একটু বৃষ্টি হলেই মেহেদীদের ঘর পানিতে ডুবে যায়
একটু বৃষ্টি হলেই মেহেদীদের ঘর পানিতে ডুবে যায়

গুলিতে নিহত ছেলে-স্বামী, ঘরে অভাব, কী করবেন জানেন না তাঁরা

বাড়ি বাড়ি ঘুরে ময়লা সংগ্রহের পর গাড়িতে ভরে তা নির্দিষ্ট জায়গায় ফেলার কাজ করেন মেহের আলী। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান চলাকালে তিনি তাঁর উপার্জনক্ষম ছেলে মেহেদী হাসানকে হারিয়েছেন। একই রকমভাবে কিশোর বয়সী ছেলে শাহাদাত হোসেনকে হারিয়েছেন ফুটপাতের হালিম বিক্রেতা বাছির আলম। হালিম বিক্রির কাজে বাবাকে সাহায্য করত শাহাদাত। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান চলাকালে গুলিতে নিহত ৪৫ বছর বয়সী মো.আক্কাস আলীর পরিবারও এখন নিঃসহায়। জর্দার কৌটা বানানোর কারখানায় কাজ করা আক্কাসের আয়ের টাকাতেই তাঁর সংসার চলত।

যাত্রাবাড়ীর ধোলাইপাড় ও কুতুবখালী এলাকার স্বজন হারানো এই তিন পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা হয় গত সোমবার। মেহেদী, শাহাদাত ও আক্কাস আলী তিনজনই ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান চলাকালে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হয়েছেন। তাঁদের পরিবারের সদস্যরা বলছেন, আর্থিক অনটনে তাঁরা হারানো স্বজনের জন্য শোক করারও ফুরসত পাচ্ছেন না।

দক্ষিণ কুতুবখালীতে মূল গেট দিয়ে ঢুকে আবার আরেকটি ছোট দরজা দিয়ে মাথা নিচু করে মেহেদীদের বাসায় ঢুকতে হয়। গত সোমবার সেখানে গিয়ে দেখা যায়, দিনের বেলাতেও ঘরের ভেতর অন্ধকার হয়ে আছে। একটু বৃষ্টি হলেই ঘর পানিতে ডুবে যায়। বৃষ্টির পানি ঘর থেকে বের করতেও লেগে যায় কয়েক দিন। সোমবার কড়া রোদ থাকলেও মেহেদীদের দুটি ঘর পানিতে ভিজে আছে। দুই–তিন দিন আগের বৃষ্টির সময় ঘরের সঙ্গে লাগোয়া শৌচাগার থেকেও ঘরে পানি ঢুকেছিল।

মর্গের ফ্রিজ খুলে ছেলের লাশ খুঁজে পান মা

মেহেদী হাসান গত ১৯ জুলাই বিকেল পাঁচটার দিকে যাত্রাবাড়ী থানার কুতুবখালী এলাকায় গুলিবিদ্ধ হয়। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের জুরাইন কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়। জন্মনিবন্ধন সনদ অনুযায়ী, ২০০৭ সালের ১৪ জুলাই মেহেদীর জন্ম। অর্থাৎ, তার বয়স ১৭ বছর। তবে ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের নথিতে মেহেদীর বয়স ২০ বছর লেখা হয়েছে।

দক্ষিণ কুতুবখালীতে মূল গেট দিয়ে ঢুকে আবার আরেকটি ছোট দরজা দিয়ে মাথা নিচু করে মেহেদীদের বাসায় ঢুকতে হয়। গত সোমবার সেখানে গিয়ে দেখা যায়, দিনের বেলাতেও ঘরের ভেতর অন্ধকার হয়ে আছে। একটু বৃষ্টি হলেই ঘর পানিতে ডুবে যায়। বৃষ্টির পানি ঘর থেকে বের করতেও লেগে যায় কয়েক দিন। সোমবার কড়া রোদ থাকলেও মেহেদীদের দুই কক্ষের বাসা পানিতে ভিজে ছিল। দুই–তিন দিন আগের বৃষ্টির সময় ঘরের সঙ্গে লাগোয়া শৌচাগার থেকেও ঘরে পানি ঢুকেছিল।

মেহের আলীর ছিল তিন ছেলে ও এক মেয়ে। মেয়ের বিয়ে হয়েছে। মেহের আলী স্ত্রী, তিন ছেলে, মা আর শারীরিক প্রতিবন্ধী শ্বশুরকে নিয়ে থাকতেন। মেহেদীই ছিলেন মেহের আলীর ভরসা। মেহেদী একটি কারখানায় কাজ করত। মেহের আলী ময়লার গাড়ি টেনে মাসে পান ৯ হাজার টাকা। আর মেহের আলীর শ্বশুরকে একজন একটি হুইলচেয়ার দিয়েছিলেন, সেই হুইলচেয়ারে বসে গেটের কাছে ভিক্ষা করেন।

মেহেদী হাসান গত ১৯ জুলাই বিকেল ৫টার দিকে যাত্রাবাড়ী থানার কুতুবখালী এলাকায় গুলিবিদ্ধ হন

মেহেদীর মা পারভীন আক্তার বাতজ্বর, ডায়াবেটিসসহ নানা অসুখে ভুগছেন। বললেন, গত কয়েক বছরে মেহেদীর বেতনের টাকা দিয়েই তাঁর ওষুধ কেনা হচ্ছিল। বলতে গেলে মেহেদীই সংসারটাকে আগলে রাখত। সেই ছেলে মারা যাওয়ায় এখন সংসার চালানোই কঠিন হয়ে যাচ্ছে। মেহেদী মারা যাওয়ার পর পাঁচ হাজার টাকা ঘরভাড়াসহ অন্যান্য খরচ সামলানোর জন্য সপ্তম শ্রেণিতে পড়ুয়া তার এক ভাইয়ের পড়াশোনা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ওই ভাই এখন একটি ছিটকিনি কারখানায় কাজ করে পাঁচ হাজার টাকা বেতন পাচ্ছে। ছেলে পড়াশোনায় ভালো ছিল, একটি ক্রেস্টও পেয়েছিল তা দেখালেন মেহের আলী।

পারভীন আক্তার বললেন, ১৮ জুলাই আন্দোলনে অংশ নিয়ে মেহেদীর হাতে ছররা গুলি লেগেছিল। ১৯ জুলাই ছেলে যাতে ঘর থেকে বের হতে না পারে তাই মেহের আলী দরজায় তালা দিয়ে রেখেছিলেন। তবে মেহেদী আন্দোলনে যাওয়ার জন্য জেদ করতে থাকে। লোহার তাওয়া দিয়ে দরজা-জানালায় আঘাত করতে থাকে। পরে পারভীন আক্তারই ছেলেকে বাইরে যেতে অনুমতি দিয়েছিলেন।

ছেলে দেখতে খুব সুন্দর ছিল উল্লেখ করে পারভীন আক্তার বললেন, ‘আমার পুতের বুকের মধ্যে এক সাইডেই তিনটি গুলি করে। এখন আর জানালা বা দরজায় দাঁড়ায়ে মা বলে কেউ ডাক দেয় না। পেছন দিয়া জাপটে ধরে না। সংসার আগলে রাখা পুতটারেই ওরা মাইরা ফালাইছে।’

শাহাদাতের লাশ দাফন করা হয় নোয়াখালীর গ্রামের বাড়িতে। শাহাদাতের বড় ভাই মো. হানিফ জানালেন, তাঁরা দুই ভাইই আন্দোলনে যেতেন। ৫ আগস্ট তাঁর পায়েও ছররা গুলি লাগে। যাত্রাবাড়ী থানার সামনে গুলিতে একজন মারা গেলে ওই লাশ রিকশা করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান হানিফ। মেডিকেল থেকে ফেরার পর জানতে পারেন তাঁর নিজের ভাইই গুলিতে মারা গেছে।

১৯ জুলাই বাইরে বের হওয়ার আগে মেহেদী গোসল করে, ভাত খায়। বাইরে বের হওয়ার ১০ মিনিটও পার হয়নি, এর মধ্যেই খবর আসে মেহেদী গুলিবিদ্ধ হয়েছে। পারভীন আক্তার ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যাওয়ার পর ছেলের নাম বললে তাঁকে হাসপাতালের মর্গে যেতে বলা হয়।

পারভীন আক্তার বললেন, ছেলের লাশ পেতেও তাঁদের অনেক ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে। তাঁর অভিযোগ, প্রথম দিন যাত্রাবাড়ী থানায় গেলে পুলিশ তাঁকে ধাক্কা দিয়ে বের করে দিয়েছিল। ২০ তারিখে আবার যাত্রাবাড়ী থানায় গেলে পুলিশ শাহবাগ থানায় যেতে বলে। ২১ জুলাই রাত আটটায় ছেলের লাশ হাতে পান। এর আগে হাসপাতালের মর্গের ফ্রিজে ছেলের লাশ খুঁজতে থাকেন। একটি ফ্রিজ খুলে ছেলের পা দেখেই এই মা চিনে ফেলেন, এটিই তাঁর ছেলে।

শাহাদাতের মা ও বাবা হালিম তৈরি করছেন। এ হালিম বিক্রি করেই সংসার চলে তাঁদের

ছেলের লাশ তড়িঘড়ি করে দাফন করতে হয় জানিয়ে পারভীন আক্তার বলেন, ছেলে মারা যাওয়ার পর তাঁর স্বামীকে ধরতে এলাকায় পুলিশ এসেছিল। এই মায়ের আক্ষেপ, ময়নাতদন্তের জন্য ছেলের লাশ কাটাকাটি করা হয়েছে, তখন না জানি ছেলে কত কষ্ট পেয়েছে।

পারভীন আক্তার ক্ষোভ প্রকাশ করে বললেন, ‘আমার ছেলে আন্দোলনে গেছিল। হুদাহুদি ছেলেটারে হত্যা করছে। আমি এর বিচার চাই। আর চাই সরকার যেন আমারে একটু সহায়তা করে।’

বাবাকে হালিমের দোকানে কাজে সাহায্য করত শাহাদাত

মারা যাওয়ার সময় শাহাদাত হোসেনের বয়স ১৪ বছরও হয়নি। শাহাদাতের বাবা বাছির আলম জানালেন, ৫ আগস্ট গুলিতে মারা যাওয়ার সময় ছেলের বয়স হয়েছিল ১৩ বছর ১ মাস ২০ দিন। বাছির আলমের চার ছেলের মধ্যে এখন আছে তিন ছেলে ও এক মেয়ে। মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। ধোলাইপাড় উচ্চবিদ্যালয়ের কাছে দুই কক্ষের বাসায় এক কক্ষে বড় ছেলে মো. হানিফ স্ত্রী ও এক সন্তান নিয়ে থাকেন। অন্য কক্ষে বাছির স্ত্রী ও ছেলেদের নিয়ে থাকেন। বারান্দায় বড় বড় পাতিলে হালিম রান্না করেন। পরে ভ্যানে করে যাত্রাবাড়ী বড় মাদ্রাসার সামনে নিয়ে তা বিক্রি করেন। শাহাদাত ছিল ভাইবোনদের মধ্যে সবার ছোট। স্কুল ও মাদ্রাসায় ভর্তি করলেও পড়া হয়নি শাহাদাতের।

বাছির আলম জানালেন, ভ্যানে করে হালিম বিক্রির সময় শাহাদাত তাঁকে সহায়তা করত। সেই ছেলে মারা যাওয়ায় এখন আর আগের মতো হালিম বানাতে উৎসাহ পাচ্ছেন না তিনি। ফলে ব্যবসায় মন্দা যাচ্ছে। এদিকে ঘরভাড়া বাকি পড়েছে।

বাবাকে হালিম তৈরির কাজে সহযোগিতা করত কিশোর শাহাদাত হোসেন

শাহাদাতের লাশ দাফন করা হয় নোয়াখালীর গ্রামের বাড়িতে। শাহাদাতের বড় ভাই মো. হানিফ জানালেন, তাঁরা দুই ভাইই আন্দোলনে যেতেন। ৫ আগস্ট তাঁর পায়েও ছররা গুলি লাগে। যাত্রাবাড়ী থানার সামনে গুলিতে একজন মারা গেলে ওই লাশ রিকশা করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান হানিফ। মেডিকেল থেকে ফেরার পর জানতে পারেন তাঁর নিজের ভাইই গুলিতে মারা গেছে।

শাহাদাতের মাথায় আর হাতে গুলি লাগে। সেদিনের দুটি ভিডিও ফুটেজ দেখালেন হানিফ। একটিতে দেখা যায়, যাত্রাবাড়ীর ফ্লাইওভারের ওপরে গুলি লাগার পর শাহাদাত রাস্তায় পড়ে আছে, আর একটি ভিডিওতে শাহাদাতকে কয়েকজন ধরে হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছে।

বাছির আলমকে ছয় মাস যক্ষ্মা রোগের জন্য চিকিৎসা নিতে হয়েছে। বললেন, ‘ছেলে মরছে দুই মাসের বেশি হইল। আমি শক্তি হারাই ফেলছি। সোনার টুকরা ছেলে ছিল আমার। আমার ছেলেরে যারা মারছে, তাদের শাস্তি চাই। বাবার কাঁধে সন্তানের লাশ কত ভারী, তারা কেমনে বুঝব?’

গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন আক্কাস আলী

সংসার কীভাবে চলবে, জানেন না আক্কাস আলীর স্ত্রী

মো. আক্কাস আলী জর্দার টিনের কোটা বানানোর একটি কারখানায় কাজ করে মাসে ১৩ হাজার টাকা বেতন পেতেন। একমাত্র ছেলে আবদুর রব মাদ্রাসায় পড়ছেন। তিনি টিউশনি করে তিন হাজার টাকা পান। এই ছিল পরিবারটির আয়ের উৎস। যাত্রাবাড়ীর ধোলাইপাড়ের বাসাভাড়াসহ অন্যান্য খরচ এভাবেই চলত।

৫ আগস্ট যাত্রাবাড়ী থানার কাছে গুলিতে আক্কাস আলী মারা যান। স্ত্রী লাভলী আক্তার বললেন, ‘একমাত্র আমি জানি, আমার সংসার কেমনে চলতাছে। মা-ছেলে একবেলা খাই তো আরেকবেলা খাই না। বাসাভাড়া বাকি আছে। আমার বা স্বামীর পরিবারের আর্থিক অবস্থাও ভালো না।’

লাভলী আক্তার আরও বলেন, ‘আমার স্বামী আন্দোলনে গেছে। জীবিত গিয়ে মৃত হয়ে ফিরবে, তা তো ভাবি নাই। বিভিন্ন সংগঠন কিছু দিলেও সরকারের কাছ থেকে কোনো সাহায্য পাই নাই। সরকার যেন আমার ছেলেটার দিকে তাকিয়ে কিছু একটা করে।’

৫ আগস্ট কারখানা থেকে দুপুরে বাসায় ফেরেন আক্কাস আলী। লাভলী আক্তার জানালেন, স্বামী বাসায় ফিরে বলেছিলেন তাঁর ভালো লাগছে না। আন্দোলনের জন্য কারখানার কাজ একদম কমে গেছে। সেদিন আক্কাস আলী ভাত খেয়ে ছেলেকে সঙ্গে নিয়েই বাসা থেকে বের হন। মানুষের ভিড়ে ছেলে একদিকে আর তিনি একদিকে চলে যান।

লাভলী আক্তার বলেন, স্বামী গুলি খাইছে শুনে প্রথমেই মনে হয় ছেলের শরীরেও গুলি লাগল কি না। তারপর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে এক স্বজন স্বামী মারা গেছেন বলে জানান।

আক্কাস আলীর স্ত্রী ও ছেলে

লাভলী বললেন, ‘স্বামী মারা গেছে শোনার পর তো আমার আর কোনো হুঁশ ছিল না। স্বামী তো জানত না এভাবে মারা যাবেন। সঞ্চয় বলতেও তো কিছু করেননি।’

আক্কাস আলীকে জুরাইন কবরস্থানে দাফন করা হয়। ১৮ বছর বয়সী ছেলে আবদুর রব জানান, সেদিন তাঁর মুঠোফোন বন্ধ ছিল। মাগরিবের আজানের পর মাদ্রাসায় গিয়ে জানতে পারেন তাঁর বাবা গুলিবিদ্ধ হয়েছেন।

আবদুর রব জানালেন, তাঁর বাবার লাশের ময়নাতদন্ত হয়নি বলে মৃত্যুসনদ পাচ্ছেন না। এখন জুরাইন কবরস্থান থেকেও বলা হচ্ছে মৃত্যুসনদ দেখাতে না পারলে ‘স্ট্রোক’ করে মৃত্যু হয়েছে বলে লিখে দেওয়া হবে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আক্কাস আলীর লাশের সঙ্গে যুক্ত থাকা সাদা কাগজটিতে কোনো নাম উল্লেখ করা ছিল না। সেখানে একটি রেজিস্ট্রেশন নম্বর, তারিখ, সময় আর লেখা ছিল—অজানা বয়স।

আবদুর রব তাঁর বাবার রক্তাক্ত লাশের ছবি দেখালেন। সেদিনের ভিডিও আছে, তাতেও তাঁর বাবার লাশ দেখা যাচ্ছে।