যুক্তরাজ্যের বিখ্যাত গ্রাফিতি শিল্পী ব্যাঙ্কসি একদা বলেছিলেন, ‘আপনার কাছে যদি লড়াইয়ের কোনো হাতিয়ারই না থাকে, তবে গ্রাফিতি হয়ে উঠতে পারে একমাত্র অস্ত্র।’ চট্টগ্রাম শহরের দেয়ালগুলো যেন এখন বাঙ্কসির ভাষায় ‘সেই অস্ত্রে’ শাণিত এক বিপ্লবগাথাই হয়ে উঠেছে। এক উত্তাল গণ-আন্দোলনের সাক্ষী। হয়ে উঠেছে উন্মুক্ত গ্যালারি।
কোটা সংস্কার থেকে এক দফা অর্থাৎ শেখ হাসিনা সরকারের পদত্যাগ পর্যন্ত কয়েক সপ্তাহের রক্তাক্ত অভ্যুত্থানের ইতিহাস এই দেয়াল। হত্যা ও প্রতিরোধ, আশাবাদ ও সংকল্প—কী নেই সেখানে। যখন আক্ষরিক অর্থেই কেউ কথা বলতে পারছিল না, ইন্টারনেট ব্ল্যাকআউট হয়েছে, ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে লোকজনকে, ভয়ভীতির সেই সময় সাহস জুগিয়েছে দেয়াল।
বিষয়টা বুঝতে শিল্পী রাজীব দত্তের একটা অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করতে হয়। তার আগে বলে নিই, অনেক কাল ধরেই রাজীব স্ট্রিট আর্ট আর গ্রাফিতির সঙ্গে যুক্ত।
সাম্প্রতিক সময়ে দেয়ালে আঁকা গ্রাফিতি নিয়ে আলাপের একপর্যায়ে রাজীব বলেছিলেন, চট্টগ্রামের আনোয়ারা এলাকার একটি দেয়ালে তিনি দেখতে পান, ‘খুনি হাসিনা’ লেখা রয়েছে। এর পরের শব্দটি অসমাপ্ত। অর্থাৎ যা লিখতে চেয়েছেন, তা লেখার আগেই পালাতে হয়েছে গ্রাফিতি আঁকিয়েকে।
রাজীবের ভাষায়, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে চটজলদি এমন প্রতিবাদই দেয়ালগুলোকে লড়াইয়ের ক্ষেত্র করে তুলেছে। চট্টগ্রামের দেয়ালগুলো এখন সেই উত্তাল সময়ের সাক্ষী হয়ে আছে।
চট্টগ্রামের অলিগলি-রাজপথে এখন আবু সাঈদ, মুগ্ধর ছবির পাশাপাশি শোভা পাচ্ছে বিভিন্ন স্লোগান। জামালখান, চেরাগী পাহাড়, প্রবর্তক মোড়, চট্টগ্রাম কলেজ, চকবাজার, লালখান বাজার, বহদ্দারহাটের দেয়ালগুলো যেন নতুন দিনের ইশতেহার হয়ে উঠেছে। ‘স্বাধীনতা এনেছি যখন, সংস্কার করি’, ‘ইতিহাসের নতুন অধ্যায় জুলাই ২৪’, ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো জুলাই’, ‘আমাদের দেশের ভাগ্য আমরা পরিবর্তন করব’, ‘আমাদের দেশ আমাদেরই গড়ে নিতে হবে, পিণ্ডির গোলামি ছেড়ে দিতে হবে’, ‘ভাই কারও পানি লাগবে, পানি...,’ এমন স্লোগানের পাশাপাশি লেখা হয়েছে অধিকারের কথাও। ‘বাংলার হিন্দু, বাংলার বৌদ্ধ, বাংলার খ্রিষ্টান, বাংলার আদিবাসী সুরক্ষার দায়িত্ব সবার’ দেয়ালে গ্রথিত এমন স্লোগানই বলে দেয় কেমন বাংলাদেশ প্রত্যাশা করে এ প্রজন্ম। একটা সমন্বয়ের সমাজের ছবিই যেন উঠে এসেছে দেয়ালগুলোতে। বৈষম্য থাকবে না, ধর্ম-বর্ণের ভেদাভেদ থাকবে না, কথা বলা যাবে নির্ভয়ে, তেমন বাংলাদেশের জন্যই তো লড়ে গেছেন আবু সাঈদ, হৃদয় তাড়ুয়া আর মুগ্ধরা।
যখন আক্ষরিক অর্থেই কেউ কথা বলতে পারছিল না, ইন্টারনেট ব্ল্যাকআউট হয়েছে, ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে লোকজনকে, ভয়ভীতির সেই সময় সাহস জুগিয়েছে দেয়াল।
আবারও ফিরে আসি ব্যাঙ্কসির কথায়। জীবন্ত কিংবদন্তি এই শিল্পী বলেছেন, ‘পৃথিবীর দারিদ্র্য দূর করার ক্ষমতা আপনার নেই। কিন্তু যে ছবি আপনি দেয়ালে হাজির করলেন, তা অন্তত প্রস্রাব করতে আসা একজন লোককে হাসাতে পারবে।’ এই কথার তাৎপর্য নিয়ে ভাবতে গেলে অনেক ছবিই মাথায় আসে। তবে মোদ্দাকথা হলো, গ্রাফিতি যে ক্ষমতাহীন লোকের মোক্ষম রাজনৈতিক হাতিয়ার, তা পরিষ্কার হয়। শিল্পী রাজীব দত্তের ভাষায়, আইন যত কঠোরভাবে সেন্সরশিপ দিয়ে মানুষের কণ্ঠ রুদ্ধ করেছে, গ্রাফিতি ততই বেড়েছে। তাঁর কাছ থেকে জানা গেল, ১৯৯৫-৯৬ সালের দিকে এ দেশে প্রথম গ্রাফিতি লেখেন আইজুদ্দিন নামের এক ব্যক্তি। ‘কষ্টে আছে আইজুদ্দিন’ ঢাকার দেয়াল থেকে গণমানুষের মনের কথা হয়ে উঠেছিল। দেয়ালে দেয়ালে দাবিনামার সঙ্গে তখন মানুষ আইজুদ্দিনের নাম জুড়ে দিত। ‘বেকারদের চাকরি দাও’, এমন দাবির পরিশেষে লেখা হলো ‘কষ্টে আছে আইজুদ্দিন’। শোনা যায়, আইজুদ্দিন রিকশাচালক ছিলেন। তাঁর মনের দুঃখ দেয়ালে বাড়ি খেয়ে এভাবে সাধারণ মানুষের কষ্টের ভাষায় পরিণত হলো। অর্থাৎ গ্রাফিতি গণমানুষের মনের কথা হয়ে ওঠে বা মনের কথাই বলে। ২০১৭ সালের দিকে ‘হবেকি’ নাম গ্রাফিতি শিল্পী বা শিল্পীরা জন্ম দিলেন সুবোধ সিরিজের। একটা খাঁচায় বন্দী সূর্য নিয়ে আলুথালু চুলের এক তরুণ পালিয়ে যাচ্ছে কোথাও। স্ট্যানসিলে আঁকা এই ছবির পাশে লেখা হলো, ‘সুবোধ তুই পালিয়ে যা, সময় এখন পক্ষে না’। আবির্ভাবের পরপরই আলোচনায় এসেছিল সুবোধ। প্রথম আলোয় সেই সময় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনের শিরোনাম হয়েছিল, ‘সুবোধ কেন পালাচ্ছে’। এরপর সময় যতই প্রতিকূল হয়েছে, সুবোধ হাজির হয়েছে দেয়ালে। ‘সুবোধ কবে ভোর হবে’ এমন প্রশ্নে সবাক হয়েছে ঢাকার দেয়াল।
২০১৮ সালের কোটা আন্দোলন, নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের পর দেশে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ওপর হাসিনা সরকারের খড়্গ নেমে আসে। কার্টুনিস্ট আহমেদ কবির কিশোর, লেখক মুশতাক আহমেদ ও রাষ্ট্রচিন্তার কর্মী দিদারুল ভূঁইয়ার গ্রেপ্তার–নির্যাতন ছিল স্বৈরাচারী সরকারের দমননীতির একটা বার্তা। পরিষ্কারভাবে এই বার্তা ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল যে কথা বলা যাবে না। এর মধ্যে পুলিশের হেফাজতে মারাই গেলেন লেখক মুশতাক আহমেদ। ঢাকার দেয়ালে তখন কার্টুনিস্ট কিশোরের ছবির পাশে গ্রাফিতিতে লেখা হলো, ‘কায়দা করে বেঁচে থাক’।
২০২৪ সালের কোটা আন্দোলনের শুরুর দিকে সরকারের বিপক্ষে কোনো মতামত দেওয়াই ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। তখন দেয়ালই একমাত্র বলতে লাগল, ‘হাসিনা স্বৈরাচারী’, ‘হাসিনা খুনি’। সরকারদলীয় ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগের বর্বরতার কথা উঠে এসেছিল কেবল দুটো শব্দে, ‘সহমত ভাই’। বুয়েটে আবরার হত্যা, গণরুমের অত্যাচার, জোর করে মিছিলে নেওয়া, সালাম দিতে বাধ্য করাসহ অনেক কথাই মনে করিয়ে দিল এই ‘সহমত ভাই’।
হাসিনার সময়কালের ও হাসিনা পরবর্তী—এই দুই পর্বের ইতিহাসই চট্টগ্রামের দেয়ালে গ্রথিত আছে। চরম স্বৈরাচারী নিপীড়নের সময় স্প্রে পেইন্ট ব্যবহার করেই আঁকা হয়েছে গ্রাফিতি। তাতে শৈল্পিক সুষমার চেয়েও কথা বলার বিষয়টাই প্রাধান্য পেয়েছিল। দেয়ালে দেয়ালে লেখা হলো ‘খুনি হাসিনা’, ‘স্বৈরাচারী হাসিনা’ শব্দগুলো। দেয়ালগুলো গালিগালাজেও ভরে উঠেছিল। তবে গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে দেয়ালগুলো রঙিন আর আশাবাদের কথায় ভরা। যাঁরা কী হয়েছে, কিছুই জানতেন না, যাঁরা দেশে ছিলেন না সেই সময়, তাঁদের জন্য এই দেয়ালগুলো অবশ্য দ্রষ্টব্য। দেয়ালের দিকে তাকালেই তাঁরা একটা সময়কে বুঝতে পারবেন। কোনো লিখিত ইতিহাসের চেয়েও এই দুই পর্বের ইতিহাস অনেক সঠিক বাস্তবতা তুলে ধরবে, তাতে সন্দেহ কী।