গণতন্ত্র ও মানবাধিকার রক্ষায় জোর যুক্তরাষ্ট্রের 

ডোনাল্ড লু
ডোনাল্ড লু

যুক্তরাষ্ট্র গণতন্ত্র, মানবাধিকার, বাক্‌স্বাধীনতা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে অগ্রাধিকার দেয়। পাশাপাশি দেশটি সবার রাজনীতি করার অধিকারের বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ মনে করে। যুক্তরাষ্ট্র অঙ্গীকার করেছে যে কোথাও এসব বিষয়ে সমস্যা দেখা দিলে প্রশ্ন তোলা হবে, প্রয়োজনে পরামর্শ দেওয়া হবে। গতকাল রোববার ঢাকায় সরকারের একাধিক মন্ত্রী এবং জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনায় দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু ওয়াশিংটনের এ বার্তা পুনর্ব্যক্ত করেছেন।

গতকাল পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে বেশ কয়েকটি বৈঠকে সরকারের একাধিক মন্ত্রী ডোনাল্ড লুকে এই বলে আশ্বস্ত করেছেন যে সরকার আগামী নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য করতে চায়। যুক্তরাষ্ট্রের মতো বাংলাদেশেরও প্রত্যাশা, সব বড় দল নির্বাচনে অংশ নেবে। 

দুই দিনের ভারত সফর শেষে ডোনাল্ড লু গত শনিবার রাতে দিল্লি থেকে ঢাকায় পৌঁছান। শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে তিনি ঢাকায় মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসকে নিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনের ইস্কাটনের বাসায় যান।

সেখানে বাংলাদেশসহ এই অঞ্চলের দেশগুলোর দায়িত্বে থাকা মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের গুরুত্বপূর্ণ ওই কূটনীতিকের সম্মানে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর আগ্রহে নৈশভোজের আয়োজন করা হয়। 

সফরের দ্বিতীয় দিনে সকাল থেকে শুরু করে ঢাকা ছাড়ার আগে পর্যন্ত ব্যস্ত সময় কাটান ডোনাল্ড লু। সকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতের মধ্য দিয়ে তাঁর কর্মসূচি শুরু হয়। এরপর তিনি গুলশানে শ্রমিকনেতাদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন। সেখান থেকে তিনি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যান। প্রথমে তিনি মন্ত্রণালয়ে পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেনের সঙ্গে বৈঠক করেন। পরে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন ও পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলমের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন। পরে ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে তাঁর সম্মানে পররাষ্ট্রসচিবের দেওয়া মধ্যাহ্নভোজে যোগ দেন ডোনাল্ড লু। তিনি সেখানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান ও আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন। রাতে তিনি ঢাকায় মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের বাসায় নাগরিক সমাজের কয়েকজন প্রতিনিধির সঙ্গে নৈশভোজে যোগ দেন। 

র‌্যাব নিয়ে আলোচনা ইতিবাচক

ডোনাল্ড লুর বাংলাদেশ সফর ঘিরে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‌্যাব) নিষেধাজ্ঞার বিষয়টিতে অনেকের নজর ছিল। গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে এ নিষেধাজ্ঞা সরকারকে অস্বস্তিতে ফেলেছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন ও পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেনকে পাশে রেখে মন্ত্রণালয়ে যৌথ সংবাদ সম্মেলনে ডোনাল্ড লু বলেছেন, ‘র‌্যাবের নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে দুই পক্ষের মধ্যে ইতিবাচক আলোচনা হয়েছে। আপনারা এ সপ্তাহে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের প্রতিবেদনের দিকে তাকালে দেখবেন, র‌্যাবের হাতে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড কমানোর ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য যে অগ্রগতি হয়েছে তা উঠে এসেছে, আমরাও সেটা দেখতে পেয়েছি। এটা অসাধারণ কাজ। এটা প্রমাণ করে যে মানবাধিকারের প্রতি সম্মান রেখেও র‌্যাব সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় কাজ করতে পারে।’

গণতন্ত্র ও মানবাধিকারে গুরুত্ব

গতকাল দুপুরে যৌথ সংবাদ সম্মেলনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী, পররাষ্ট্রসচিব এবং সহকারী মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী তাঁদের আলোচনাকে ‘খোলামেলা’ আর ‘খুব আন্তরিক’ হিসেবে অভিহিত করেন। 

বক্তৃতার শুরুতেই ডোনাল্ড লু বাংলায় বলেন, ‘মনোমুগ্ধকর নদী বা সৈকত এবং অতিথিপরায়ণ মানুষের দেশ বাংলাদেশে ফিরে আসতে পেরে আমি আনন্দিত। আমি এখানে এসেছি আমাদের দুই দেশের বন্ধুত্বকে শক্তিশালী করতে, যখন বর্তমান বিশ্ব শান্তি ও নির্বাচনের জন্য সংগ্রাম করে চলেছে।’

গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের প্রতি ওয়াশিংটনের অবস্থানের প্রসঙ্গ টেনে ডোনাল্ড লু বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র গণতন্ত্র ও মানবাধিকার সুরক্ষার বিষয়ে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। কোথাও কোনো সমস্যা দেখলে আমরা কথা বলব ও কোথাও পরামর্শ দেওয়ার থাকলে আমরা দেব; বাক্‌স্বাধীনতা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার পক্ষে আমরা দাঁড়াব। বাংলাদেশে আমাদের অংশীদারদের সঙ্গে নিবিড়ভাবে কাজ করতে চাই।’

পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন বলেন, ‘আমাদের মধ্যে যদি কোনো ধরনের কোনো প্রশ্ন থাকে, সেগুলো আমরা আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করব। আমরা পরামর্শ পেলে অবশ্যই গ্রহণ করি, আমরা তার নমুনাও দেখিয়েছি। আমাদের কোথাও যদি কোনো দুর্বলতা থাকে, আমরা সেগুলো আমলে নিয়ে সমাধানের চেষ্টা করব।’

নির্বাচনের প্রসঙ্গ টেনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘সরকার অবাধ, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন চায়। আমার দল আওয়ামী লীগ সব সময় গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ক্ষমতায় এসেছে।’

ডোনাল্ড লুর আলোচনায় যে নির্বাচন এবং রাজনীতির প্রসঙ্গ এসেছে, সেটি বিকেলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানও সাংবাদিকদের বলেছেন। তিনি বিকেলে ডোনাল্ড লুর সঙ্গে আলোচনার পর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে বলেন, ‘১০ ডিসেম্বর আমরা শান্তিপূর্ণভাবে তাদের (বিএনপি) সমাবেশের ব্যবস্থা করে দিয়েছি। এ জন্য তারা (যুক্তরাষ্ট্র) খুশি। তারা (যুক্তরাষ্ট্র) বলেছে, সবার রাজনীতি করার অধিকার আছে। আমরা বলেছি, আমরা সেটা মানি। সে জন্য তারা (বিএনপি) শান্তিপূর্ণভাবে কর্মসূচি করছে। সেগুলোতে আমাদের কোনো বাধা নেই।’

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আরও বলেন, ‘তারা (বিএনপি) যদি জনগণের সম্পদ নষ্ট করে, প্রকাশ্যে গুলি করে কিংবা রাস্তাঘাট বন্ধ করে, তখন আমরা তাদের নিষেধ করি।’ তিনি জানান, প্রধানমন্ত্রী যে সুষ্ঠু নির্বাচন চান, সেটা সহকারী মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে তুলে ধরা হয়েছে।

গতকাল রোববার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেছেন দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু

শ্রম অধিকারের উন্নতি প্রয়োজন

যৌথ সংবাদ সম্মেলনে পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেন বলেন, ‘ডোনাল্ড লুর সঙ্গে বাণিজ্য থেকে শুরু করে বিনিয়োগ, শ্রম অধিকার, নিষেধাজ্ঞা, মানবাধিকার, গণতন্ত্র থেকে উন্নয়নের পাশাপাশি ইন্দো-প্যাসিফিকের বিষয়ে আমাদের মত নিয়ে পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে সুস্পষ্ট ও খোলামেলা আলোচনা করেছি।’

ডোনাল্ড লু বলেন, বাংলাদেশে শ্রম অধিকার পরিস্থিতির উন্নতিতে তাঁর দেশ সহযোগিতা করতে পারে। এ ক্ষেত্রে উন্নতির সুযোগ রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের জিএসপি পুনর্বহালের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘জিএসপি অনুমোদনের জন্য এখনো কংগ্রেসের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় আছে তাঁর সরকার। আমরা এটা নিয়ে নিবিড়ভাবে কাজ করছি। যখন এটা অনুমোদন পাবে, তখন বাংলাদেশই তালিকায় প্রথম স্থানে থাকবে।’

যুক্তরাষ্ট্রের উদ্যোগে নেওয়া কৌশলগত উদ্যোগ ভারত–প্রশান্ত মহাসাগরীয় কৌশল (আইপিএস) নিয়ে আলোচনার কথা জানিয়ে লু বলেন, ‘আইপিএস নিয়ে চমৎকার আলোচনা হয়েছে। এটা আসলে একটা কৌশল, কোনো ক্লাব নয়।’

রাষ্ট্রদূতের বাসায় নৈশভোজ

বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়ে অংশগ্রহণমূলক হবে, এমনটা প্রত্যাশা করে যুক্তরাষ্ট্র। তবে বাইরের কারও চাপ কিংবা প্রভাবে নয়, বাংলাদেশের জনগণই তা নির্ধারণ করবে। গতকাল রাতে মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের বাসায় নাগরিক সমাজের কয়েকজন প্রতিনিধির সঙ্গে নৈশভোজের সময় ডোনাল্ড লু বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন নিয়ে এ মন্তব্য করেন।

নৈশভোজে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হোসেন জিল্লুর রহমান, নারীনেত্রী শিরিন হক, আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক নুর খান এবং অভিবাসন বিশেষজ্ঞ তাসনিম সিদ্দিক অংশ নেন।