি কারণ পণ্য পরিবহনে চাঁদাবাজি। তাই এ বিষয়ে খুবই শক্ত ব্যবস্থা নিতে সচিবদের প্রতি নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। একই সঙ্গে দুর্নীতি দমনে ব্যবস্থা নেওয়া, আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে উল্লেখিত প্রতিশ্রুতিগুলো বাস্তবায়নে পদক্ষেপ নেওয়া, কর আদায়ের আওতা বাড়ানোসহ সচিবদের প্রতি আরও একগুচ্ছ নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।

আজ সোমবার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত ‘সচিব সভায়’ এসব নির্দেশনা দেন প্রধানমন্ত্রী। বিকেলে সচিবালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে বৈঠকে আলোচনার বিষয়বস্তু তুলে ধরেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব মো. মাহবুব হোসেন। তিনি বলেন, জাতীয় নির্বাচনে যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন করার জন্য সংশ্লিষ্ট সব মন্ত্রণালয় ও সচিব এবং জনপ্রশাসনকে সামগ্রিকভাবে ধন্যবাদ জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেছেন, এই নির্বাচনের মাধ্যমে বাংলাদেশের মানুষের গণতান্ত্রিক অভিযাত্রা সুসংহত হয়েছে।

প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তা সচিবদের নিয়ে অনুষ্ঠিত এই বৈঠকে নির্ধারিত কোনো আলোচ্য বিষয় থাকে না। বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়। বৈঠকে সব সচিব উপস্থিত ছিলেন। তাঁদের মধ্যে ১৫ থেকে ১৬ জন সচিব বক্তব্য দেন। এর আগে সর্বশেষ ২০২২ সালের নভেম্বর মাসে প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে সচিব সভা হয়েছিল।

বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, সচিবদের মধ্যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের জ্যেষ্ঠ সচিব, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ এবং কারিগরি ও মাদ্রাসা বিভাগের সচিব, বাণিজ্যসচিব, কৃষিসচিব, খাদ্যসচিব, অর্থসচিব, বিদ্যুৎ বিভাগ এবং জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের সচিবসহ ১১ সচিব নিজ নিজ মন্ত্রণালয় ও বিভাগের বিভিন্ন তথ্য উপস্থাপন করেন। সকাল ১০টা থেকে বেলা দেড়টা পর্যন্ত চলে এই বৈঠক।
মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, সভায় প্রথমে নির্বাচনী ইশতেহার নিয়ে আলোচনা হয়। তারপর দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ ও আসন্ন রমজানের প্রস্তুতি নিয়ে অবহিত করা হয়।

খাদ্যনিরাপত্তা পরিস্থিতি, কৃষি উৎপাদন ও সার ব্যবস্থাপনা, কর্মমুখী শিক্ষা, নতুন শিক্ষাক্রম ও কর্মসংস্থান, বিদ্যুৎ সরবরাহ ও জ্বালানিনিরাপত্তা, আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণ, উন্নয়ন প্রকল্প প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি পর্যালোচনা, সামষ্টিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও আর্থিক খাতের দক্ষতা বৃদ্ধি নিয়ে আলোচনা হয়। এর ভিত্তিতে প্রধানমন্ত্রী নির্দেশনা দেন।

চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে কঠোর নির্দেশনা

মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, প্রধানমন্ত্রী আইনশৃঙ্খলা রক্ষা ও বাজারমূল্য নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষেত্রে নজরদারি করতে বলেছেন। এখানে একটি সুনির্দিষ্ট ক্ষেত্রের কথা তিনি বলেছেন। অনেক সময় দ্রব্যমূল্যের জন্য বিভিন্ন পর্যায়ে চাঁদাবাজির প্রসঙ্গ আসে। এটির ক্ষেত্রে তিনি তিনি সংশ্লিষ্ট সবাইকে খুবই শক্তভাবে ব্যবস্থা নিতে বলেছেন, এটি যেন কোথাও না হয়।

আইনশৃঙ্খলার ক্ষেত্রে নজর দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, বিশেষ করে ছিনতাই, কিশোর গ্যাং বা এ রকম যেসব অপরাধ হচ্ছে, সে ক্ষেত্রে স্থানীয় পর্যায়ে কমিটি গঠন করে এ বিষয়ে নজর দিতে বলেছেন প্রধানমন্ত্রী।

দুর্নীতি দমন

মন্ত্রিপরিষদ সচিব মো. মাহবুব হোসেন জানান, প্রধানমন্ত্রী দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্সের’ কথা সচিবদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, দুর্নীতি দমনের দায়িত্ব শুধু দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) নয়। দুর্নীতি নিরসন ও প্রতিরোধের জন্য প্রতিটি মন্ত্রণালয় ও সচিবদেরও দায়িত্ব আছে। তাই যেখানে যেখানে ‘সার্ভিস পয়েন্ট’ আছে, সেখানে নজরদারি বা ভিন্নতর কৌশল অবলম্বন করে যেখানে যে প্রক্রিয়া নেওয়া দরকার, তা নিয়ে দুর্নীতি দমনের নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।

ইশতেহার বাস্তবায়নে জোর

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, নির্বাচনী ইশতেহার হবে পাঁচ বছরে সরকার পরিচালনার মূলনীতি-দলিল। এই দলিল বাস্তবায়নের জন্য তিনি নির্দেশনা দিয়েছেন।
নির্বাচনী ইশতেহার বাস্তবায়ন সমন্বয়ের দায়িত্ব মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ করবে জানিয়ে মাহবুব হোসেন বলেন, নির্বাচনী ইশতেহারে ১১টি অগ্রাধিকার কার্যক্রম আছে, ৩০০টির বেশি অঙ্গীকার আছে, সেটিকে ম্যাপিং করা হবে। এর মধ্য দিয়ে কোন মন্ত্রণালয়ের কী কাজ, সেটা চিহ্নিত করা হবে।

নতুন প্রকল্প নেওয়ার ক্ষেত্রে খুবই সতর্ক হতে বলেছেন প্রধানমন্ত্রী। যে প্রকল্পগুলো জনগণের কল্যাণে হবে, জনগণ উপকার পাবে, সেদিকে মনোযোগ দিতে সচিবদের প্রতি নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। এ ছাড়া বিদ্যমান প্রকল্পগুলোর মধ্যে যেগুলো প্রায় শেষ পর্যায়ে আছে, সেগুলো যেন দ্রুত শেষ করা হয়, সে বিষয়ে নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।

বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত ভালোভাবে নেওয়া হবে না

মুদ্রাস্ফীতি যেন জিডিপির প্রবৃদ্ধির চেয়ে বেশি না হয়, সে বিষয়ে কাজ করার জন্য নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ ছাড়া বিপুলসংখ্যক মানুষ যাদের আয়কর দেওয়ার কথা, তারা আয়করের আওতায় আসেনি। তাদের যেন আয়করের আওতায় আনা হয়, সে বিষয়ে জোরালো নির্দেশ দিয়েছেন তিনি।

বৈদেশিক বিনিয়োগ আকর্ষণের জন্য পদক্ষেপ নিতে বলেছেন প্রধানমন্ত্রী। বিষয়টি জানিয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, বিনিয়োগ আসার ক্ষেত্রে কোনো জটিলতা থাকলে, সেটি যেন তাঁর নজরে নেওয়া হয়, সে নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। কোনো কারণে বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হলে সেটি ভালোভাবে নেবেন না বলেও সতর্ক করেছেন তিনি। এ ছাড়া সরকারি অর্থ ব্যয়ের ক্ষেত্রে মিতব্যয়ী হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। তিন ফসলি জমি যাতে কোনো অবস্থায় নষ্ট না হয়, সে বিষয়ে সতর্ক করেছেন।

আলোচনায় নতুন শিক্ষাক্রম

সচিব সভায় নতুন শিক্ষাক্রম নিয়েও আলোচনা হয়েছে। মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, নতুন যে শিক্ষাক্রম নেওয়া হয়েছে, সেটি প্রচলিত শিক্ষাক্রম নয়। তা থেকে ভিন্ন। এই বাস্তবতা মানতে হবে। তবে যদি কোনো ভুলভ্রান্তি, যদি কোনো তথ্যগত বা কোনো একটি বিষয়ে আলোচনা হয়, তাহলে দ্রুত যেন সে বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হয়, সে নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। কারণ, এটা নতুন শিক্ষাক্রম। যাঁরা করছেন, তাঁদের মধ্যে থেকে যদি কোনো রকমের ভুলত্রুটি বা কোনো ঘাটতি তৈরি হয়, কোনো আলোচনা হয়, তাহলে সেটি যথাযথভাবে পর্যালোচনা করে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য বলেছেন এবং সবাইকে সজাগ থাকতে বলেছেন প্রধানমন্ত্রী।

এ ছাড়া কারিগরি শিক্ষার ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। একই সঙ্গে যে প্রতিষ্ঠানগুলো তৈরি হয়েছে, সেগুলোতে যেন মানসম্মত প্রশিক্ষণ হয়, সেটিও স্মরণ করে দিয়েছেন তিনি।

তিন পণ্যে গার্মেন্টের মতো সুবিধা দেওয়ার নির্দেশ

কৃষিজাত পণ্য, চামড়া ও পাটজাত পণ্যের ক্ষেত্রে গার্মেন্টের মতো সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার বিষয়ে নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। আর রপ্তানির ক্ষেত্রে নতুন বাজার বিশেষ করে কয়েকটি এলাকার কথা বলেছেন যেখানে বাজার খুঁজতে হবে। মধ্যপ্রাচ্য, পূর্ব ইউরোপ, পূর্ব এশিয়া ও আফ্রিকায় যেন বাজার খোঁজা হয়, বিশেষ করে ওষুধ, পোশাক, খাদ্য, কৃষিজাত পণ্য, পাটজাত পণ্যের ক্ষেত্রে যেন বাজার খোঁজা হয়। এ ক্ষেত্রে সহযোগিতার প্রয়োজন হলে যেন সহায়তা দেওয়া হয়, সে বিষয়েও নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।

এ ছাড়া বিদ্যুৎ, জ্বালানি ব্যবহারের ক্ষেত্রে সাশ্রয়ী হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন শেখ হাসিনা। কোনোভাবেই যেন সেচ মৌসুম বাধাগ্রস্ত না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে বলেছেন। এ ছাড়া সেচের ক্ষেত্রে সোলার এনার্জি ব্যবহারের জন্য পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলেছেন তিনি।

উপজেলা পর্যায়েও বইমেলা করার নির্দেশ

সচিব সভায় উপজেলা পর্যায়েও বইমেলা আয়োজনের নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। এ ছাড়া তিনি শূন্যপদ পূরণের জন্য উদ্যোগ নিতে বলেছেন এবং সময়মতো পদোন্নতির জন্য বলেছেন। আশ্রয়ণ প্রকল্পে যাঁরা আছেন, তাঁদের জন্য প্রয়োজনে কর্মসংস্থান সৃষ্টির বিশেষ উদ্যোগ নিতে বলেছেন। এ ছাড়া কর্মকর্তাদের সংসদ কার্যবিধি সম্পর্কে অবহিত হতে নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।

বৈঠকে মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ লড়াইয়ের রেশ বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী এলাকাতেও পড়ার বিষয়টি নিয়ে সচিব সভায় আলোচনা হলেও সে বিষয়ে বিস্তারিত বলেননি মন্ত্রিপরিষদ সচিব।