‘গণ–অভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপটে আমি আবু বকর’ শিরোনামে আলোচনা সভায় বক্তব্য দেন অন্তর্বর্তী সরকারের আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল। শনিবার রাজধানীর শাহবাগে জাতীয় জাদুঘরের প্রধান মিলনায়তনে
‘গণ–অভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপটে আমি আবু বকর’ শিরোনামে আলোচনা সভায় বক্তব্য দেন অন্তর্বর্তী সরকারের আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল। শনিবার রাজধানীর শাহবাগে জাতীয় জাদুঘরের প্রধান মিলনায়তনে

আওয়ামী লীগ আমলের চেয়ে ভালো দেশ গড়তে না পারলে গণ-অভ্যুত্থান ব্যর্থ হবে: আসিফ নজরুল

আওয়ামী লীগের শাসনামলে সব সামাজিক সম্পর্ক শেষ করে দেওয়া হয়েছিল বলে মন্তব্য করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল। আওয়ামী লীগের শাসনকে ‘নিষ্ঠুর ও নারকীয়’ উল্লেখ করে তিনি বলেছেন, আওয়ামী লীগ আমলের চেয়ে অনেক ভালো বাংলাদেশ গড়তে না পারলে জুলাই গণ–অভ্যুত্থান ব্যর্থ হবে।

শনিবার বিকেলে রাজধানীর শাহবাগে জাতীয় জাদুঘরের প্রধান মিলনায়তনে এক আলোচনা সভায় আসিফ নজরুল এ কথাগুলো বলেন। ‘গণ–অভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপটে আমি আবু বকর’ শিরোনামে এ আলোচনা সভার আয়োজন করে বঙ্গীয় সাহিত্য সভা। ‘আমি আবু বকর’ চলতি বছরের শুরুতে প্রথমা প্রকাশন থেকে প্রকাশিত আসিফ নজরুলের একটি উপন্যাস।

আলোচনায় অংশ নিয়ে ‘আমি আবু বকর’ উপন্যাসটি প্রকাশের জন্য প্রথমা প্রকাশন ও প্রথম আলোকে ধন্যবাদ জানান আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল। আওয়ামী লীগের শাসনামলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর কক্ষে তালা, আগুন, গুলি করে হত্যার হুমকি, ধাওয়া দিয়ে বিতাড়িত করা, মামলা, বিভিন্ন কনসালট্যান্সির কাজ বাতিল করে দেওয়ার কথা উল্লেখ করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক আসিফ নজরুল।

বিশ্ববিদ্যালয়ে শিবির সন্দেহে পেটানোর বিরুদ্ধে বলার জন্য অনেক বন্ধু দূরে চলে গেছেন উল্লেখ করে আসিফ নজরুল বলেন, ‘জেনেবুঝে শিক্ষার্থীদের ট্যাগ দেওয়া হতো। তারা জানত, ছাত্রটা শিবির বা ছাত্রদল না। তাঁর ল্যাপটপটা নেওয়ার জন্য বা বিনোদন হিসেবে এটা করা হতো।...১৫ বছরের এসব ব্যাধি থেকে আমরা এখনো মুক্ত হইনি।’ সেই ‘ট্যাগের রাজনীতি’ থেকে বের হওয়া গেছে কি না—প্রশ্ন রেখে অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেন, ‘আওয়ামী লীগকে ঘৃণা করতাম ট্যাগের রাজনীতি দিয়ে মানুষকে ভিকটিমাইজ (ক্ষতিগ্রস্ত) করার কারণে। সেটা কি আমরা এখনো করে চলছি না?’

১৫ বছর ধরে যে ‘নারকীয় শাসন’ সহ্য করতে হয়েছে, তার পেছনে সামষ্টিক কাপুরুষতাও ছিল বলে মন্তব্য করেন আসিফ নজরুল। তিনি বলেন, ‘তারা সব সামাজিক সম্পর্ক শেষ করে দিয়েছিল। এত নিষ্ঠুর, নারকীয়! জানি না আমরা কী পাপ করেছিলাম যে আমরা শেখ হাসিনার মতো একটা শাসক পেয়েছিলাম বাংলাদেশে। ...আমরা যদি আওয়ামী লীগ আমলের চেয়ে অনেক বেটার (আরও ভালো) একটা বাংলাদেশ না গড়তে পারি, তাহলে জুলাই গণ–অভ্যুত্থান ব্যর্থ হয়ে যাবে।’

অধ্যাপক আসিফ নজরুল আরও বলেন, ‘আমাদের দেশে কবিতার মাধ্যমে অনেক প্রতিবাদ হয়েছে। কিন্তু গল্প-উপন্যাসের মধ্য দিয়ে প্রতিবাদটা কম হয়েছে বলে আমার মনে হয়। সাহিত্যচর্চা, গল্প-উপন্যাসের মধ্য দিয়ে আমাদের প্রতিবাদটা জারি রাখা উচিত। ...আমি জীবনে অনেক বিচিত্র জিনিস করেছি। অ্যাকটিভিজম করেছি, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলাম, সাংবাদিক ছিলাম। এখন আবার সরকারের একটা দায়িত্ব পালন করছি। কিন্তু লেখালেখির মধ্যে যে আনন্দ, পৃথিবীতে এই আনন্দের কোনো তুলনা হয় না।’

‘আমি আবু বকর’ উপন্যাসের ওপর আলোচনায় অংশ নিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চেয়ারম্যান আবদুল মোমেন (লেখক নাম আন্দালিব রাশদী) বলেন, এই গল্পটি আবু বকরের আত্মজীবনী। আবু বকর একটি বিকৃত সমাজের সৃষ্টি। যে সমাজের প্রধানমন্ত্রী ও বায়তুল মোকাররমের খতিব একসঙ্গে পালিয়ে যান। ...গণ-অভ্যুত্থানের প্রধান অস্ত্র হচ্ছে বিচার। যথাযথ বিচার সরকারি দলেরও হতে হবে, সেটা যে সরকারই হোক, এমনকি এই অন্তর্বর্তী সরকারও যদি হয়। সেটা যদি হয়, বৈষম্য ক্রমেই সংকুচিত হয়ে আসবে এবং সেই সমাজে আবু বকর সৃষ্টি হবে না।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় ছাত্রলীগের গণরুম–গেস্টরুম নির্যাতনের শিকার হওয়ার অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন গণ অধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মো. রাশেদ খান। তিনি বলেন, ‘আমি আবু বকর’ উপন্যাসে আসিফ নজরুল যা লিখেছেন, তা মফস্‌সল থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসা প্রত্যেকটি শিক্ষার্থীর গল্প। আসিফ নজরুল সব সময় শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। কিন্তু উপদেষ্টা হওয়ার পর থেকে অধ্যাপক আসিফ নজরুলকে নিয়ে আবু বকরের মতোই নিপীড়ন ও ব্লেম-গেমের (দোষারোপ) চক্রান্ত করছে একটি মহল। তিনিও আবু বকরের মতোই নিপীড়ন ও সাইবার বুলিংয়ের (হয়রানি) শিকার।

কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক সালাহ উদ্দিন শুভ্র বলেন, ছাত্রলীগ নিপীড়নের যে পদ্ধতি গড়ে তুলেছিল, সেই বাস্তব ঘটনাগুলো ‘আমি আবু বকর’ উপন্যাসে আছে। আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগের নিপীড়নব্যবস্থায় বেশি নিপীড়িত হয়েছেন নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তানেরা।

লেখক ও প্রকাশক মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন ওটিটি নির্মাতাদের ‘আমি আবু বকর’ উপন্যাসটি নিয়ে কাজ করার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, আসিফ নজরুলের অসম্ভব শক্তিশালী লেখক হওয়ার ক্ষমতা আছে। তিনি যেন নিয়মিত বেশি বেশি লেখেন।

গণ–অভ্যুত্থানের বুদ্ধিবৃত্তিক পাটাতন নির্মাণে ‘আমি আবু বকর’ উপন্যাসটি বড় ভূমিকা পালন করেছে বলে মন্তব্য করেন বাসসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান সম্পাদক মাহবুব মোর্শেদ। লেখক ও সাংবাদিক এহসান মাহমুদের সঞ্চালনায় সভায় অন্যদের মধ্যে কথাসাহিত্যিক পাপড়ি রহমান ও লেখক আমিনুল ইসলাম বক্তব্য দেন।