স্বামীর নির্যাতনের শিকার হয়ে দুই দিন হাসপাতালে থাকতে হয়েছিল মেয়েটিকে। পরে বাধ্য হয়ে স্বামীর দাবি অনুযায়ী ৫০ হাজার টাকা দেয় তাঁর পরিবার। তাতেও সংসার টেকেনি। গত ১৯ ফেব্রুয়ারি সিরাজগঞ্জের বেলকুচি উপজেলার রাজাপুর ইউনিয়নের আমবাড়িয়া গ্রামে একটি বাড়ির উঠানে বসে কথা হয় মেয়েটির (২০) সঙ্গে। দুই বছরের সংসারজীবনের অশান্তির গল্পগুলো তিনি শুনিয়েছিলেন।
মেয়েটির বাড়ি উপজেলার রাজাপুর ইউনিয়নের আগুরিয়া চর গ্রামে। বর্ষাকালে নৌকায় যাতায়াত করতে হয়। এখন পানি কম। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান (এনজিও) ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রামের (এনডিপি) কাজে হাঁটাপথে আমবাড়িয়ায় এসেছেন। পঞ্চম শ্রেণি পাস মেয়েটি সেখানে সেলাই প্রশিক্ষণ নিয়েছেন।
মেয়েটি বলছিলেন, আট মাস আগে বিবাহবিচ্ছেদ হয়েছে। নির্যাতন বা দেনমোহরের দুই লাখ টাকা আদায়ে কখনো আইনি সাহায্য নেননি। তাঁর ভাষায়, ‘মামলার পেছনে কে দৌড়াবে! বাবা-মা মেনে নিছে, আমিও মেনে নিছি।’
উপজেলার পাকা সড়কের দুই পাশে সবুজ গাছ, ফসলের খেত, খাল, কোনো কোনো খালের পাশে তাঁবু গেড়ে বেদে পরিবারের বসবাস। পাশে লোকালয়ে তাঁতের খুটখাট শব্দ বা পাওয়ার লুমের (বৈদ্যুতিক তাঁত) অবিরাম যান্ত্রিক শব্দ। নির্জন গ্রামে রাত ১১টা পর্যন্ত তাঁতের শব্দ এলাকার মানুষের নাকি গা–সওয়া হয়ে গেছে। সেই রকমই পারিবারিক নির্যাতনও ভয়াবহভাবে তাঁদের যেন গা–সওয়া হয়ে উঠেছে।
গত ১৯ ফেব্রুয়ারি সিরাজগঞ্জের বেলকুচির রাজাপুর ইউনিয়নের আগুরিয়া চরের ওই মেয়েটিসহ আশপাশের আগুরিয়া, হরিনাথপুর, মোকিমপুর, চন্দ্রপাড়া, বৈলগাছি গ্রামের ২১ নারীর সঙ্গে কথা হয়। তিন–চারজন ছাড়া বাকিরা কমবেশি স্বামীর নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। তিনজন গ্রাম্য সালিসে বিচার দিলেও কখনো থানায় অভিযোগ বা মামলা করেননি।
ওই নারীদের কেউ কেউ বলেন, মারামারির মধ্যেই টিকে থাকতে হয়। আর্থিক সংকটের কারণে নির্যাতনের ঘটনা বেশি। তাই সংসারের আয়ের জন্য তাঁরা কাজ করেন। ওই নারীদের ১৬ জন তাঁত ও জমিতে কাজ করেন। দুজন ছিলেন ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সংরক্ষিত নারী ওয়ার্ডের সাবেক সদস্য।
মামলার পেছনে কে দৌড়াবে! বাবা-মা মেনে নিছে, আমিও মেনে নিছি।সিরাজগঞ্জের বেলকুচি উপজেলায় স্বামীর নির্যাতনের শিকার এক নারী
সরকারি-বেসরকারি দুটি গবেষণায় দেখা যায়, দেশে দুই-তৃতীয়াংশ নারী পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হলেও আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার হার মাত্র ৩ শতাংশ। সচেতনতার অভাব, সংসারে টিকে থাকার ইচ্ছা, লোকলজ্জা ও অর্থ খরচের ভয়ে অধিকাংশ নারী থানায় অভিযোগ করেন না। পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন, ২০১০ অথবা নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ (সংশোধিত ২০০৩ ও ২০২০) বা অন্য কোনো প্রাসঙ্গিক আইনে তাঁরা বিচার চান না।
চর, উপকূল, পার্বত্য ও হাওর এলাকার ১৪ জেলার ১৪টি উপজেলার ২৮টি ইউনিয়নে বেসরকারি সংস্থা মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন পরিচালিত এক জরিপে বলা হয়েছে, গত বছর প্রায় ৩১ শতাংশ নারী শারীরিক, মানসিক, অর্থনৈতিক ও যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।
পাশে লোকালয়ে তাঁতের খুটখাট শব্দ বা পাওয়ার লুমের (বৈদ্যুতিক তাঁত) অবিরাম যান্ত্রিক শব্দ। নির্জন গ্রামে রাত ১১টা পর্যন্ত তাঁতের শব্দ এলাকার মানুষের নাকি গা–সওয়া হয়ে গেছে। সেই রকমই পারিবারিক নির্যাতনও ভয়াবহভাবে তাঁদের যেন গা–সওয়া হয়ে উঠেছে।
‘কমিউনিটিভিত্তিক জলবায়ু–সহনশীলতা ও নারীর ক্ষমতায়ন কর্মসূচি (ক্রিয়া)’ শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় এক হাজারের বেশি নারী-পুরুষের ওপর জরিপটি চালানো হয়। এতে বলা হয়েছে, নানামুখী নির্যাতনের ধরন সম্পর্কে সচেতনতার অভাবে তাঁরা অনেক সময় বুঝতে পারেন না, নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। ফলে নির্যাতনের শিকার হলেও মাত্র ১৬ শতাংশ মামলা করেন। ওই জরিপ এলাকার মধ্যে সিরাজগঞ্জের বেলকুচি উপজেলাও ছিল।
নারী নির্যাতন বিষয়ে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ ‘রিপোর্ট অন ভায়োলেন্স এগেইনস্ট উইমেন সার্ভে ২০১৫’ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রায় ৭৩ শতাংশ নারী কোনো না কোনো সময় স্বামীর নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। কিন্তু ৩৯ শতাংশ নারী অভিযোগ করার প্রয়োজন বোধ করেন না। লোকলজ্জা, সামাজিক মর্যাদা, পরিবারের সম্মানহানির ভয়ে প্রায় ২৭ শতাংশ নারী অভিযোগ জানাতে চান না।
এমন এক পরিস্থিতিতে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে নারীর সম–অধিকারের প্রত্যাশা নিয়ে আজ ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালিত হচ্ছে। এবারের প্রতিপাদ্য ‘নারীর সম–অধিকার, সমসুযোগ, এগিয়ে নিতে হোক বিনিয়োগ’।
বিবিএসের এক জরিপ বলছে প্রায় ৭৩ শতাংশ নারী কোনো না কোনো সময় স্বামীর নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। কিন্তু ৩৯ শতাংশ নারী অভিযোগ করার প্রয়োজন বোধ করেন না। লোকলজ্জা, সামাজিক মর্যাদা, পরিবারের সম্মানহানির ভয়ে প্রায় ২৭ শতাংশ নারী অভিযোগ জানাতে চান না।
দুই সন্তানের মা বৈলগাছি গ্রামের এক নারী (৩৭) বললেন, একদিন সকালে তিনি স্বামীকে কাজে যেতে ঘুম থেকে ডাকলে হাতের কাছে থাকা কাঠের টুকরা দিয়ে তাঁর মাথায় আঘাত করেন। মারের চোটে তিনি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। নিয়মিত নির্যাতনের শিকার হলেও একবার শুধু ইউপি চেয়ারম্যানের কাছে অভিযোগ করেছিলেন।
ওই গ্রামের আরেক নারী (৩৪) বলেন, ‘ইট, লাঠি, বাটাম (কাঠের টুকরা)—হাতের কাছে যা পায়, তা দিয়ে স্বামী বাড়ি মারে।’ তিনি বলেন, ইউপি চেয়ারম্যান, সদস্য বা থানা–পুলিশ যেখানেই অভিযোগ জানাতে যাবেন, সেখানেই টাকা লাগে। তাই যান না।
ওই নারী বলেন, স্বামীর মারের চোটে একবার রাগ করে কাজের খোঁজে ঢাকায় চলে যেতে চেয়েছিলেন। এসএসসি পরীক্ষার্থী একমাত্র সন্তান (১৭) বাধা দিয়ে বলেছিল, ‘মা, যাইয়ো না। আমি বড় অই। কামাই কইরা তোমাক খিলাব।’
আরেক নারী বলছিলেন, বিবাহবিচ্ছেদ বাবদ গ্রাম্য সালিসে স্বামীর কাছ থেকে সাড়ে চার হাজার টাকা আদায় করে দেন মাতবর। সেখান থেকে মাতবর নিয়ে যান দেড় হাজার টাকা।
ইট, লাঠি, বাটাম (কাঠের টুকরা)—হাতের কাছে যা পায়, তা দিয়ে স্বামী বাড়ি মারে।বৈলগাছি গ্রামের এক নারী
মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নারীরা নির্যাতনের ঘটনায় ৭০ শতাংশ ক্ষেত্রে চেয়ারম্যানের কাছে অভিযোগ জানাতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন।
মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধবিজ্ঞান ও পুলিশবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান মুহাম্মদ উমর ফারুক ২০২০ সালে আট বিভাগের ৩৯০ নারীর ওপর গবেষণা করেন। ‘ক্রিমিনাল জাস্টিস সিস্টেম স্ট্যাটাস কো অ্যান্ড রিকমেন্ডেশন ফর ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স ভিকটিম ইন বাংলাদেশ’ (ফৌজদারি বিচার পরিস্থিতি ও বাংলাদেশে পারিবারিক সহিংসতা) শীর্ষক গবেষণায় বলা হয়, শারীরিক, মানসিক, অর্থনৈতিক ও যৌন—এই চার ধরনের পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হন দেশের ৮৭ শতাংশ নারী। এর মধ্যে মাত্র ১ শতাংশ মামলা করেছেন এবং প্রায় ৩ শতাংশ সালিসি বা এনজিওর মাধ্যমে মধ্যস্থতা করেন।
মা, যাইয়ো না। আমি বড় অই। কামাই কইরা তোমাক খিলাব।স্বামীর নির্যাতনের শিকার এক নারীর সন্তান
২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে ‘উইমেন অ্যাকসেস টু জাস্টিস ইন বাংলাদেশ: অ্যাভিনিউস ফর রিফর্ম’ (বাংলাদেশে নারীদের ন্যায়বিচারের সুযোগ: সংস্কারের পথ) শীর্ষক গবেষণা চালায় বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট) ও ইউএন উইমেন। প্রকাশিতব্য প্রতিবেদনটির গবেষক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক তাসলিমা ইয়াসমীন।
প্রতিবেদনে বলা হয়, আইনি কাঠামো থাকলেও সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিক প্রতিবন্ধকতার কারণে তা নারীর সুরক্ষা দিতে পারছে না। লোকলজ্জার মতো সামাজিক সংস্কার, নির্যাতন মেনে নেওয়া, নির্যাতনের ঘটনা প্রকাশ করলে কী প্রতিক্রিয়া হবে, সেই ভয়, অর্থনৈতিক অসাম্য, পুরুষের ওপর সামাজিক ও অর্থনৈতিক নির্ভরশীলতা ও সচেতনতার অভাব নারীর ন্যায়বিচার চাওয়ার ক্ষেত্রে প্রধান বাধা। আর প্রাতিষ্ঠানিক বাধার মধ্যে রয়েছে পুলিশের তাৎক্ষণিক সাড়া না দেওয়া, মামলা করা ও চালানোর নানা ঝক্কি, বিচারপ্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতা এবং আদালতের বাইরে সালিসে বিরোধ মেটানোর চেষ্টা।
মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নারীরা নির্যাতনের ঘটনায় ৭০ শতাংশ ক্ষেত্রে চেয়ারম্যানের কাছে অভিযোগ জানাতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন।
নারী নির্যাতন প্রতিরোধে সরকারের সবচেয়ে বড় প্রকল্প ‘নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধকল্পে মাল্টিসেক্টরাল প্রোগ্রাম (চতুর্থ পর্যায়)’। মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের এ প্রকল্পের আওতায় সচেতনতামূলক কার্যক্রম, হেল্পলাইন, ১৪টি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ওয়ান–স্টপ ক্রাইসিস সেন্টার (ওসিসি) ও জেলা সদর হাসপাতাল ও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ৬৯টি ওয়ান–স্টপ ক্রাইসিস সেলসহ (ওসিসি সেল) ১০টি কার্যক্রম পরিচালিত হয়।
২০০০ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ১৪টি ওসিসিতে ৬২ হাজারের বেশি নারী ও শিশু সহায়তা পেয়েছে। এর মধ্যে শারীরিক নির্যাতনের শিকার হন ৬১ শতাংশ। মামলার হার মাত্র ৩১ শতাংশ।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ওসিসির আইন কর্মকর্তা তাহমিনা নাদিরা প্রথম আলোকে বলেন, স্বামীর হাতেই বেশির ভাগ শারীরিক নির্যাতনের ঘটনা ঘটে। হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে এলে তাঁদের ওসিসিতে পাঠানো হয়। বিবাহবিচ্ছেদ ও সন্তানের ভরণপোষণ না পাওয়ার ভয়ে এবং অর্থের অভাবে মামলা করতে চান না।
কোভিডের পর থেকে ওই প্রকল্পে বাজেট কাটছাঁট চলছে। গত বছর ২৫ শতাংশ পর্যন্ত বরাদ্দ কমানো হয়েছে। এ প্রকল্পের পরিচালক প্রকাশ কান্তি চৌধুরী বলেন, গত ডিসেম্বরে প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়। এরপর কোনো বরাদ্দ ছাড়া ছয় মাস মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। নারী ও শিশুদের সুরক্ষায় প্রকল্পটিকে সংশোধন করে জুলাই থেকে দুই বছরের জন্য মেয়াদ বাড়ানো হচ্ছে। যেসব উপজেলায় নির্যাতন বেশি, সেসব এলাকায় ওসিসি সেলকে আরও সক্রিয় করা হবে। পারিবারিক সহিংসতা প্রতিরোধ আইনকে আরও পরিচিত ও কার্যকরে উদ্যোগ নেওয়া হবে।
২০০০ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ১৪টি ওসিসিতে ৬২ হাজারের বেশি নারী ও শিশু সহায়তা পেয়েছে। এর মধ্যে শারীরিক নির্যাতনের শিকার হন ৬১ শতাংশ। মামলার হার মাত্র ৩১ শতাংশ।
অধ্যাপক উমর ফারুক মনে করেন, পারিবারিক নির্যাতনকে ‘ব্যক্তিগত সমস্যা’ হিসেবে চিহ্নিত করার মানসিকতা ছাড়তে হবে। পারিবারিক সংস্কৃতি মানবিক দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন হতে হবে। পারিবারিক সহিংসতা প্রতিরোধের আইনটি প্রয়োগের ব্যবস্থা নিতে হবে। বিচারপ্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রতা দূর করতে হবে। নারীকেও নিজের ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার সম্পর্কে সচেতন হতে হবে।
বিচার চাওয়ার মতো পরিবেশ তৈরি না হলে বেলকুচির সাবেক ইউপি সদস্য নারীর মতো টপ টপ করে চোখের পানি ফেলে বলতে হবে, ‘আমার জরা জরা দুখ্খু (দীর্ঘদিনের কষ্ট)। কইতে নিলে খালি কান্না আইসে।’
[প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন প্রথম আলোর সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধি আরিফুল গণি]