বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্প কারখানা এলাকার নদী, হ্রদ ও ট্যাপের পানিতে ভয়াবহ মাত্রার বিষাক্ত রাসায়নিক পাওয়া গেছে। এসব রাসায়নিকে ক্যানসারসহ বড় ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকি রয়েছে।
এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (ইএসডিও) এবং পরিবেশ ও স্বাস্থ্যবিষয়ক আন্তর্জাতিক এনজিওদের নেটওয়ার্ক আইপিইএনের একটি নতুন গবেষণায় এসব তথ্য ওঠে এসেছে। ‘পারসিসটেন্ট থ্রেট: পিএফএএস ইন টেক্সটাইলস অ্যান্ড ওয়াটার ইন বাংলাদেশ’ (ক্রমাগত হুমকি: বাংলাদেশের পোশাকশিল্প ও পানিতে পিএফএএস) শিরোনামের গবেষণা প্রতিবেদনটি চলতি মাসে প্রকাশিত হয়েছে।
বাংলাদেশের নদী, হ্রদ ও ট্যাপের পানিতে পার-অ্যান্ড পলিফ্লোরোলকিল সাবসটেন্সেস (পিএফএএস) আছে কি না, তা নিয়ে এটাই প্রথম গবেষণা। পিএফএএস সাধারণভাবে ‘ফরএভার কেমিক্যাল’ বা চিরস্থায়ী রাসায়নিক নামে পরিচিত।
এটাকে চিরস্থায়ী রাসায়নিক বলার কারণ হচ্ছে, পিএফএএস ব্যবহৃত পণ্য ফেলে দেওয়ার পর সেটির কার্যকারিতা নষ্ট হতে কয়েক শ এমনকি কয়েক হাজার বছরও লেগে যেতে পারে। পিএফএএস পানিতে মিশলে তা কয়েক শ বছর থেকে যায়। বিশ্বে মোট ব্যবহৃত পিএফএএসের ৫০ শতাংশ ব্যবহার করা হয় পোশাক শিল্প কারখানায়।
ইএসডিও এবং আইপিইএন গবেষণার জন্য ২০১৯ ও ২০২২ সালে রাজধানী ঢাকার তৈরি পোশাক কারখানার আশপাশের নদী, হ্রদ ও ট্যাপের পানির ২৭টি নমুনা সংগ্রহ করে। এসব নমুনায় পিএফএএসের যে মাত্রা পাওয়া গেছে, তা ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ও যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রক সংস্থার মাত্রার চেয়ে অনেক বেশি। কোনো কোনো নমুনায় বিশ্বে নিষিদ্ধ এক বা একাধিক রাসায়নিকও পাওয়া গেছে।
পিএফএএসে প্রায় ১০ হাজার রাসায়নিক রয়েছে। এসব রাসায়নিকের কয়েকটি ধরন ক্যানসারসহ নানা গুরুতর রোগের ঝুঁকি তৈরি করে। দীর্ঘদিন ধরেই এসব রাসায়নিক উৎপাদন খাতে ব্যবহার করা হচ্ছে। ১৯৫০-এর দশক থেকে নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোক্তা পণ্যেও ব্যবহার করা হচ্ছে পিএফএএসভুক্ত কিছু রাসায়নিক।
ইএসডিওর নির্বাহী পরিচালক সিদ্দিকা সুলতানা বলেন, ‘বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক তৈরি পোশাকশিল্পের একটি কেন্দ্র। এই খাত থেকে নিঃসরিত দূষিত রাসায়নিকের প্রাদুর্ভাব এখানকার বাসিন্দাদের উচ্চ ঝুঁকিতে ফেলছে। রপ্তানি পোশাকশিল্পকে আমাদের নদী, হ্রদ ও ট্যাবের পানিকে পিএফএএসে দূষিত করার ছাড়াপত্র দেওয়া কোনোভাবেই ঠিক হবে না।
স্টকহোম সনদের অধীনে কিছু পিএফএএসের ব্যবহার সারা বিশ্বে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। আর কিছু পিএফএএস নিষিদ্ধের বিষয়ে আলোচনা চলছে। এসব রাসায়নিক পর্যালোচনার পর্যায়ে রয়েছে। অবিরাম জৈব দূষণ থেকে মানুষের স্বাস্থ্য ও পরিবেশ রক্ষার উদ্দেশ্যেই বৈশ্বিক এই সনদ প্রণয়ন করা হয়েছে।
২৭টি নমুনার ২৭টিতেই বিভিন্ন মাত্রায় পিএফএএস পাওয়া গেছে। এসব নমুনার ৬৭ শতাংশের মধ্যে বিশ্বে নিষিদ্ধ এক বা একাধিক পিএফএএস রাসায়নিক পাওয়া গেছে। যেসব নমুনায় উচ্চমাত্রায় পিএফএএস পাওয়া গেছে, সেগুলো পোশাক কারখানার আশপাশের একই স্থান থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এর অর্থ হলো, দেশের পোশাকশিল্প পানিদূষণের একটি বড় উৎস।
অন্যদিকে ২০২২ সালে বড় ধরনের শিল্প কারখানা আছে, এমন ভাটি অঞ্চলের দুটি জলপথ থেকে সংগ্রহ করা নমুনায় উজান থেকে সংগৃহীত নমুনার তুলনায় বেশি পিএফএএস পাওয়া গেছে।
সর্বোচ্চ পিএফএএসের মাত্রা পাওয়া গেছে সাভারের কর্ণতলী নদী থেকে সংগৃহীত পানির নমুনায়। এতে পিএফএসের পরিমাণ ইইউর প্রস্তাবিত নির্ধারিত মাত্রা চেয়ে ৩০০ গুণ বেশি। এই নদী থেকে সংগৃহীত নমুনায় পিএফএএসের দুটি নিষিদ্ধ রাসায়নিকের ভয়াবহ মাত্রা পাওয়া গেছে।
এই দুটি রাসায়নিকের একটি হলো পার–ফ্লুরোওকটানোয়িক অ্যাসিড। নদীটিতে এই রাসায়নিকের মাত্রা নেদারল্যান্ডসের নির্ধারিত (ডাচ অ্যাডভাইজরি) সীমার চেয়ে ১ হাজার ৭০০ গুণ বেশি। একই নদীতে পাওয়া পার–ফ্লুরোওকটেন সালফোনেটের পরিমাণ ডাচ অ্যাডভাইজরি মাত্রার চেয়ে ৫৪ হাজার গুণের বেশি।
বাংলাদেশে পিএফএস নিয়ে এখনো সুনির্দিষ্ট কোনো আইন নেই। তাই গবেষণায় ইইউ, নেদারল্যান্ডস ও যুক্তরাষ্ট্রের মানদণ্ডের সঙ্গে পিএফএসের তুলনামূলক আলোচনা করা হয়েছে।
গবেষণার শীর্ষ গবেষক শাহরিয়ার হুসাইন বলেন, বাংলাদেশ বিপুল জনসংখ্যার ছোট একটি দেশ। জলাশয়গুলো দেশের সেচ, কৃষি, শিল্প ও পানীয় জলের প্রধান উৎস। গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, এসব জলাশয়ের পানি ভয়াবহ রকমের দূষণের শিকার। এটি এমন এক সমস্যা, যা মনোযোগের দাবি রাখে। স্টকহোম সনদের স্বাক্ষরকারী দেশ হিসেবে বাংলাদেশের পিএফএএস নিয়ে আইন করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে।