বাংলাদেশে ২০১৯ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত বেশ কয়েকটি ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাব পড়েছে। এর মধ্যে ভয়ংকর ‘ফণীর’ প্রভাব যেমন রয়েছে তেমনি রয়েছে অপেক্ষাকৃত কম শক্তিশালী ‘জাওয়াদের’ প্রভাবও।
বিগত চার বছরে যে ঝড়গুলো বাংলাদেশে আঘাত হেনেছে সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল ফণী, আম্পান, ইয়াস। এসব ঝড়ে প্রাণহানীর ঘটনা ঘটেছে তেমনি ক্ষতি হয়েছে ফসলেরও। এসব ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই সর্বশেষ গতকাল সোমবার আঘাত হেনেছে সিত্রাং।
ঘূর্ণিঝড় ফণী অপেক্ষাকৃত দুর্বল অবস্থায় ঘণ্টায় ৭০ কিলোমিটার গতির শক্তি নিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছিল। ২০১৯ সালের মাসে এ ঝড়ের পর সরকারের পক্ষ থেকে এ নিয়ে হালনাগাদ তথ্য প্রকাশ করা হয়েছিল। সেই সময় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় জানিয়েছিল, ঘূর্ণিঝড় ফণীতে ৬৩ হাজার ৬৩ হেক্টর ফসলি জমি আক্রান্ত হয়েছে। তবে ক্ষতিগ্রস্ত ফসলি জমির পরিমাণ ১ হাজার ৮০৪ হেক্টর।
ওই ঝড়ে ২ হাজার ৩৬৩টি ঘরবাড়ি সম্পূর্ণ এবং ১৮ হাজার ৬৭০টি আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পানি উন্নয়ন বোর্ডের ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধের পরিমাণ চিল ২১ দশমিক ৯৫ কিলোমিটার। এ ছাড়া ৩৬টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছিল।
ফণীর প্রভাবে ভোলা, নোয়াখালী ও লক্ষ্মীপুরে একজন করে এবং বরগুনায় দুজনসহ মোট পাঁচজন নিহত হয়। আর পটুয়াখালীতে ১৬৫টি গবাদিপশু নিখোঁজ হয়, যার অনেকগুলো পরে পাওয়া যায়।
আবহাওয়া অধিদপ্তর ও ঘূর্ণিঝড়বিষয়ক বিশ্বব্যাংকের একটি গবেষণায় বলা হয়েছিল, বিগত ৫২ বছরে দেশে যতগুলো ঘূর্ণিঝড় আঘাত হেনেছে, তার মধ্যে ফণীর স্থায়িত্ব ও বিস্তৃতি ছিল সবচেয়ে বেশি।
ফণীর আগে বাংলাদেশে আঘাত হানা আগের ঝড়গুলোর বিস্তৃতি ছিল বড়জোর দেশের ৫০ থেকে ৬০ ভাগ এলাকায়। এগুলোর স্থায়িত্বকাল ছিল ২ থেকে ৫ ঘণ্টা। কিন্তু ফণী প্রায় ১২ ঘণ্টা বাংলাদেশে ঘূর্ণিঝড় ও নিম্নচাপ আকারে অবস্থান করে।
এই ঝড়ে বাংলাদেশ যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল তেমনি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল ভারতও। ২০১৯ সালের মে মাসে আঘাত হেনেছিল ফণী। ওই সময় ভারতের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, বিগত ৪০ বছরে এমন ঝড় দেখেনি তারা।
ফণীর ধাক্কা কাটিয়ে না উঠতেই ওই বছরের নভেম্বরে বাংলাদেশের উপকূলে আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় বুলবুল। আক্রান্ত হয় বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, খুলনা, পটুয়াখালী, ভোলা, বরিশাল, বরগুনা, পিরোজপুর, ঝালকাঠি, চাঁদপুর, চট্টগ্রাম, ফেনী, লক্ষ্মীপুর, নোয়াখালীর ২০ লাখ মানুষ। এই ঝড়ে প্রাণ হারায় কমপক্ষে ১৭ জন। ফসলের খেত আক্রান্ত হয় প্রায় ২ লাখ ৮৯ হাজার হেক্টর। এর মধ্য ২ থেকে ৫ শতাংশ ফসল নষ্ট হয়। মাছ নষ্ট হয় প্রায় ৪৭ কোটি টাকার।
‘বুলবুলে’ ক্ষতিগ্রস্ত জেলাগুলোর অন্যতম ছিল সাতক্ষীরা। ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের আঘাতে শুধু সাতক্ষীরায় প্রায় ১৭ হাজার কাঁচা ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে এবং ৩৫ হাজার আংশিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। জলোচ্ছ্বাসে ভেসে গেছে ৫ হাজার ১৪টি চিংড়িঘের। একই রকম চিত্র ছিল বাকি জেলাগুলোরও।
করোনাভাইরাসের মহামারিতে যখন দেশ সংকটে তখন আঘাত হানে আম্পান। উত্তর থেকে দক্ষিণ— পুরো দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয় এই ঘূর্ণিঝড়ে।
ঝড়ের পর সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের দেওয়া ক্ষতির হিসাব অনুসারে, ২৬টি জেলার মোট ১ হাজার ১০০ কোটি টাকার সম্পদের ক্ষতি হয় আম্পানে। ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় ২০০টি সেতু ও কালভার্ট। ১৩ জেলার ৮৪টি পয়েন্টে বাঁধ ভেঙে যায়। এসব ভাঙা বাঁধের মোট দৈর্ঘ্য ৭.৫ কিলোমিটার। আম্পানে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় ফসলের খেত। ১ লাখ ৭৬ হাজার হেক্টর জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর মধ্যে ১৭ জেলায় ৪৭ হাজার হেক্টর বোরো ধানের খেত ও ৭ হাজার ৩৮৪ হেক্টর আমবাগান ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
২০২০ সালের মে মাসের এই ঝড় বাংলাদেশের ভূখণ্ডে প্রায় ২৮ ঘণ্টা ধরে তাণ্ডব চালায়। এতে দেশের ছয় জেলায় ২১ জন মারা যায়। ঝড়ের পর থেকে বিস্তীর্ণ এলাকা বিদ্যুৎহীন হয়ে পড়ে। আম্পানের কারণে দেশের দক্ষিণ, পশ্চিম ও উত্তরের ২৫ জেলার দেড় কোটি গ্রাহক ঝড়ের আগেই বিদ্যুৎহীন হয়ে পড়েন। এসব জেলার বেশির ভাগ স্থানে ঝড় শুরু হওয়ার ১২ থেকে ২৪ ঘণ্টা আগেই বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দেয় বিদ্যুৎ বিতরণ সংস্থাগুলো।
ঝড়ের পর আবহাওয়া অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্য অনুসারে, ১৯৬০ থেকে ২০২০ পর্যন্ত যে কটি ঘূর্ণিঝড়ের তথ্য রয়েছে, তাতে ঘূর্ণিঝড় আম্পান সবচেয়ে দীর্ঘ সময় ও বিস্তীর্ণ এলাকা ধরে তাণ্ডব চালিয়েছিল। এই সময় গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল অ্যান্ড জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (সিইজিআইএস) নির্বাহী পরিচালক মালিক ফিদা আবদুল্লাহ খান মন্তব্য করেছিলেন, ‘এত দিন ধরে আমরা ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাব এলাকা বলতে উপকূলকে বুঝতাম। সে অনুযায়ী আমরা প্রস্তুতি নিতাম। আমাদের ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচির স্বেচ্ছাসেবকেরাও সব উপকূলীয় জেলার। কিন্তু আম্পান আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল যে ঘূর্ণিঝড়ের বিপদ থেকে দেশের কোনো এলাকাই মুক্ত না। ফলে সারা দেশেই এ জন্য আমাদের প্রস্তুতি রাখতে হবে।’
ঘূর্ণিঝড় ইয়াস মূলত আঘাত হেনেছিল ভারতের ওডিশায়। ২০২১ সালের ২৬ মে এই ঝড় আঘাত হানে বাংলাদেশে। এর প্রভাবে দেশের উপকূলীয় এলাকায় স্বাভাবিকের চেয়ে কয়েক ফুট বেশি উঁচু জোয়ার হয়েছিল। এতে দেশের ১ লাখ ২০ হাজার ৭১২টি পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পাকা, আধা পাকা ও কাঁচা ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয় ৫৩ হাজার ৪৩৪টি। শস্যখেতের ক্ষতি হয় ৮ হাজার ৬২ হেক্টর, ১ হাজার ১২৭ হেক্টর বীজতলা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। হ্যাচারি, মৎস্য ও চিংড়িঘের ক্ষতিগ্রস্ত হয় ২ হাজার ১৯৯ দশমিক ১৮ হেক্টর। এ ছাড়া উপকূলীয় এলাকায় মোট ৫ হাজার ৬২৭ দশমিক ১৯ কিলোমিটার বাঁধের ক্ষতি হয়।
ঝড়ের পর মাঠপর্যায় থেকে তথ্য নিয়ে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ হিসাব করে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় জানিয়েছিল, মোট ২ হাজার ৯৫১ কোটি ৭০ লাখ ৩০ হাজার ৬২৭ টাকার ক্ষতি হয়েছে।
ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে বাংলাদেশের ১৫টি জেলার ৭৭টি উপজেলা ও ১৩টি পৌরসভায় ক্ষয়ক্ষতি হয়, মৃত্যু হয় ৭ জনের। ঝড়ের পর এলাকা পরিদর্শনে গিয়ে স্থানীয়দের তোপের মুখেও পড়েছিলেন একাধিক সাংসদ। এরপর ওই বছরের জুন মাসে জাতীয় সংসদের বাজেট অধিবেশনে বাঁধের দাবিতে গলায় প্ল্যাকার্ড ঝুলিয়ে বক্তব্য দেন পটুয়াখালী-৩ (গলাচিপা-দশমিনা) আসনের আওয়ামী লীগের সাংসদ এস এম শাহজাদা। তাঁর প্ল্যাকার্ডে লেখা ছিল, ‘আর কোনো দাবি নাই, ত্রাণ চাই না বাঁধ চাই’।
২০২১ সালে ডিসেম্বরে ঘূর্ণিঝড় জাওয়াদের প্রভাবে বরিশাল বিভাগসহ চাঁদপুর, কুমিল্লা, ফরিদপুর ও মানিকগঞ্জের বিস্তীর্ণ ফসলের খেত ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ঝড়ের পর বরিশালের বিভাগীয় কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ জানায়, ২৫ হাজার হেক্টর আমনের খেত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ ছাড়া প্রায় ২৬ হাজার হেক্টর খেসারির খেত, ৭ হাজার ৫০০ হেক্টরের শীতকালীন শাকসবজি, ২ হাজার ১৫৬ হেক্টরের শর্ষে, ৫৭৩ হেক্টরের মসুর ডাল, ২০৩ হেক্টরের গম, ২৮৮ হেক্টরের আলু ও ৩২ হেক্টরের আগাম তরমুজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
ফরিদপুরের ৯টি উপজেলার ৬৬ হাজার ১৮৪ হেক্টর জমির মধ্যে ১৯ হাজার ৭০১ হেক্টর জমির ফসল বৃষ্টির পানিতে তলিয়ে গেছে, যা মোট জমির ২৯ দশমিক ৭৬ শতাংশ। আর চাঁদপুরের প্রায় ১ হাজার ৩৫০ হেক্টর জমির ফসল পানিতে তলিয়ে গেছে।
সোমবার সন্ধ্যায় ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ডে প্রবেশ করেছে। ঝড়ের কারণে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও বরিশাল বিভাগের বেশির ভাগ এলাকাজুড়ে ঝোড়ো বাতাস ও ভারী বৃষ্টি হয়। উপকূলের ১৫টি জেলার নদ-নদীর পানি স্বাভাবিকের চেয়ে ৩ থেকে ৫ ফুট উচ্চতা নিয়ে আছড়ে পড়ে।
এই ঝড়ে এ পর্যন্ত নয়জন প্রাণ হারিয়েছেন। এর মধ্যে কুমিল্লায় তিনজন, ভোলায় দুজন, সিরাজগঞ্জে দুজন, নড়াইল ও বরগুনায় একজন নিহত হওয়ার খবর পাওয়া যায়। পরিস্থিতির কারণে আজ মঙ্গলবার খুলনা, বরিশাল ও চট্টগ্রাম বিভাগের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার ঘোষণা দিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, সোমবার রাত সাড়ে নয়টায় কক্সবাজার ও চট্টগ্রামে বাতাসের গতিবেগ ছিল সবচেয়ে বেশি—ঘণ্টায় ৭৪ কিলোমিটার। এ ছাড়া বরিশাল ও চট্টগ্রাম বিভাগের বিভিন্ন স্থানে নদ-নদীর পানি স্বাভাবিকের চেয়ে ৩ থেকে ৪ ফুট উচ্চতায় আছড়ে পড়ে। তবে বাতাসের গতিবেগ কম থাকায় জলোচ্ছ্বাসের গতিবেগও ছিল কম। তবে এই ঝড়ে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ কত, তা এখনো জানা যায়নি।