অনামিকা (ছদ্মনাম) ও সজল (ছদ্মনাম) দুজনেই একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী এবং উভয়ের বয়স ১৮ বছরের বেশি। একই বিভাগে পড়াশোনার সুবাদে তাঁদের মধ্যে প্রথমে বন্ধুত্ব এবং পরে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়া–আসার পথে সজল মাঝেমধ্যে অনামিকার বাসায় যাওয়া–আসা করতেন। এ রকমই একদিন সজল অনামিকার বাসায় যান, যেদিন ওর বাসায় আর কেউ ছিল না। সেদিন সজল ভয় দেখিয়ে অনামিকার সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক করেন এবং তা ভিডিও করে রাখেন। অনামিকা ওই দিনের ঘটনা কাউকে বললেন না। এরপর সজল মাঝেমধ্যেই অনামিকাকে শারীরিক সম্পর্ক করতে চাপ প্রয়োগ করেন। অনামিকা রাজি না হলে সজল সেই ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দিয়ে বা আত্মীয়স্বজনের কাছে পাঠানোর হুমকি দিয়ে শারীরিক সম্পর্ক করতে বাধ্য করেন।
ওপরের ঘটনাটা কাল্পনিক হলেও বর্তমান সময়ে প্রায়ই এ রকম অভিযোগ উঠছে। ভুক্তভোগী অনেক নারী আইনের আশ্রয় লাভের জন্য মামলাও করছেন। এ ধরনের ঘটনায় সাধারণত নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ (সংশোধিত ২০০৩)–এর অধীনে ধর্ষণের অভিযোগে মামলা করা হয়। এই ধরনের মামলায় ধর্ষণ হয়েছে কি হয়নি, সেটা বিবেচনার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো ভুক্তভোগী নারীর ‘সম্মতি’।
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৯(১) ধারার ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, যদি কোনো পুরুষ বিবাহ বন্ধন ব্যতীত ১৬ বছরের অধিক বয়সের কোনো নারীর সাথে তার সম্মতি ছাড়া বা ভীতি প্রদর্শন বা প্রতারণামূলকভাবে তার সম্মতি আদায় করে, অথবা ১৬ বছরের কম বয়সের কোনো নারীর সাথে তার সম্মতিসহ বা সম্মতি ছাড়া যৌন সঙ্গম করেন, তাহলে তিনি উক্ত নারীকে ধর্ষণ করেছেন বলে গণ্য হবে। অর্থাৎ ১৬ বছরের বেশি বয়সের কোনো নারীর সাথে তার সম্মতি ছাড়া, ভয় দেখিয়ে বা প্রতারণা করে কেউ যদি শারীরিক সম্পর্ক করে, সেটা ধর্ষণ। আর ১৬ বছরের কম বয়সের কোনো নারীর সম্মতি বা সম্মতি ছাড়া, যেকোনোভাবেই শারীরিক সম্পর্ক করলে সেটা ধর্ষণ বলে গণ্য হবে।
উল্লেখিত ঘটনায় অনামিকার সঙ্গে সজলের প্রেমের সম্পর্ক ছিল এবং তাঁরা দুজনই প্রাপ্তবয়স্ক। তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে, তাঁদের মধ্যকার শারীরিক সম্পর্ক ধর্ষণ বলে বিবেচিত হবে কি না। এ ক্ষেত্রে ভুক্তভোগীর সম্মতির বিষয়টি খুব গুরুত্বপূর্ণ এবং সেটার ব্যাখ্যা রয়েছে দণ্ডবিধির ৯০ ধারায়। এ ধারায় বলা হয়েছে, যদি ক্ষতির ভয়ে বা তথ্যের ভ্রান্ত বর্ণনার কারণে কোনো ব্যক্তি কর্তৃক সম্মতি প্রদান করা হয় এবং যদি উক্ত কার্য সম্পাদনকারী ব্যক্তি যদি জানে বা তার বিশ্বাস করবার কারণ থাকে যে ওই সম্মতি অনুরূপ ভীতি বা ভ্রান্ত ধারণার ফলে প্রদত্ত হয়েছিল, তাহলে সেখানে কোনো সম্মতি ছিল না বলে গণ্য হবে। অর্থাৎ ভয়ভীতি দেখিয়ে বা ভুল ধারণা দিয়ে সম্মতি আদায় করা হলে সেটা সম্মতি হিসেবে বিবেচিত হবে না। আলোচ্য ঘটনায় অনামিকার কি ‘সম্মতি’ ছিল, নাকি তিনি নিজেকে ‘সমর্পণ’ সম্পর্ক করতে বাধ্য হয়েছিলেন? আইনের দৃষ্টিতে ‘সম্মতি’ ও ‘সমর্পণ’ এক জিনিস নয়। অনামিকা শারীরিক সম্পর্ক না করলে সজল ভিডিও প্রকাশ করে দেবেন—এমন হুমকির কারণে অনামিকা শারীরিক সম্পর্ক করতে বাধ্য হয়েছিলেন। সজল ভয় দেখিয়ে দিনের পর দিন অনামিকাকে শারীরিক সম্পর্ক করতে বাধ্য করেছেন।
আরেকটি বিষয় লক্ষণীয় হলো, আইনের দৃষ্টিতে ভীতি বা ক্ষতি বলতে শুধু শারীরিক ক্ষতিই নয়, সামাজিক মাধ্যমে অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়াটাও ক্ষতির মধ্যেও পড়ে। আল আমিন বনাম রাষ্ট্র [ (১৯৯৯) ৫১ ডিএলআর, ১৫৪ ] মামলায় উচ্চ আদালত বলেন, বর্তমান সমাজে একজন নারীর জন্য ধর্ষণ হলো চরম ভয়। এই রায়ে উল্লেখ করা হয়েছে, ধর্ষণ নিছক শারীরিক আক্রমণ নয় বরং এটি ভুক্তভোগীদের সমগ্র ব্যক্তিত্বকে ধ্বংস করে, যা মানব মর্যাদার বিরুদ্ধে সবচেয়ে গুরুতর অপরাধ। ইব্রাহিম দেওয়ান বনাম রাষ্ট্র [ ২১ বিএলসি (২০১৬) ৮১৩] মামলায় উচ্চ আদালত বলেন, ‘ধর্ষণ হচ্ছে সমাজ ও সমগ্র মানবতার বিরুদ্ধে একটি অপরাধ। অপরাধীরা সমগ্র সমাজের জন্যই হুমকি।’
প্রাপ্তবয়স্ক নারী ও পুরুষ নিজেদের সম্মতিতে শারীরিক সম্পর্ক করলে এবং সেখানে বলপ্রয়োগ, ভীতি বা হুমকি না থাকলে, তা আইন অনুযায়ী ধর্ষণ বলে গণ্য হবে না। কিন্তু অনেক সময়ই ধর্ষণের মামলায় যে কথাটি উল্লেখ করা হয় তা হলো, ‘বিয়ের প্রলোভনে ধর্ষণ’। এ ক্ষেত্রে বিষয়টা একটু জটিল। কোনো কোনো ঘটনায় দেখা গেছে, প্রেমের সময় পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতে শারীরিক সম্পর্ক হয়। কিন্তু পরে যখন বিয়ের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা হয় না, তখন ধর্ষণের অভিযোগে মামলা করা হয়। এ ধরনের ঘটনায় ধর্ষণের মামলা না হয়ে প্রতারণার মামলা হওয়াই সমীচীন। কারণ, ধর্ষণে যে জোরপূর্বক বা বলপ্রয়োগের বিষয় থাকে, তা এ ধরনের ঘটনায় অনুপস্থিত। সম্প্রতি ভারতের একটি আদালত এ রকম ঘটনা ধর্ষণ নয় বলে সিদ্ধান্ত দিয়েছেন।
আমাদের উচ্চ আদালত ধর্ষণকে সমাজ ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করলেও ধর্ষণের অভিযোগে মিথ্যা মামলার সংখ্যা কম হয় না। অনেক সময় জায়গা–জমি বা অন্য কিছু নিয়ে বিরোধ থাকলে প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে ধর্ষণের মিথ্যা মামলা দেওয়া হয়। কাউকে হয়রানি করার জন্য ধর্ষণের মিথ্যা মামলা করলে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ১৭ ধারা অনুযায়ী মামলার বাদীর ৭ বছর পর্যন্ত সশ্রম কারাদণ্ড এবং এর পাশাপাশি অর্থদণ্ডও হতে পারে।
সোলায়মান তুষার আইনজীবী