নাসরিন হাতে মেহেদি দিতে খুব পছন্দ করে। ঈদের দিন নতুন জামা পরে সাজগোজ করে খালার বাড়িতে বেড়াতে যায় সমবয়সীদের সঙ্গে। এ বছর রোজার ঈদেও তা–ই করেছে সে। সালামি নিয়েছে মুরব্বিদের কাছ থেকে। অভাবি পরিবারের মেয়েটি শখ করেছিল সালামির টাকাগুলো দিয়ে একটা জামা কিনবে। কিন্তু নাসরিন জানত না, জীবন কত নিষ্ঠুর হয়ে অপেক্ষা করছে তার জন্য। এই কটা সামান্য টাকাও খরচ হয়ে যাবে ওষুধ কিনতে।
মাত্র দুই মাসের মধ্যে বদলে গেছে ১৬ বছর বয়সী খাদিজা আক্তার নাসরিন নামের মেয়েটার সব স্বপ্ন। এই কিশোরীর সঙ্গে কথা হলো গতকাল রোববার দুপুরে। রাজধানীর মানুষ যখন ঈদের জন্য ঢাকা ছেড়ে গেছে, তখন মেয়েটি রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে এক আত্মীয়ের বাড়িতে কোনোমতে ঠাঁই নিয়েছে চিকিৎসার জন্য।
‘কোরবানির ঈদে তো কেউ নতুন জামা কেনে না। আমি তো মারা যাব, তাই আমার এক বোন গজ কাপড় কিনে আমার জন্য একটা নতুন জামা সেলাই করে দিয়েছে। এরপর আমার জন্য কাফনের কাপড় কিনতে হবে।’
নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ থানার নাসরিনের অসুস্থতা ধরা পড়ে রোজার ঈদের দিনেই। এরপর গত দুই মাসে তার শরীরের বিভিন্ন জায়গায় টিউমার দেখা দিয়েছে। কিন্তু এসব টিউমারে ব্যথা নেই। ব্যথা শুরু হয়েছে ডান পা থেকে। পায়ের মাংসপেশি শুকিয়ে মিশে গেছে হাড়ের সঙ্গে। এখন আর হাঁটতে পারছে না নাসরিন। কথা বলতে কষ্ট হয়, যন্ত্রণায় সারা রাত জেগে বসে থাকে। আগে ব্যথার ওষুধ খেলে কিছুটা কমত। এখন তা–ও কাজ করছে না।
নাসরিনের শরীরে ক্যানসার ধরা পড়ে এ বছরের এপ্রিল মাসে। এরই মধ্যে একটি স্তন অস্ত্রোপচার করে অপসারণ করা হয়েছে। সেখানেও ছিল টিউমার। চিকিৎসক বলেছিল, ছোট মানুষ, তাই আরেকটু অপেক্ষা করতে। কিন্তু নাসরিনের মা নাজমা আক্তার নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে সিদ্ধান্ত নেন মেয়ের স্তন অপসারণ করে ফেলার। তারপরও রক্ষা করা যাচ্ছে না কিছুই। নাজমা বেগমের শরীরে গত দুই বছরে তিনটি অস্ত্রোপচার হয়েছে।
‘কী যে কষ্ট আর লজ্জা এই ভিক্ষা করা, কেউ বুঝবে না। তবু হাত পাতি। কিন্তু ক্যানসারের চিকিৎসা কি এভাবে হয়? কেউ কেউ মিথ্যুক বলেও গালি দেয়। কিছু মনে করি না, আমার মেয়েটাকে বাঁচানোর চিন্তা আগে।’
মোহাম্মদ খোকন আর নাজমা বেগম দম্পতির এই একটিমাত্র সন্তান। খোকন রিকশা চালান। পরিবারটি ছিল চট্টগ্রামে। অভাবে–দেনায় জর্জরিত হয়ে গিয়েছিল। সেখানকার সবকিছু বিক্রি করে দিয়ে গত বছর ঈদুল আজহার সময় তারা চট্টগ্রাম থেকে ফিরে আসে নোয়াখালীতে। খোকন আর নাজমা ভেবেছিলেন যে আবার নতুন করে শুরু করবেন জীবন। একমাত্র মেয়ে নাসরিনকে ভর্তি করিয়ে দিয়েছেন ভোকেশনাল ট্রেনিং স্কুলে অষ্টম শ্রেণিতে। ধার করে রিকশা কিনেছেন। কিন্তু এবার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল মেয়ের ক্যানসার ধরা পড়ায়।
পরিস্থিতি এতই খারাপ হয়েছে যে একমাত্র মেয়ের চিকিৎসার জন্য মসজিদের সামনে দাঁড়িয়ে মানুষের কাছে হাত পাততে হচ্ছে নাজমা বেগমকে। প্রথম আলোকে তিনি বললেন, ‘গোলাপবাগ মসজিদে একটা দরখাস্ত দিয়ে বলেছি, নামাজের পর আমি মেয়ের জন্য সাহায্য তুলতে চাই। তারা মাইকে ঘোষণা করে বলেছে। এরপর নামাজ পড়ে ফেরার পথে মুসল্লিরা আমাকে ১ হাজার ৩০০ টাকা দিয়েছেন। কী যে কষ্ট আর লজ্জা এই ভিক্ষা করা, কেউ বুঝবে না। তবু হাত পাতি। কিন্তু ক্যানসারের চিকিৎসা কি এভাবে হয়? কেউ কেউ মিথ্যুক বলেও গালি দেয়। কিছু মনে করি না, আমার মেয়েটাকে বাঁচানোর চিন্তা আগে।’
মেয়ের ক্যানসার ধরা পড়ার পর ৩০ হাজার টাকায় নিজের রিকশা বিক্রি করে দিয়েছেন মোহাম্মদ খোকন। রিকশাটি তিনি ঋণ নিয়ে কিনেছিলেন। এখন একই সঙ্গে ঋণের বোঝা আর মেয়ের চিকিৎসার খরচ দুটোই চেপেছে কাঁধে। নোয়াখালীতে থেকে একটা ভাড়া রিকশা চালান তিনি। আর রাজধানীতে আত্মীয়ের বাড়িতে চিকিৎসার জন্য এসে আশ্রয় নিয়েছেন মা-মেয়ে। মেয়ের চিকিৎসার সব ব্যবস্থাপত্র দেখাতে দেখাতে নাজমা বেগম জানতে চাইলেন, সত্যি কি আর আশা নাই?
মে মাসে দুই সপ্তাহ রাজধানীর ক্যানসার হাসপাতালে ভর্তি ছিল নাসরিন। গতকাল দুপুরে কথা বলতে বলতে নাসরিন প্রথম আলোকে বলে, ‘কোরবানির ঈদে তো কেউ নতুন জামা কেনে না। আমি তো মারা যাব, তাই আমার এক বোন গজ কাপড় কিনে আমার জন্য একটা নতুন জামা সেলাই করে দিয়েছে। এরপর আমার জন্য কাফনের কাপড় কিনতে হবে।’ অভাব আর অসুখের আঘাতে মনটাও খুব শক্ত হয়ে গেছে মাত্র ১৬ বছরের মেয়েটা। মুখে একটা মিথ্যা হাসি এনে নির্লিপ্ত হওয়ার চেষ্টা করে আবার ভেঙে গেল। বলল, ‘আমি না বিশ্বাস করতে পারি না, এটাই সম্ভবত আমার জীবনের শেষ ঈদ।’
একমাত্র সন্তানের মুখে এমন কথা শুনে ডুকরে কেঁদে উঠলেন মা। তবু আশ্বাস দিয়ে বললেন, ‘তোমার জন্য আমি ভিক্ষা করতে নামছি। ঠিক সুস্থ হয়ে যাবা। আগামী রোজার ঈদে অনেকগুলা নতুন জামা হবে, আরও অনেক সালামি পাবা। ওই টাকা আমরা খরচ করব না। আমার কথা বিশ্বাস করে দ্যাখো মা।’