সাভারে পরমাণু শক্তি কমিশনের ভবনটি নির্মিত হচ্ছিল অনুমোদন ছাড়াই

ভবন নির্মাণ করতে হলে রাজউক অথবা স্থাপত্য অধিদপ্তরের অনুমোদন নিতে হয়। এটি না করে নিজেদের নকশায় ভবনটি নির্মাণ করছিল পরমাণু শক্তি কমিশন।

সাভারে বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের নির্মাণাধীন ভবনের ছাদ ধসে পড়ে শুক্রবার বিকেলে
প্রথম আলো

সাভারে বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের নির্মাণাধীন যে ভবনের ছাদ ধসে পড়েছে, সেই ভবন নির্মাণে রাজউক বা স্থাপত্য অধিদপ্তর কারও কোনো অনুমোদন নেওয়া হয়নি। পরমাণু শক্তি কমিশন নিজেরা উদ্যোগ নিয়ে নকশা তৈরি করে ভবনটি নির্মাণ করছিল।

অন্যদিকে ভবনটির নির্মাণকাজেও গাফিলতি ছিল বলে মনে করেন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমন্ত্রী স্থপতি ইয়াফেস ওসমান। গতকাল শনিবার ভবনটি পরিদর্শন করেছেন তিনি। তাঁর মন্ত্রণালয়ের অধীন সংস্থা বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন।

ভবনটি পরিদর্শন শেষে ইয়াফেস ওসমান সাংবাদিকদের বলেন, পুরোটা দেখে বোঝা যাচ্ছে, কিছুটা গাফিলতি আছে। এখন সিদ্ধান্ত হয়েছে, ঠিকাদার ধসে যাওয়া অংশে নতুন করে কাজ করবে। পরবর্তী কাজগুলো যাতে ঠিকমতো হয় এবং এ ধরনের অঘটন যেন আর না হয়, সেটা নিশ্চিত করতে হবে। কারও দায় থাকলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তদন্ত কমিটি করা হয়েছে কি না, জানতে চাইলে ইয়াফেস ওসমান বলেন, ‘আমরা সবকিছু দেখলাম। তদন্ত কমিটির মাধ্যমে বিষয়টি আরও খতিয়ে দেখা হবে। এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি ভবন।’

গত শুক্রবার অনুমোদনহীন এই ভবনের ১০ তলার ছাদ ধসে অন্তত ১৬ জন আহত হন। আহত ব্যক্তিদের সবাই নির্মাণশ্রমিক।

পরমাণুপ্রযুক্তি প্রয়োগ করে ক্যানসার নির্ণয় ও চিকিৎসার পাশাপাশি গবেষণা ও প্রশিক্ষণের কাজে ওই ভবন ব্যবহার করার কথা রয়েছে। কিন্তু নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার আগেই ভবনের ১০ তলার ছাদ ধসে পড়েছে।

সরকারি কোনো সংস্থার অনুমোদন না নিয়ে যেভাবে ভবন নির্মাণ করছে, তা অত্যন্ত খারাপ দৃষ্টান্ত বলে মনে করেন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সভাপতি মোহাম্মদ ফজলে রেজা। তিনি বলেন, এর মাধ্যমে সাধারণ মানুষকে আইন না মানতে উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে।

পরমাণু শক্তি কমিশনের নির্মাণাধীন ভবনটির অবস্থান সাভারের গণকবাড়ী এলাকায়। এলাকাটি রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) অঞ্চল-১–এর আওতাধীন এবং সংস্থাটির প্রণয়ন করা ঢাকা মহানগর এলাকার বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনার (ড্যাপ) অন্তর্ভুক্ত। প্রচলিত ইমারত নির্মাণ বিধিমালা অনুসারে, ড্যাপে অন্তর্ভুক্ত কোনো এলাকায় যেকোনো ধরনের ভবন নির্মাণ করতে হলে রাজউক থেকে অনুমোদন নেওয়ার বাধ্যবাধকতা আছে।

রাজউকের বিকল্প হিসেবে ভবনের নির্মাণ অনুমোদন দেওয়ার এখতিয়ার আছে কেবল স্থাপত্য অধিদপ্তরের। ১৯৫২ সালের ইমারত নির্মাণ আইন অনুযায়ী, অধিদপ্তরের প্রধান স্থপতিকে এই ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে তিনি ‘অথরাইজড অফিসারের’ (দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা) দায়িত্ব পালন করেন। মূলত সরকারি প্রতিষ্ঠানের ভবনগুলো নির্মাণের ক্ষেত্রে তিনি এ দায়িত্ব পালন করেন, এ ক্ষেত্রে ভবনের নকশাটিও করে স্থাপত্য অধিদপ্তর।

নির্মাণাধীন ভবনটির ছাদ ধসের পর রাজউক ও স্থাপত্য অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সাভারের ওই ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে তাঁদের কাছ থেকে কোনো ধরনের অনুমোদন বা মতামত নেওয়া হয়নি। পরমাণু শক্তি গবেষণা কমিশন তাদের নিজস্ব পরামর্শকের মাধ্যমে নকশার কাজটি করেছে।

বিষয়টিকে নিয়মের ব্যত্যয় হিসেবে দেখছেন স্থাপত্য অধিদপ্তরের প্রধান স্থপতি মীর মনজুরুর রহমান। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, পরামর্শক দিয়ে কাজ করলেও পরমাণু শক্তি গবেষণা কমিশনের উচিত ছিল স্থাপত্য অধিদপ্তরের মাধ্যমে যাচাই করে নেওয়া। কিন্তু সেটিও করা হয়নি।

এদিকে রাজউকের সংশ্লিষ্ট এলাকার অথরাইজড অফিসার মেহেদী হাসান খান প্রথম আলোকে বলেন, ভবনটি নির্মাণে রাজউকের অনুমোদন নেওয়া হয়নি। রোববার (আজ) তাঁরা ভবনটি পরিদর্শনে যাবেন।

পরমাণু শক্তি কমিশনের একটি প্রকল্পের আওতায় ভবনটি নির্মাণ করা হচ্ছে। এই প্রকল্পের পরিচালক ও কমিশনের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মোহাম্মদ মঞ্জুর আহসান বলেন, ‘বেজমেন্টসহ ১০ তলা ভবনের অনুমোদন আছে। আমাদের আলাদা পরামর্শক আছেন, তাঁরা এটা করেছেন। স্থাপত্য অধিদপ্তরের অভিজ্ঞরা কমিটির মধ্যে আছেন। এ ছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েটের অভিজ্ঞ অনেকেই আছেন। আমাদের প্রকৌশলীরা সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণ করছেন, তবে কাজ মূলত করেন শ্রমিকেরা।’

এদিকে ছাদ ধসে আহত শ্রমিকদের মধ্যে দুজন হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। অন্যরা প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে বাড়ি ফিরেছেন। চিকিৎসাধীন দুজন হলেন খাইরুল ইসলাম (২৭) ও রাশেদুল ইসলাম (২৪)। তাঁরা গাজীপুরের শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব মেমোরিয়াল কেপিজি বিশেষায়িত হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আকতার মাহমুদ বলেন, অনুমোদন ছাড়া ভবন নির্মাণের জন্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে, আইন অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। রাজউককে এই কাজ করতে হবে এবং অনুমোদন ছাড়া ভবন নির্মাণের সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসতে হবে। এ ছাড়া সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে আহত শ্রমিকদের দায়দায়িত্ব নিতে হবে।