‘তৃতীয় তলায় আমার ৮০ লাখ টাকার মালামাল ছিল। সেগুলো পুড়েছে। ঈদ উপলক্ষে মালাগুলো তুলছিলাম। আগুনে আমার সব শেষ হয়ে গেল’, বলছিলেন মো. ইকরাম খান।
বঙ্গবাজারের ইসলামিয়া মার্কেটের সামিয়া গার্মেন্টসের মালিক ইকরাম খান। মার্কেটের দোতলায় তাঁর একটি দোকান আর তৃতীয় তলায় দুটি বড় শোরুম ছিল। আজ মঙ্গলবার সকালে আগুন লাগার খবর শুনে তিনি ছুটে যান মার্কেটের দিকে। ইকরাম জানালেন, দোতলার একটি দোকানের মালপত্র বের করতে পেরেছেন। তৃতীয় তলা থেকে তিনি একটা মালও আনতে পারেননি।
রাজধানীর বঙ্গবাজার কমপ্লেক্স চার বছর আগে ‘অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ’ বলে ঘোষণা করে ফায়ার সার্ভিস। এরপরও কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে সেখানে ব্যবসা–বাণিজ্য চালিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। আজ আগুন লাগার পর ছয় ঘণ্টার বেশি সময় ধরে চেষ্টা চালিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়।
আগুনে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ তাৎক্ষণিকভাবে না জানা গেলেও ব্যবসায়ীরা বলছেন, বিপুল ক্ষতি হয়েছে। ঈদের আগে এ আগুন তাঁদের নিঃস্ব করে দিয়েছে। আগুনের খবর পেয়ে অনেক ব্যবসায়ী তাঁদের দোকানের কর্মীদের নিয়ে ঘটনাস্থলে গিয়ে মালামাল বের করে আনার চেষ্টা করেন। কেউ সেটা করতে পেরেছেন, তবে অনেক ব্যবসায়ীর সবকিছু পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।
বঙ্গবাজারের ব্যবসায়ীরা জানান, বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সের ভেতর চারটি মার্কেট আছে। সেগুলো হলো বঙ্গবাজার মার্কেট, মহানগর মার্কেট, আদর্শ মার্কেট ও গুলিস্তান মার্কেট। এসব মার্কেটে প্রায় তিন হাজার দোকান আছে। তার সব কটি পুড়ে গেছে।
এদিকে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী মো. এনামুর রহমান আজ বিকেলে প্রথম আলোকে বলেন, বঙ্গবাজারের আগুনে প্রায় পাঁচ হাজার দোকান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত দোকানিদের সহায়তায় সরকার সর্বোচ্চটুকুই করবে।
অ্যানেক্সো টাওয়ারের কাছে ফায়ার সার্ভিসের একটি গাড়ির সামনে একজনকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছিলেন মো. মিজানুর। তাঁর কান্না থামছিল না। তাঁর ‘আরাফাত শাড়ি হাউস’ নামে বঙ্গবাজারে একটি দোকান ও একটি গোডাউন ছিল। তিনি একটি দোকানের মালামাল বের করতে পারেননি।
মিজানুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার সব শেষ। দুই কোটি টাকার ওপরে মাল ছিল। দুই ব্যাংক ও আত্মীয়স্বজনের কাছে এক কোটি টাকার ওপর ঋণ আছে।’ তিনি বলেন, ‘সকাল সাড়ে সাতটার দিকে শুনি মার্কেটে আগুন লাগছে। এসে দেখি পুড়ে সব শেষ।’
ব্যবসায়ী মো. তোফাজ্জলের শাড়ির দোকান ছিল বঙ্গবাজারের ভেতরের দিকে। ঈদ সামনে রেখে দোকানে নতুন নতুন শাড়ি তুলেছিলেন তিনি। তোফাজ্জলকে বাজারের সামনে দাঁড়িয়ে অসহায়ভাবে কাঁদতে দেখা গেল। তোফাজ্জল জানালেন, কিছুই বের করতে পারেননি।
তোফাজ্জলের পাশেই ছোটাছুটি করছিলেন আর কাঁদছিলেন সৈয়দ রাসেল নামের এক ব্যক্তি। বঙ্গ ইসলামিয়া বাজারে তাঁর শার্টের দোকান ছিল। তিনি বললেন, সব পুড়ে শেষ হয়ে গেছে।
বঙ্গবাজারে ঠিক কখন আগুন লেগেছে, তা নিশ্চিত করে বলতে পারছে না কেউ। সকাল ৬টা ১০ মিনিটে আগুন লাগার খবর পায় ফায়ার সার্ভিস। এক ব্যক্তি সরাসরি ফোন করে ফায়ার সার্ভিসকে আগুন লাগার খবর জানা। এ ছাড়া জাতীয় জরুরি সেবার নম্বর ৯৯৯-এ ফোন করে আগুনের কথা জানানো হয়। তাৎক্ষণিকভাবে ফায়ার সার্ভিস ঘটনাস্থলে যায়।
দুপুরের দিকে ফায়ার সার্ভিসের নিয়ন্ত্রণকক্ষ থেকে জানানো হয়, ফায়ার সার্ভিসের ৪৮ টি ইউনিট আগুন নেভাতে কাজ করছে। নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুর থেকে ফায়ার সার্ভিসের ইউনিটগুলো এসে কাজে যোগ দেয়। আশপাশের মানুষজন, ব্যবসায়ী ও দোকানে কর্মীরাও আগুন নেভানোর চেষ্টা করেন। তবে বঙ্গবাজারের আগুন আশপাশের বিপণিবিতানেও ছড়িয়ে পড়ে। বঙ্গবাজারের পাশে অ্যানেক্সো টাওয়ার মার্কেটটি সাততলার। এর একাধিক তালায় আগুন লেগে যায়। এর দক্ষিণ পাশে আছে মহানগর কমপ্লেক্স। দোতলার এই মার্কেট টিনের। সেখানেও আগুন লাগে। এর পাশে আছে পুলিশ সদর দপ্তর। এর ভেতরে থাকা একটি পাঁচতলা ভবনেও আগুন লাগে।
বঙ্গবাজারের আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সম্মিলিত সাহায্যকারী দল, বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর সাহায্যকারী দল ও একটি হেলিকপ্টার কাজ করে। আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের (আইএসপিআর) এক বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়।
আইএসপিআরের সহকারী পরিচালক রাশেদুল আলম খান প্রথম আলোকে বলেন, ভয়াবহ এই অগ্নিকাণ্ড শুরুর পরপরই সেনাবাহিনীর সম্মিলিত সাহায্যকারী দল সেখানে কাজ করে। এর পাশাপাশি সেখানে বিমানবাহিনীর একটি সাহায্যকারী দল ও একটি হেলিকপ্টার কাজ করে।
প্রায় সাড়ে ছয় ঘণ্টা পর আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে তিনটি প্রতিবন্ধকতার কথা বলেছে ফায়ার সার্ভিস। আজ দুপুরে গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে কথা বলেন ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিন। তিনি বলেন, সকাল ৬টা ১০ মিনিটে আগুন লাগে। দুপুর ১২টা ৩৬ মিনিটে আগুন নিয়ন্ত্রণে এসেছে। এখন আর আগুন ছড়াবে না। আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে ফায়ার সার্ভিসের ৪৮টি ইউনিট কাজ করেছে। তবে পুরোপুরি নির্বাপণ করতে আরও কিছু সময় লাগবে। প্রতিটি ভবন ও ঘরে গিয়ে আগুন আছে কি না, তা পরীক্ষা করতে হবে।
আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে তিনটি প্রতিবন্ধকতার কথা বলেছেন মহাপরিচালক। তিনি বলেন, আগুন নিয়ন্ত্রণে প্রধান বাধা ছিল উৎসুক জনতা। পানির স্বল্পতা ও বাতাসের কারণেও আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে দেরি হয়েছে।
আগুন নেভাতে পানির স্বল্পতার কথা বলেন মহাপরিচালক মো. মাইন উদ্দিন। তিনি বলেন, সেনাবাহিনী পানির বাউজার এনে এবং ওয়াসাও পানির বিষয়ে সহায়তা করেছে। আর ঘটনাস্থলে অনেক বাতাস ছিল। বাতাসে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় আগুন চলে যায়। এর ফলে নিয়ন্ত্রণে আনতে দেরি হয়েছে।
এক ব্যক্তির মুঠোফোন নম্বর ও জরুরি সেবা ৯৯৯ থেকে প্রথমে আগুনের খবর পেয়েছিলেন বলে জানান মো. মাইন উদ্দিন। আগুন নিয়ন্ত্রণে সেনাবাহিনীর বিভিন্ন ইউনিট, বিজিবি, পুলিশ, ওয়াসা, গণমাধ্যমকর্মীসহ অনেকে সহায়তা করেছেন বলে জানান তিনি।
বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সের বিষয়ে ফায়ার সার্ভিসের ডিজি বলেন, ‘২০১৯ সালের ২ এপ্রিল এই ভবন অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করে ব্যানার টাঙিয়েছিলাম। ১০ বার নোটিশ দিয়েছি, করণীয় যা যা করেছি। তারপরও ব্যবসা চলছিল।’
এ বিষয়ে অন্য সংস্থার গাফিলতি থাকলে তাদের সঙ্গে সাংবাদিকদের কথা বলতে বলেন তিনি। অগ্নিনির্বাপণের পর পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হবে বলেও জানান তিনি।
অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় সাধারণ জনগণ আহত হওয়ার তথ্য জানা নেই বলে জানান মো. মাইন উদ্দিন। ফায়ার সার্ভিসের আটজন আহত হয়েছেন বলে উল্লেখ করেন তিনি। তাঁদের মধ্যে দুজনকে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ভর্তি করা হয়েছে। তাঁদের অবস্থা আশঙ্কাজনক।
অগ্নিকাণ্ডস্থলে দোকানের মালামাল চুরি গেছে বলে অভিযোগ করেছেন এক ব্যবসায়ী। আগুন থেকে বাঁচিয়ে তিনি দোকানের মালপত্র বাইরে নিয়ে এসেছিলেন। পরে সেখান থেকে কয়েকটি বস্তা চুরি হয়ে গেছে বলে জানান তিনি।
‘মায়ের দোয়া’ নামে কাপড়ের দোকানের মালিক সাইফুল ইসলাম ওই অভিযোগ করেন। তিনি বলেন, মহানগর শপিং কমপ্লেক্সে আগুন লাগার পর তিনি ওই মালামাল দোকান থেকে বস্তায় করে রাস্তায় এনে রেখেছিলেন। সেখান থেকে কয়েকটি বস্তা কে বা কারা চুরি করে নিয়ে গেছে।
সাইফুল ইসলাম আরও বলেন, ‘ঈদ সামনে রেখে প্রায় কোটি টাকার কাপড় দোকানে ওঠানো হয়েছিল। আগুন লাগার পর সেগুলো দ্রুত সরিয়ে রাস্তায় নিয়ে আসি। তারপর সেখান থেকে কয়েকটি বস্তা চুরি হয়ে গেছে।’