পুলিশ হেফাজতে মৃত্যু

ওসি, তিন পুলিশ কর্মকর্তাসহ ৯ জনের বিরুদ্ধে মামলা

দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অবসরপ্রাপ্ত উপপরিচাক এস এম শহীদুল্লাহ
ছবি: সংগৃহীত

চট্টগ্রাম নগরে পুলিশের হেফাজতে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অবসরপ্রাপ্ত উপপরিচালক এস এম শহীদুল্লাহর (৬৭) মৃত্যুর ঘটনায় একটি থানার ওসি, তিন পুলিশ কর্মকর্তাসহ নয়জনকে আসামি করে নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু নিবারণ আইনে মামলা হয়েছে। আজ সোমবার চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা জজ বেগম জেবুন নেসার আদালতে মামলার আবেদনটি করেন নিহত ব্যক্তির স্ত্রী ফৌজিয়া আনোয়ার।

আসামিরা হলেন চান্দগাঁও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) খাইরুল ইসলাম, পরিদর্শক (তদন্ত) মবিনুল হক, সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) মো. ইউসুফ ও সোহেল রানা এবং শহীদুল্লাহর প্রতিপক্ষ হিসেবে পরিচিত এস এম আসাদুজ্জামান, জসিম উদ্দিন, মো. লিটন, রনি আক্তার তানিয়া ও কলি আক্তার।

মামলার বাদী ফৌজিয়া আনোয়ারের আইনজীবী রেজাউল করিম চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, আদালত বাদীর অভিযোগ গ্রহণ করে চান্দগাঁও থানাকে এজাহার হিসেবে নিতে নির্দেশ দেন। একই সঙ্গে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই) মামলাটি তদন্তের আদেশ দিয়েছেন।

আদালতে করা একটি মারামারির মামলায় পরোয়ানা থাকায় ৩ অক্টোবর রাতে নগরের চান্দগাঁওয়ের বাসা থেকে শহীদুল্লাহকে গ্রেপ্তার করে থানায় নিয়ে আসেন সাদাপোশাকে থাকা এএসআই ইউসুফ আলী ও সোহেল রানা। থানায় তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লে হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে চিকিৎসক তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন।

পরিবারের দাবি, হৃদ্‌রোগের রোগী শহীদুল্লাহকে পুলিশ ইচ্ছাকৃতভাবে ওষুধ না দিয়ে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছে। তবে পুলিশ বলছে, শহীদুল্লাহকে ওসির কক্ষে বসিয়ে রাখা হয়েছিল। তাঁকে থানায় কোনো নির্যাতন করা হয়নি। ওসির কক্ষে অসুস্থ হয়ে পড়লে তাঁকে পরিবারের সদস্যরা ও পুলিশ মিলে নগরের একটি বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানে তাঁর মৃত্যু হয়। ঘটনার পর চান্দগাঁও থানার এএসআই ইউসুফ ও সোহেলকে দামপাড়া পুলিশ লাইনসে প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। একই সঙ্গে ঘটনার তদন্তে পুলিশ একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। এ ছাড়া যে মামলায় শহীদুল্লাহকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, সেটির বিষয়ে আদালত থেকে সমন না আসায় গায়েবের অভিযোগে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের (ষষ্ঠ) বেঞ্চ সহকারী হারুন অর রশিদকে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়।

শহীদুল্লাহ স্ত্রীর আদালতে করা মামলার আবেদনে বলা হয়, জায়গা-জমি দখলের জন্য আসাদুজ্জামান, জসিম, লিটন, তানিয়া ও কলি মিলে তাঁর স্বামীকে মিথ্যা মামলায় আসামি করেন। এতে তাঁদের প্রত্যক্ষ সহায়তা দেন চান্দগাঁও থানার অভিযুক্ত চার পুলিশ কর্মকর্তা। এ ছাড়া যে আদালতে মামলা হয়, সেই আদালতের বেঞ্চ সহকারী হারুন উর রশিদ সমন গায়েব করে ফেলেন। পরে পরোয়ানা জারি হয়।

শহীদুল্লাহ স্ত্রী আরও অভিযোগ করেছেন, শহীদুল্লাহ হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত ছিলেন। তাঁর বাইপাস সার্জারি হয়েছিল। এ ছাড়া তিনি উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস ও শ্বাসকষ্টের রোগী ছিলেন। এএসআই ইউসুফ ও সোহেল রানা গ্রেপ্তার করার সময় তাঁকে গালাগাল করেন। টেনেহিঁচড়ে তাঁকে থানায় নিয়ে জায়গা-সম্পত্তি বিষয়ে বিবাদীদের সঙ্গে আপসের জন্য চাপ দেন। একপর্যায়ে ওসির কক্ষে তাঁকে নির্যাতন করা হয়। ওসি আড়ালে থেকে তাঁদের এ কাজে সহায়তা করেন। গ্রেপ্তারের সময় পরিবারের সদস্যরা প্রয়োজনীয় ওষুধ দিতে চাইলে সেগুলোও নিতে দেননি দুই এএসআই। মানসিক নির্যাতনের মাধ্যমে তাঁর মৃত্যু ঘটানো হয়েছে।

শহীদুল্লাহর বিরুদ্ধে করা মামলা প্রত্যাহারের আবেদন
এদিকে দুদক কর্মকর্তা মৃত শহীদুল্লাহর বিরুদ্ধে করা মামলা প্রত্যাহারের আবেদন করেছেন বাদী রনি আক্তার তানিয়া। আজ সোমবার চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে তিনি এ আবেদন করেন। এতে বলা হয়, তিনি আর মামলাটি চালাতে ইচ্ছুক না। পরে আদালত ৩০ অক্টোবর এই মামলার ধার্য দিনে বিষয়টি শুনানির জন্য রেখেছেন বলে দুদক কর্মকর্তার মামলার আইনজীবী রেজাউল করিম চৌধুরী জানিয়েছেন।

মারধরের অভিযোগ এনে দুদক কর্মকর্তা শহীদুল্লাহ ও তাঁর শ্যালক মোহাম্মদ কায়সার আনোয়ারের বিরুদ্ধে গত ২৯ আগস্ট চট্টগ্রাম আদালতে মামলাটি করেন রনি আক্তার তানিয়া (২৬) নামের এই নারী। তাতে তিনি অভিযোগ করেন, গত জানুয়ারি থেকে তিন হাজার টাকা বেতনে রনি আক্তার তানিয়া শহীদুল্লাহর বাড়িতে গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করতেন। প্রথম দুই মাস বেতন ঠিকমতো দিলেও মার্চ থেকে জুলাই পর্যন্ত তাঁর বেতন বকেয়া ছিল। ১২ আগস্ট বকেয়া টাকা চাইলে ওই সপ্তাহের মধ্যে টাকা পরিশোধের প্রতিশ্রুতি দেন শহীদুল্লাহ। ২৩ আগস্ট রাতে বকেয়া বেতন চাইতে গেলে শহীদুল্লাহ তানিয়াকে চড়থাপ্পড় মারেন। একপর্যায়ে তাঁর শ্যালক মোহাম্মদ কায়সার আনোয়ার তাঁকে ছুরি দিয়ে আঘাত করেন।

তবে শহীদুল্লাহর স্বজনেরা বলছেন, রনি আক্তার তানিয়া নামের কেউ তাঁদের বাড়িতে গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করতেন না। হয়রানি করতেই প্রতিপক্ষের লোকজন তাঁকে দিয়ে মিথ্যা মামলাটি করিয়েছিলেন। এ মামলায় গত ২৭ সেপ্টেম্বর গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন আদালত। পরোয়ানাটি ১ অক্টোবর চান্দগাঁও থানায় আসে। পরদিন পরোয়ানা তামিল করতে থানার এএসআই ইউসুফ আলীকে দায়িত্ব দেওয়া হয়।

মৃত শহীদুল্লাহর ছেলে নাফিস শহীদ বলেন, সম্পত্তি নিয়ে তাঁদের সঙ্গে প্রতিবেশীর বিরোধ রয়েছে। তাঁরা ওই নারীকে দিয়ে মিথ্যা মামলা করিয়েছেন।