পাইকারি পর্যায়ে চালের দাম এক টাকা কমলেও খুচরায় প্রভাব নেই
পাইকারি পর্যায়ে চালের দাম এক টাকা কমলেও খুচরায় প্রভাব নেই

চালের দাম বেশি বেড়ে সামান্য কমল

দিনাজপুর শহরের বাহাদুর বাজারে গতকাল শুক্রবার সকালে চাল কিনতে যান রিকশাচালক মোসলেম আলী। চালের দাম কেজিতে এক–দুই টাকা কমার খবরে তাঁর কথা, ‘৫০ টাকা কেজির চাল ৪৮ টাকা হয়েছে, এটাকে কি দাম কমা বলে?’

গত মঙ্গলবার ঢাকাসহ সারা দেশে মজুতবিরোধী অভিযান শুরু করেছে খাদ্য অধিদপ্তর। এ অভিযানের ফলে কোথাও কোথাও ধান ও চালের দাম কিছুটা কমেছে। তবে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, আগেই উচ্চ মূল্যে থাকা চালের দাম কমেছে সামান্যই। দিনাজপুরে ১০ দিনের ব্যবধানে মিনিকেট চাল কেজিতে সাড়ে ৯ টাকা বাড়লেও অভিযানের পর কমেছে দেড় টাকা। বগুড়ায় পাইকারিতে চাল এক টাকা কমলেও খুচরায় প্রভাব নেই।

দিনাজপুরে এক দিনের ব্যবধানে চালের দাম প্রকারভেদে কেজিতে কমেছে দেড় থেকে তিন টাকা। ১০ দিনের ব্যবধানে কেজিতে ৬ থেকে ৯ টাকা বাড়লেও সে তুলনায় দাম কমেনি। গতকাল সকালে শহরের বাহাদুর বাজারে চালের বাজার ঘুরে দেখা যায়, প্রতি কেজি মিনিকেট চাল বিক্রি হয়েছে ৬৬ টাকায়, এক দিন আগেও যা ছিল সাড়ে ৬৭ টাকা। ১০ দিন আগেও মিনিকেট বিক্রি হয়েছে প্রতি কেজি ৫৮ টাকা। হিসাব অনুযায়ী মিনিকেট চালের বাজার বেড়েছিল সাড়ে ৯ টাকা। অভিযানের পর সেই চালের দাম কমেছে মাত্র দেড় টাকা। 

এভাবে ব্রি-২৮ জাতের চালের কেজি ৫৩ থেকে বেড়ে ৫৮ টাকা হলেও সর্বশেষ গতকাল বিক্রি হয়েছে ৫৫ টাকায়, ব্রি-২৯ চাল ৪৮ থেকে বেড়ে ৫৩ টাকা হলেও গতকাল বিক্রি হয়েছে ৫১ টাকায়, সুমন স্বর্ণ ৪৭ থেকে বেড়ে ৫০ টাকা হলেও গতকাল বিক্রি হয়েছে ৪৮ টাকায়। তবে এ ক্ষেত্রে গুটি স্বর্ণা চালের বাজার ব্যতিক্রম। এ চাল ৪৫ থেকে ২ টাকা বেড়ে ৪৭ টাকা হলেও গতকাল বিক্রি হয়েছে ৪৪ টাকা ৪০ পয়সা কেজি। অর্থাৎ আগের দামের চেয়ে ৬০ পয়সা কমেছে। 

চালের দাম বাড়া-কমার বিষয়ে বাহাদুর বাজারের খাদ্যভান্ডারের স্বত্বাধিকারী আলালউদ্দিন ব্যাপারী বলেন, চালের দাম বাড়া শুরু করেছে নির্বাচনের পরের দিন থেকে। ২ হাজার ৯০০ টাকা বস্তার মিনিকেট হয়ে গেল ৩ হাজার ৩০০ টাকা। অভিযানে নামার পর বস্তাপ্রতি ১০০ টাকা কমল। তিনি বলেন, কিছু কুচক্রী মিলমালিক ধাপে ধাপে চালের দাম বাড়িয়েছেন। তিনি বলেন, এ ক্ষেত্রে মিলারদের আইনের আওতায় আনা উচিত।

বাংলাদেশ অটো, মেজর ও হাসকিং মিল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সহসভাপতি আদর অ্যান্ড মমতা অটো রাইস মিলের স্বত্বাধিকারী সহিদুর রহমান পাটোয়ারি বলেন, স্টক ব্যবসার নামে নিবন্ধনবিহীন একশ্রেণির মজুতদার যাঁরা চাল কিনে মজুত করেছেন এবং আরও মজুত করতে চাইছেন। এ ধরনের অভিযানের কারণে তাঁরা বেকায়দায় পড়েছেন। ফলে চালের বাজার কমতে শুরু করেছে। এ ছাড়া খুচরা ব্যবসায়ীদের অতি মুনাফার প্রবণতার কারণে দাম বেড়েছিল। 

বগুড়ায় চালের খুচরা বাজারে প্রভাব পড়েনি

উত্তরের চালের বড় মোকাম বগুড়ার দুপচাঁচিয়া উপজেলার তালোড়া বাজার। এই মোকাম থেকে ঢাকাসহ সারা দেশে চাল সরবরাহ করা হয়।

তালোড়া বাজারের গৌরব অটো রাইসমিলের স্বত্বাধিকারী সুভাষ প্রসাদ কানু বলেন, জানুয়ারির শুরু থেকেই বাজারে ধানের সরবরাহ কমে যাওয়ায় চালের বাজার অস্থির হয়ে ওঠে। তিন দিন আগে দুপচাঁচিয়ার ইউএনওর নেতৃত্বে এই মোকামে বিভিন্ন চালকলের গুদামে অভিযান চালানো হয়। পরদিন থেকেই বাজারে ধানের সরবরাহ বেড়ে যায়। সরবরাহ বাড়ায় প্রতি মণ ধানের দাম ২০ টাকা পর্যন্ত কমে এখন স্বর্ণা-৫ জাতের মোটা ধান ১ হাজার ২৮০ টাকা মণ বিক্রি হচ্ছে। পাইকারি পর্যায়ে মোটা চাল এখানে ৪৬ থেকে ৪৭ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে। গত সপ্তাহে মোটা চাল পাইকারি পর্যায়ে এখানে ৪৮ টাকা কেজি বিক্রি হয়েছে।

তবে পাইকারি পর্যায়ে চালের দাম এক টাকা কমলেও খুচরায় প্রভাব নেই। উল্টো এক সপ্তাহের ব্যবধানে খুচরা বাজারে চালের দাম কেজিতে আরও তিন থেকে সাত টাকা বেড়েছে।

বগুড়া শহরের রিকশাচালক গোফফার আলী। তাঁর পরিবারে ছয় সদস্য। প্রতিদিন গড়ে তিন কেজি চাল লাগে। আগে ১২০ টাকায় এক দিনের চাল কেনা যেত। এখন ৩০ টাকা বেশি লাগে। বললেন, চাল কিনতে প্রতি মাসে তাঁর সংসার খরচ বেড়েছে গড়ে ১ হাজার টাকা।

গত মঙ্গলবার ঢাকাসহ সারা দেশে মজুতবিরোধী অভিযান শুরু করেছে খাদ্য অধিদপ্তর। এ অভিযানের ফলে কোথাও কোথাও ধান ও চালের দাম কিছুটা কমেছে। তবে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, আগেই উচ্চ মূল্যে থাকা চালের দাম কমেছে সামান্যই।

‘এভাবে ধানের দাম ওঠানামা করলে ক্যামনে চলবে’

তিন দিনের ব্যবধানে নওগাঁর বাজারে প্রতি মণ ধানের দাম কমেছে ৬০ থেকে ২০০ টাকা। আর পাইকারি বাজারে চালের দাম কেজিতে কমেছে ১ থেকে ২ টাকা। তবে খুচরা বাজারে এখনো আগের দামেই চাল বিক্রি হচ্ছে।

নওগাঁর অন্যতম বড় ধানের মোকাম নিয়ামতপুর উপজেলার ছাতড়া বাজার। এ বাজারে সপ্তাহে প্রতিদিন ধান কেনাবেচা হয়। গতকাল এই বাজারে প্রতি মণ মোটা জাতের স্বর্ণা-৫ ও স্বর্ণা-৫১ (হাইব্রিড স্বর্ণা) ধান মানভেদে ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ২১০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। তিন দিন আগেও এসব ধান বিক্রি হয়েছে ১ হাজার ২৬০ থেকে ১ হাজার ২৭০ টাকা মণ। সরু জাতের জিরা ও কাটারি ধান বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ৩২০ থেকে ১ হাজার ৩৩০ টাকায়। তিন দিন আগে প্রতি মণ জিরা ও কাটারি ধানের দাম ছিল ১ হাজর ৪৫০ থেকে ১ হাজার ৪৬০ টাকা।

মহাদেবপুর উপজেলার সারথা গ্রামের কৃষক আকবর আলী এসেছিলেন ধান বিক্রি করতে। কত দামে ধান বিক্রি করলেন—এমন প্রশ্নের জবাবে মলিন মুখে তিনি বলেন, ‘আর কইয়েন না ভাই। রোববারই এই বাজারে প্রতি মণ চিনিগুঁড়া ধান বিক্রি করে গেছি ২ হাজার ৫০০ টাকায়। আজ সেই ধান বিক্রি করতে হলো ২ হাজার ৩০০ টাকায়। চার দিনের মধ্যে ২০০ টাকা নাই হয়ে গেছে। এভাবে ধানের দাম ওঠানামা করলে ক্যামনে চলবে।’

কারওয়ান বাজারে তিন রকম দাম

গতকাল সন্ধ্যায় রাজধানীর কারওয়ান বাজারের তিনটি পাইকারি দোকানে খোঁজ নেয় প্রথম আলো। দোকান তিনটির মূল্যতালিকায় দেখা যায়, একই চালের দাম তিন দোকানে তিন রকম। যেমন আটাশ চাল প্রতি কেজি এক দোকানে বিক্রি হচ্ছে ৫২ টাকায়, আরেক দোকানে ৫৩ টাকায় এবং অন্য দোকানে ৫৪ থেকে ৫৬ টাকায়।

অন্য চালের দামেও ভিন্নতা দেখা যায়। দুই দোকানে মূল্যতালিকায় মিনিকেট চালের কেজি ৬৬ টাকা এবং আরেকটি দোকানে ৬৬ থেকে ৬৮ টাকা বিক্রি হচ্ছে। 

ভিন্ন ভিন্ন দামের প্রসঙ্গে পাইকারি দোকানদারেরা বলছেন, তাঁদের কারও কারও পুরোনো চাল রয়ে গেছে, তাই তাঁরা আগের দামেই বিক্রি করছেন। আবার কেউ কেউ নতুন চাল তুলেছেন। তাই নতুন দামে তাঁদের বিক্রি করতে হচ্ছে।

[প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন নিজস্ব প্রতিবেদক, বগুড়া, প্রতিনিধি, দিনাজপুরনওগাঁ]