সালিম আলীর সঙ্গে ১৯৮২ সালে তাঁর ৮৬তম জন্মদিনে ভারতের বোম্বের বোরিভালি জাতীয় উদ্যানে (বর্তমানে সঞ্জয় গান্ধী জাতীয় উদ্যান) লেখক
সালিম আলীর সঙ্গে ১৯৮২ সালে তাঁর ৮৬তম জন্মদিনে ভারতের বোম্বের বোরিভালি জাতীয় উদ্যানে (বর্তমানে সঞ্জয় গান্ধী জাতীয় উদ্যান) লেখক

আমার শিক্ষক সালিম আলী

আজ আমার শিক্ষক ড. সালিম আলীর ১২৮তম জন্মদিন। ৩৮ বছর আগে, ১৯৮৬ সালের কোনো এক বিকেলে সালিম আলী আমার পিএইচডির মৌখিক পরীক্ষার জন্য আমাকে নিয়ে বোম্বে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ভবনে যাচ্ছেন। একজন তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন, কোথায় যাচ্ছি? তিনি উত্তর দিলেন, ‘আজ আনোয়ারকে ছিন্নবিচ্ছিন্ন করতে নিয়ে যাচ্ছি।’ তাঁর অসাধারণ রসবোধ দিয়ে আমার দুশ্চিন্তার পারদ কিছুটা নামানোর চেষ্টা করলেন, বুঝতে পারলাম। সেই দুর্লভ মুহূর্ত আমাকে আজও উজ্জীবিত করে।

আমার গবেষণার বিষয়বস্তু ছিল হিমালয় ও দক্ষিণ ভারতের পশ্চিমঘাট পর্বতমালার কোডাইকানাল ও নীলগিরি পাহাড়ের ‘লাফিং থ্রাস’ নামের পাখির জীবনবৃত্তান্ত ও এদের পরিবেশ পর্যবেক্ষণ করা। ১৯৮২ সালে প্রথম যেদিন দেখা হলো, তিনি বললেন, ‘আমার বয়স এখন প্রায় ৮৬ বছর, নইলে কাজটা আমি নিজেই করতাম।’ বুঝেই নিলাম, কী বার্তা তিনি দিলেন। প্রতি মাসের প্রথম সপ্তাহে গত মাসের ফিল্ড রিপোর্ট পৌঁছাতে বিলম্ব হলেই একটি পোস্টকার্ড এসে হাজির হতো, ‘আনোয়ার, আশা করি ভালো আছ এবং তোমার কাজ ঠিকমতো চলছে।’

আমি যখন তাঁর অধীন পিএইচডি ডিগ্রির জন্য গবেষণাকাজ শুরু করি, তিনি তখন ভারতের জাতীয় অধ্যাপক ও বোম্বে ন্যাচারাল হিস্ট্রি সোসাইটির সভাপতি। ভারতের মানুষের কাছে তিনি ‘বার্ডম্যান’ হিসেবেই বেশি পরিচিত। ভারতের বন, বন্য প্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণ আজ যে উচ্চতায় পৌঁছেছে, তার পেছনে যে মানুষটির অবদান অধিক স্বীকৃত, তিনি সালিম আলী। একজন মানুষ কীভাবে ওই বয়সেও এতটা নিখুঁত ও ত্রুটিহীনভাবে প্রতিটি কাজ সম্পন্ন করতেন, এটি প্রত্যক্ষ করতেও আতঙ্কিত হতাম। মেনে চলার দুঃসাহস করতেই হয়েছে আমাকে এবং আমার বিশ্বাস তাঁর মাপকাঠিতে পাসও করতে পেরেছিলাম।

আমার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আলী রেজা খানের সুপারিশে সালিম আলী যখন আমাকে ছাত্র হিসেবে গ্রহণ করতে সম্মত হলেন, আমি তখন যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডিসিতে ইউনেসকোর ফেলোশিপ নিয়ে সেখানকার জাতীয় প্রাকৃতিক ইতিহাস জাদুঘরে ইন্টার্ন হিসেবে কাজ করছি। দেশে ফিরে সরকারি চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে আমার পিতার উৎসাহে সালিম আলীর সান্নিধ্যে চলে গেলাম। আলী রেজা খান ছিলেন সালিম আলীর প্রথম বাংলাদেশি ছাত্র। আলী রেজা খানের জন্য সালিম আলীর কাছে সুপারিশ করেছিলেন আমাদের শিক্ষক অধ্যাপক কাজী জাকের হোসেন, কী অসম্ভব সুন্দর এক পরম্পরা।

সালিম আলী পাখির ওপর উচ্চতর গবেষণার জন্য বোম্বে ন্যাচারাল হিস্ট্রি সোসাইটিতে ১৯৬৫ সালে নিজ উদ্যোগে তাঁর ও সিঙ্গাপুরের পাখি সংরক্ষণে উৎসাহী প্রয়াত বন্ধুর নামে ‘সালিম আলী–লোক ওয়ান থো পাখি গবেষণা তহবিল’ গঠন করেন। আমি এই তহবিল থেকেই গবেষণাকাজের জন্য অর্থ পেয়েছি।

কাক ও ভুবনচিলের প্রজনন বিষয়ে বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ দিয়ে ১৯২৬ সালে সালিম আলীর লেখালেখি শুরু হয়। তবে ১৯৪১ সালে প্রকাশিত দ্য বুক অব ইন্ডিয়ান বার্ডস পুস্তকটি তাঁকে ভারতের প্রাকৃতিক ইতিহাসজগতের প্রাণপুরুষ করেছে। ১৯৬৮-৭৪ পর্যন্ত তাঁর ও বন্ধু ডিলন রিপলির লেখা অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেসে ছাপা ১০ খণ্ডের হ্যান্ডবুক অব দ্য বার্ডস অব ইন্ডিয়া অ্যান্ড পাকিস্তান এই উপমহাদেশে পাখিবিষয়ক সবচেয়ে উঁচু মানের গ্রন্থ হিসেবে বিবেচিত হয়।

ভারতের সরকার ও জনগণ তথা ভারতবর্ষ ও আন্তর্জাতিক মহল তাঁকে বহুভাবে সম্মানিত করেছেন। কোনো কোনোটি গ্রহণ করতে যেতেও পারেননি কাজ ফেলে। ১৯৭৬ সালে ‘জে পল গেটি অ্যাওয়ার্ড’ তাঁর পক্ষে যুক্তরাষ্ট্রে ভারতের সম্মানিত রাষ্ট্রদূত গ্রহণ করেছিলেন। কারণ, তিনি তখন হিমালয় পর্বতমালায় পাখি দেখতে ব্যস্ত। বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটির স্বর্ণপদকটিও নিতে আসতে পারেননি, যেটি পরে নয়াদিল্লিতে বাংলাদেশের হাইকমিশনার তাঁকে হস্তান্তর করেন। ভারতবর্ষের কোথাও না কোথাও আজও ড. সালিম আলীকে গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করা হয়।

আমার সঙ্গে দেখা হওয়ার পর থেকেই দেখলাম, আত্মজীবনী লেখার কাজে হাত দিয়েছেন। এটি সম্ভবত তাঁর জীবনের সবচেয়ে কঠিন কাজ ছিল। প্রায়ই জিজ্ঞাসা করতাম—কত দূর হলো, স্যার? বলতেন, ‘দোয়া করো, ও আমাকে শেষ করবার আগে আমি যেন ওকে সমাপ্ত করতে পারি।’ অবশেষে ১৯৮৫ সালে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস এটি প্রকাশ করল এবং সালিম আলী ৬ সেপ্টেম্বর ১৯৮৫ সালে তাঁর মুক্তার মতো হাতের লেখা শুভকামনা নোটসহ উপহার হিসেবে দ্য ফল অব আ স্প্যারো বইটি আমাকে পাঠালেন।

আমি সালিম আলীর শেষ ছাত্র ছিলাম। তিনি দক্ষিণ ভারতের পাহাড়ে আমার কাজ দেখতে গেছেন। হিমালয় পর্বতে নিজে আমাকে নিয়ে গেছেন, এক বিছানায় দুজন রাত কাটিয়েছি, বনে–জঙ্গলে আমাকে সময় দিয়েছেন। বন বিভাগের সব পর্যায়ের বনকর্মীকে অনুরোধ করেছেন আমাকে সাহায্য করার জন্য।

আমি ১৯৮৬ সালে সালিম আলীর তত্ত্বাবধানে পিএইচডি ডিগ্রি শেষ করি। তিনি ১৯৮৭ সালের ২০ জুন ৯১ বছর বয়সে আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। কিছুতেই আজও মেনে নিতে পারি না যে সালিম আলী নেই। হিমালয় পর্বতের চেয়েও উঁচু এ মানুষটি নিজে একজন প্রতিষ্ঠান হয়েছেন, সেই সঙ্গে ১৪১ বছরের বোম্বে ন্যাচারাল হিস্ট্রি সোসাইটিকে প্রতিষ্ঠিত করে মর্যাদার আসনে বসিয়েছেন। স্বপ্ন দেখতাম—সালিম আলী হব, হতে পারিনি, পারব না; কিন্তু এ আকাঙ্ক্ষা পুষে আগামী দিনগুলো কাটানোর আশা তো করতেই পারি।

লেখক: সাবেক অধ্যাপক, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়