চাঁদপুরে পদ্মা-মেঘনা মোহনার ইলিশ কম, মাছ বেশি ভোলা-লক্ষ্মীপুরের

চাঁদপুর মাছঘাটে ইলিশের হাট। গত রোববার দুপুরে তোলা
ছবি: আলম পলাশ

মৎস্য অবতরণকেন্দ্রের চেহারা যেমন হয়, ডাকাতিয়া নদীপাড়ের দৃশ্য তেমনই। জাল, জেলে, নৌকা, ট্রলার—সবকিছুর দেখা মেলে এখানে। মৎস্যজীবীরা ইলিশ নিয়ে আসছেন নৌ ও সড়কপথে। আড়তগুলোতে নিলামের হাঁকডাক। দিনভর ব্যস্ততা। এভাবেই চলে ইলিশের জমজমাট বিকিকিনি।

চাঁদপুরের ডাকাতিয়া নদীর পাড়ে গড়ে উঠেছে ইলিশের এই হাট। এর নাম ‘চাঁদপুর মাছঘাট’। দেশের অন্যতম প্রসিদ্ধ মৎস্য বাণিজ্যকেন্দ্র এই চাঁদপুর মাছঘাট। পদ্মা-মেঘনার ইলিশসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ ধরাকে কেন্দ্র করে ত্রিনদীর মিলনস্থলে ডাকাতিয়া নদীর মোহনায় এ মাছঘাট গড়ে উঠেছে। মূলত ব্রিটিশ আমলে নৌ-সড়ক-রেল যোগাযোগ সুবিধার কারণে এই মাছঘাট বিশেষ পরিচিতি পায়।

মৎস্যজীবী ও ব্যবসায়ীরা বলছেন, মাছঘাটে চাঁদপুর ছাড়াও লক্ষ্মীপুরের রায়পুরের খাসের হাট, মতিরহাট, কমলনগর, আলেকজান্ডার, রামগতি, নোয়াখালীর হাতিয়া, চেয়ারম্যানঘাট, বাতির খাল, ভোলার দৌলতখা, তজুমউদ্দিন, চরফ্যাশন ও মনপুরার ডালচর থেকে সড়ক ও নৌপথে ইলিশ আসে।

গত শনিবার সরেজমিন দেখা গেল, চাঁদপুরের মেঘনার তীরবর্তী হাইমচর চরাঞ্চল ও সদর উপজেলার স্থানীয় মাছঘাট থেকে মাছ নিয়ে কিছু নৌকা চাঁদপুর মাছঘাটে এসেছে। দেড় কেজি ওজনের ইলিশ ১৩ থেকে ১৪ শ টাকা কেজি, ৮ থেকে ৯ শ গ্রাম ইলিশ ৮৫০ থেকে ৯০০, ৫ থেকে ৬ শ গ্রাম ওজনের ইলিশ ৬০০ থেকে ৬৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

চাঁদপুর মৎস্য বণিক সমবায় সমিতির সভাপতি আবদুল বারি মানিক জমাদার প্রথম আলোকে বলেন, চাঁদপুর ব্যবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্র। বর্তমান ইলিশ মৌসুমে প্রতিদিন এক থেকে দেড় হাজার মণ ইলিশ কেনাবেচা হয়।

ট্রলার থেকে মাছ হাটে ইলিশ নিয়ে আসছেন একজন শ্রমিক

ঢাকা থেকে প্রাইভেট কার নিয়ে চাঁদপুর মাছঘাটে গিয়ে ইলিশ কিনছিলেন ঢাকার ব্যবসায়ী আবদুল করিম। তিনি বলেন, পদ্মা-মেঘনার ইলিশ স্বাদে অতুলনীয়। এ কারণেই চাঁদপুরে ইলিশ কিনতে যান তিনি।

কুমিল্লা থেকে মাছ কিনতে গিয়েছিলেন ইতালিপ্রবাসী সোবহান মিয়া। তিনি বলেন, চাঁদপুরের ইলিশের সুনাম বিশ্বব্যাপী। এবার ছুটিতে দেশে আসার সময় প্রবাসী বন্ধুরা বলে দিয়েছেন, ফেরার সময় তিনি যেন চাঁদপুরের ইলিশ নিয়ে যান। সে কারণেই ইলিশ কিনতে চাঁদপুরে আসা।

চাঁদপুরে পদ্মা-মেঘনা মোহনার ইলিশ কম

চাঁদপুর মাছঘাটে শনিবার বেলা ১১টা থেকে ১টা পর্যন্ত অবস্থানকালে পদ্মা-মেঘনা মোহনা থেকে ইলিশ ধরে আসা কোনো জেলে নৌকা দেখা যায়নি। সদর উপজেলার জেলে বাদশা মিয়ার সঙ্গে দুপুরে কথা হয়। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ওই দিন ভোরে তিনি আরেক সঙ্গীসহ পদ্মায় মাছ ধরতে যান। কোষা নৌকায় (মাছ ধরার এক ধরনের লম্বা নৌকা) করে সুতি জাল দিয়ে একদুপুর নদীতে কাটিয়ে ৫০০ থেকে ৬০০ গ্রাম ওজনের পাঁচটি ইলিশ পান। এতে তাঁদের তেলসহ অন্যান্য খরচের ১ হাজার ৫০০ টাকাই ওঠেনি।

জেলেরা বলছেন, ইলিশের স্বাভাবিক প্রকৃতি হলো স্রোতের প্রতিকূলে চলে। বর্ষাকালে নদীর স্রোত সাগরের দিকে বেশি প্রবাহিত হওয়ায় সে সময়ই বেশি পরিমাণ ইলিশ পদ্মা-মেঘনা মোহনায় আসে। কিন্তু এ বছর আষাঢ়–শ্রাবণ মাসে তেমন বৃষ্টি হয়নি। এ কারণে চাঁদপুরের মাছঘাটে পদ্মা-মেঘনার ইলিশের পরিমাণ কম।
জেলা মৎস্য বিভাগের তথ্যমতে, চাঁদপুরে নিবন্ধিত আছে প্রায় ৪৫ হাজার জেলে। তবে জেলেদের নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন সংগঠনের দাবি, জেলায় জেলের প্রকৃত সংখ্যা ৬০ হাজারের বেশি হবে।

চাঁদপুরের হাইমচরের পাঁচ জেলের সঙ্গে কথা হয়। তাঁরাও বলেছেন এবার পদ্মা-মেঘনায় ইলিশ কম। তাঁদের ভাষ্যমতে, অন্যান্য বছর ভাদ্র-আশ্বিন মাসে ইলিশের ভরা মৌসুমে শত শত জেলে নৌকা পদ্মা-মেঘনায় ইলিশ ধরে বিক্রির জন্য চাঁদপুর মাছঘাটে আসত। কিন্তু এবার বিপরীত চিত্র দেখা গেছে।

চাঁদপুর কান্ট্রি বোট মালিক সমিতির সভাপতি শাহ আলম প্রথম আলোকে বলেন, গত দুই মাস নদীতে তেমন ইলিশ পাওয়া যায়নি। জেলেরা ডাঙায় নৌকা তুলে রেখেছিলেন। তাঁদের দুর্বিষহ জীবন কেটেছে। তবে সেপ্টেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে বঙ্গোপসাগরে নিম্নচাপের ফলে এখন সামান্য কিছু হলেও মাছ পাচ্ছেন।

ইলিশ গবেষণাকেন্দ্রের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মোহাম্মদ আশরাফুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, ইলিশ রক্ষা কার্যক্রমের আওতায় সরকার ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধিতে কাজ করছে। এখন এক থেকে দেড় কেজি সাইজের ইলিশও নদ-নদীতে পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু মেঘনায় চর-ডুবোচরের কারণে ইলিশের চলাচল বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এ ছাড়া সাগর থেকে নদীতে ইলিশ আসার পথে অনেক কারেন্ট জাল থাকে। এসব কারণে পদ্মা-মেঘনায় ইলিশ কম আসে। তবে ইলিশের গড় উৎপাদন বেড়েছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।

মৎস্য অধিদপ্তরের সর্বশেষ প্রকাশিত বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২০-২১ সালে চাঁদপুরে ৩৩ হাজার ৯৯২ মেট্রিক টন ইলিশ উৎপাদিত হয়েছে। ২০১৭-১৮ সালের তথ্যেও দেখা গেল, চাঁদপুরে সে বছর ৩৩ হাজার ৯৮১ মেট্রিক টন ইলিশ উৎপাদিত হয়েছে।

ডাকাতিয়া নদীপাড়ে বাঁধা জেলেদের সারি সারি নৌকা

ভোলা-লক্ষ্মীপুরের মাছ বেশি আসে

চাঁদপুরে মাছঘাটে গিয়ে জেলে, মৎস্যজীবী, আড়তদার, মৎস্য ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সপ্তাহে দক্ষিণাঞ্চলের ভোলা থেকে ২ থেকে ৪টি মাছ ধরার নৌকা ইলিশ নিয়ে চাঁদপুর মাছঘাটে আসে। এ ছাড়া নৌ ও সড়কপথে লক্ষ্মীপুর,নোয়াখালীর বিভিন্ন মাছঘাট থেকে ইলিশ আসে চাঁদপুরের মাছঘাটে।

লক্ষ্মীপুরের কমলনগরের পাইকারি মাছ ব্যবসায়ী সোহাগ ব্যাপারী প্রথম আলোকে বলেন, তিনি ১০ মণ ইলিশ সড়কপথে পিকআপে নিয়ে চাঁদপুর মাছঘাটে বিক্রির জন্য এসেছেন। এসব ইলিশ তিনি বাতিরখাল মাছঘাট থেকে কিনেছেন।

চাঁদপুর মাছঘাটে উত্তর কুমার মৎস্য আড়তে কথা হয় নোয়াখালীর হাতিয়ার মাছ ব্যবসায়ী মোশারফ হোসেনের সঙ্গে। তিনি বলেন, প্রায় ২০ মণ ইলিশ মাছ নিয়ে ট্রাক ভাড়া করে তিনি চাঁদপুর মাছঘাটে বিক্রির জন্য এসেছেন। ঢাকা, চট্টগ্রামের তুলনায় এখানে মাছের দাম বেশি পাওয়া যায়। এ জন্য তিনি চাঁদপুরে মাছ বিক্রির জন্য আসেন।
বাজার ঘুরে জানা গেল, দেড় কেজি সাইজের প্রতি মণ ইলিশ ৫২ থেকে ৫৬ হাজার টাকা, ৮ থেকে ৯ শ গ্রামের প্রতি মণ ইলিশ ৩৪ থেকে ৩৬ হাজার, ৫ থেকে ৬ শ গ্রাম সাইজের প্রতিমণ ইলিশ ২৪ থেকে ২৬ হাজার টাকা বিক্রি হচ্ছে।