টেকনাফের বনরক্ষার জন্য খুরশিদা বেগম ও তাঁর একঝাঁক নারী–সহকর্মীর অসাধারণ উদ্যোগ নিয়ে প্রথম আলোতে প্রকাশিত হয়েছিল ‘অরণ্যের জননী’ শিরোনামে প্রতিবেদন। পরে খুরশিদা বেগমকে নিয়ে একটি তথ্যচিত্রও নির্মাণ করে প্রথম আলো। ‘ওয়াংগিরি মাথাই’ নামের একটি অত্যন্ত সম্মানজনক আন্তর্জাতিক পুরস্কার (অর্থমূল্য ১৭ লক্ষ টাকা) উঠেছিল তাঁর হাতে। বর্তমানে কী করছেন খুরশিদা বেগম?
টেকনাফের এক অজপাড়া গ্রামে গিয়েছিলাম খুরশিদা বেগমের খোঁজে। সেটা ২০১৭ সাল। অষ্টম শ্রেণি পাস নিতান্তই এক গ্রাম্যরমণী খুরশিদা। কিন্তু কেরুনতলী গ্রামের সেই মেয়েটি ততদিনে নিজের উপজেলা টেকনাফ তো বটেই, সারা দেশজুড়ে পেয়েছিল খ্যাতি ও পরিচিতি। ‘ওয়াংগিরি মাথাই’ নামের একটি অত্যন্ত সম্মানজনক আন্তর্জাতিক পুরস্কার (অর্থমূল্য ১৭ লক্ষ টাকা) উঠেছিল তাঁর হাতে।
বনরক্ষার জন্য খুরশিদা বেগম ও তাঁর একঝাঁক নারী–সহকর্মীর অসাধারণ উদ্যোগ সেবার নিজের চোখে দেখে এসেছিলাম। প্রথম আলোতে সেই প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল ‘অরণ্যের জননী’ শিরোনামে। পরে খুরশিদা বেগমকে নিয়ে একটি তথ্যচিত্রও নির্মাণ করে প্রথম আলো।
এর মধ্যে কেটে গেছে বেশ কটি বছর। নাফ নদীর অজস্র জলরাশি গড়িয়ে গেছে বঙ্গোপসাগরের দিকে। এখন কেমন আছেন সেই খুরশিদা? অক্ষত আছে তো সেই গাছগুলো, বনদস্যুদের হিংস্র থাবা থেকে যেগুলোকে সন্তানস্নেহে আগলে রেখেছিলেন তিনি? এই কৌতূহল থেকে সম্প্রতি তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলাম প্রথম আলোর টেকনাফ প্রতিনিধি গিয়াস উদ্দিনের মাধ্যমে।
শুনে স্বস্তি ও আনন্দ হলো, কেরুনতলীর ঘন অরণ্যে শাল-সেগুন–গর্জন বৃক্ষরাজি এখনো মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। এখনো পাখ–পাখালির ডাক আর ঝিঁঝির একটানা সুরের গান ছাপিয়ে বনভূমিতে বেজে ওঠে তীব্র হুইসেল। খুরশিদা বেগমের নেতৃত্বে নারী বনরক্ষী দল জানান দেয়, ‘আমরা আছি।’ লাঠি ও টর্চ হাতে সকাল-সন্ধ্যা দুই বেলা বনের ভেতর টহল দিয়ে আসেন কুলসুমা, নূর ফাতেমা, জোহরা, নূরজাহান, হামিদা, সাবিকুন নাহার ও হাসিনাসহ ২৮ জন নারী। এই কাজে বন বিভাগের পক্ষ থেকে সামান্য সম্মানী পান তারা। কিন্তু মাসে মাত্র সাড়ে সতেরশ টাকার সেই অর্থমূল্যের জন্য নয়, প্রাণের তাগিদে তাঁরা রক্ষা করেন এই বৃক্ষরাজিকে।
বনদস্যু শুধু নয়, এক সময় গ্রামের মানুষও বনের ভেতর দা হাতে ঘুরে বেড়াত কাঠ সংগ্রহের জন্য। কিন্তু খুরশিদা গ্রামের মানুষকে বোঝাতে পেরেছিলেন বনবিভাগের নিয়ম অনুযায়ী পরিণত বয়সে গাছ কাটার পর কাঠ বিক্রির লভ্যাংশ তাঁরাও পাবে।
‘প্রতিশ্রুতি তো দিয়েছিলেন, কিন্তু গ্রামবাসী কি লভ্যাংশ পেয়েছে?’
খুরশিদা জানালেন, ‘হ্যাঁ পেয়েছে। এর মধ্যে একবার ১ লাখ ৬২ হাজার টাকা ও আরেকবার ৪২ হাজার টাকা পেয়েছে গ্রামবাসী।’
এসব শুনে মনটা আনন্দে ভরে ওঠে। কিন্তু পাশাপাশি কিছু অপ্রাপ্তির কথাও উঠে আসে। একটি বেসরকারি সাহায্য সংস্থার সহযোগিতায় খুরশিদা ও তাঁর প্রয়াত স্বামী গড়ে তুলেছিলেন একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়। এখনো সরকারিকরণ হয়নি সেই বিদ্যালয়টি। এখানে নেই কোনো হাইস্কুল। টেকনাফ সদরে স্কুলে পড়তে যাওয়া সবার পক্ষে সম্ভব হয় না বলে অনেকের উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন মুখ থুবড়ে পড়ে। খুরশিদা চান, তাঁদের বিদ্যালয়টিকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত করার সরকারি উদ্যোগ নেওয়া হোক।
২০১১ সালে একবার চারজন পুরুষ প্রতিদ্বন্দ্বীকে পরাস্ত করে ইউপি সদস্য নির্ধারিত হয়েছিলেন খুরশিদা বেগম। তাঁর কাছে জানতে চাইলাম, ভবিষ্যতে আর নির্বাচন করবেন কিনা, রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হবেন কিনা?
রাজনীতিতে অনীহার কথা জানালেন কিন্তু আজীবন মানুষের পাশে থাকতে চান, মানুষের জন্য কিছু করতে চান খুরশিদা বেগম। বয়স বেড়েছ, কিন্তু উদ৵মে ভাটা পড়েনি এখনো, এতটুকুও।