চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে (চমেক) এমবিবিএস প্রথম বর্ষে ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েও ভর্তি হতে না পারা বান্দরবানের সলিল কান্তি চক্রবর্তীর ৪৪ বছরের আইনি লড়াই শিগগিরই শেষ হচ্ছে না। এ নিয়ে বিপাকে পড়েছে চমেক কর্তৃপক্ষ। সলিল চক্রবর্তীকে দুই কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে আপিল বিভাগের সাম্প্রতিক রায়ের বিরুদ্ধে এখন রিভিউ করার প্রস্তুতি নিচ্ছে চমেক কর্তৃপক্ষ।
এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য গত শনিবার চমেকের একাডেমিক কাউন্সিলের বৈঠক বসে। বৈঠকে আপিল বিভাগের সিভিল আপিলের (১১৪/২০০৯) রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ দায়ের নিয়ে মতামত চেয়ে স্বাস্থ্যশিক্ষা বিভাগের সচিবের কাছে মতামত চাওয়ার সিদ্ধান্ত হয়।
জানতে চাইলে চমেক অধ্যক্ষ সাহেনা আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, সলিল চক্রবর্তীর বিষয়টি অনেক পুরোনো। তাঁর পক্ষে দেওয়া আপিল বিভাগের রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ চাওয়ার বিষয়ে স্বাস্থ্যশিক্ষা বিভাগের সচিবের মতামত জানতে চাওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। তাই বিষয়টি সচিবকে অবহিত করা হবে।
সলিলের আইনজীবী ইউনুস আলী আকন্দ বলেন, দুই কোটি টাকার ক্ষতিপূরণ চমেকের এখনকার অধ্যক্ষকে দিতে বলা হয়েছে। তবে কলেজ কর্তৃপক্ষ চাইলে রিভিউ করতে পারবে। রিভিউ করলে আইনিভাবে তা মোকাবিলা করা হবে।
আইনজীবী ও আদালত সূত্রে জানা যায়, ১৯৭৮-৭৯ শিক্ষাবর্ষে এমবিবিএস প্রথম বর্ষে ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিলেন সলিল চক্রবর্তী। কিন্তু সলিলকে ভর্তি হতে দেওয়া হয়নি। তাঁর বিরুদ্ধে উচ্চমাধ্যমিকের নম্বরপত্র জালিয়াতির অভিযোগ তুলে ফৌজদারি মামলার সুপারিশ করা হয়।
সলিল অভিযোগ মিথ্যা উল্লেখ করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এবং চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষের দপ্তরে ভর্তির জন্য আবেদন করেন। তবে শেষ রক্ষা হয়নি।
১৯৯৪ সালে তৎকালীন দুর্নীতি দমন ব্যুরোর সুপারিশে জালিয়াতির অভিযোগে সলিলের বিরুদ্ধে বান্দরবান থানায় মামলা করে পুলিশ। ২০০০ সালে এই মামলার রায়ে জালিয়াতির অভিযোগ থেকে সলিলকে বেকসুর খালাস দেন আদালত।
আদালতের রায় পক্ষে যাওয়ায় আবার মেডিকেলে ভর্তির চেষ্টা শুরু করেন সলিল চক্রবর্তী। এ জন্য ২০০৫ সালে তিনি চমেকসহ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে আইনি নোটিশ পাঠান। নোটিশে ১৫ দিনের মধ্যে তাঁর ভর্তির পদক্ষেপ নিতে অনুরোধ করা হয়। সাড়া না পেয়ে হাইকোর্টে রিট করেন সলিল।
এরপর ২০০৭ সালের ১ আগস্ট রায় দেন হাইকোর্ট। রায়ে রুল যথাযথ ঘোষণা করার পাশাপাশি ২০০৭-০৮ শিক্ষাবর্ষে সলিলকে ভর্তি করাতে নির্দেশ দেওয়া হয়। হাইকোর্টের রায়ের সময় সলিল কান্তির বয়স ছিল ৪৪ বছর। পরে হাইকোর্টের রায় স্থগিত চেয়ে আপিল বিভাগের চেম্বার আদালতে আবেদন করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। ওই আবেদনের শুনানির পর হাইকোর্টের রায় স্থগিত করা হয়। এরপর আপিল করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
গত ৩ মে বিচারপতি মো. নূরুজ্জামানের নেতৃত্বাধীন আপিল বেঞ্চ রাষ্ট্রপক্ষের আপিল খারিজ করে দেন। এর পাশাপাশি সলিলকে ক্ষতিপূরণ বাবদ দুই কোটি টাকাও দিতে বলেন সর্বোচ্চ আদালত। চমেকের অধ্যক্ষকে ক্ষতিপূরণের টাকা পরিশোধ করতে বলা হয়।
সলিল চক্রবর্তীর বয়স এখন ৬০ বছর পেরিয়েছে। বিয়ে করেননি, বান্দরবানে বসবাস করেন তিনি। ছয় ভাইয়ের মধ্যে তিনি তৃতীয়। ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন অধরা রয়ে যাওয়ার পর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিত বিভাগে ভর্তি হন সলিল। সেখান থেকে তিনি স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। পরে অর্থ বিভাগের একটি প্রতিষ্ঠানের প্রশাসনিক পদে চাকরি করেন তিনি।
চট্টগ্রাম মেডিকেলের বিরুদ্ধে দীর্ঘ আইনি লড়াইয়ের বিষয়ে সলিল চক্রবর্তী প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিলাম। তারপরও আমাকে এমবিবিএসে ভর্তি হতে দেওয়া হয়নি। আমার সনদ জাল বলে অভিযোগ তুলে চমেকের তখনকার অধ্যক্ষ আবুল হোসেন আমার ভর্তি কার্যক্রম বাতিল করে দেন। আমার বিরুদ্ধে মামলা করেন।’
সলিল চক্রবর্তী আরও বলেন, ‘আমি বারবার বলেছি, আমার সনদ জাল নয়। দীর্ঘদিন আদালতে লড়ে জিতেছি। রায়ের কপি হাতে নিয়ে ভর্তি হতে গেলে আমাকে সেই সুযোগ দেওয়া হয়নি। আবারও আদালতের দ্বারস্থ হতে হয়েছে। এত বছর পর এসে আপিল বিভাগও আমার পক্ষে রায় দিয়েছেন। আমাকে ক্ষতিপূরণ দিতে চমেক অধ্যক্ষকে নির্দেশ দিয়েছেন।’
তবে জিতেও যেন লড়াই শেষ হচ্ছে না সলিলের। আপিল বিভাগের রায়ের ওপর রিভিউ আবেদন করতে চাইছে চমেক কর্তৃপক্ষ। এ বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে সলিল চক্রবর্তী বলেন, ‘রিভিউ করলে করুক। এতে আমার আরও ভালো হবে। এর ফলে ক্ষতিপূরণের টাকা আরও বেশি পেতে পারি।’