আলোচনায় সভায় বক্তরা

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বিরুদ্ধ মত দমনের হাতিয়ার

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় কারাবন্দী অবস্থায় মারা যাওয়া লেখক মুশতাক আহমেদের দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকীর আলোচনা সভায় বক্তারা
ছবি: তানভীর আহাম্মেদ

সরকারের সমালোচনাকারীদের শায়েস্তা করতে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ব্যবহার করা হচ্ছে। এটি হয়ে উঠেছে বিরুদ্ধ মত দমনের হাতিয়ার। সংবিধানে দেওয়া বাক ও চিন্তার স্বাধীনতা এবং গঠনমূলক সমালোচনার অধিকারকে খর্ব করেছে এই আইন। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটি দেশের ইতিহাসের অন্যতম ‘বাজে’ আইন। এই আইন আসলে আইন নয়, অস্ত্র।

রাজধানীর ধানমন্ডির গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতাল মিলনায়তনে আজ শনিবার এক নাগরিক স্মরণসভায় বিশিষ্টজনেরা এসব কথা বলেন। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় কারাবন্দী অবস্থায় মারা যাওয়া লেখক মুশতাক আহমেদের দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকীতে এই সভার আয়োজন করা হয়।

সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন আসলে আইন নয়, অস্ত্র। বাক্‌স্বাধীনতা, চিন্তার স্বাধীনতা, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা হরণ করা হচ্ছে এই অস্ত্র ব্যবহার করে। এই আইনের কারণে সবাই ঝুঁকিতে আছেন। সবাই এর সম্ভাব্য ভুক্তভোগী। জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে আরও নতুন কালো আইন করা হচ্ছে।

সভাপতির বক্তব্যে নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, এখন নির্যাতন-নিপীড়ন করতে আইনের প্রয়োজন হয় না। বর্তমান সরকার কোনো কিছুর তোয়াক্কা করে না। শুধু ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল করলেই লড়াইয়ে জেতা যাবে না। অন্য আইন হবে না, রাষ্ট্রক্ষমতায় নতুন সরকার এলে তারা আরও এমন আইন করবে না, তার নিশ্চয়তা নেই। তাই রাষ্ট্রক্ষমতায় কারা যাচ্ছে, সেটি নির্ধারণের পদ্ধতিতেও সংস্কার আনতে হবে।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের কারণে জনগণ ভয়ে থাকছে বলে মন্তব্য করেন তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইনে কারাবন্দী হওয়া আলোকচিত্রী শহিদুল আলম। তিনি বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ভয়ের, আতঙ্কের। জনগণ এই আইনের কারণে নিরাপদ বোধ করে না। যাঁরা শাসকগোষ্ঠীর ঘনিষ্ঠ, তাঁরা এই আইনের কারণে নিরাপদ থাকেন। তাঁদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে যেন কেউ কিছু বলতে না পারেন, সে জন্য এই আইন ব্যবহার করা হচ্ছে। সভ্য দেশে এমন আইন থাকতে পারে না।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনকে বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে ‘জঘন্য’ আইন বলে উল্লেখ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক আসিফ নজরুল। তিনি বলেন, এই আইনে অপরাধের যে সংজ্ঞা, তা অনেক ঢিলেঢালা, ফলে ইচ্ছেমতো ব্যবহার করা যায়। পুলিশকে অবাধে তল্লাশি করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। আইনের ধারাকে জামিন অযোগ্য করা হয়েছে। তিনি বলেন, যাঁরা রিজার্ভের টাকা চুরি করেন, গুম করেন, দিনের ভোট রাতে করেন, এটি তাঁদের রক্ষার আইন। যাঁরা অন্যায়ের প্রতিবাদ করবেন, তাঁদের শায়েস্তা করার আইন।

সরকার ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনকে বিরুদ্ধ মত দমনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে বলে মন্তব্য করেন বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। তিনি বলেন, যাঁরা সমালোচনা করছেন, এই আইন ব্যবহার করে তাঁদের শায়েস্তা করা হচ্ছে। সংবিধানে দেওয়া গঠনমূলক সমালোচনার অধিকার, চিন্তার স্বাধীনতাকে খর্ব করেছে এই আইন।

সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, আসল অপরাধীরা পাহাড় কাটছেন, জলাভূমি দখল করছেন, বন উজাড় করছেন, বালু তুলছেন, তাঁদের কিছু হচ্ছে না। ফেসবুকে সমালোচনা করে এক লাইন লিখলেই কারাবরণ করতে হচ্ছে। এ কেমন স্বাধীন দেশ। এই আইন নাগরিকদের স্বাধীনতাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করছে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মানস চৌধুরী বলেন, এই আইন না থাকলেও ভুক্তভোগীদের কেউ তুলে নিয়ে গিয়ে শায়েস্তা করতে পারত। আইন আসলে বিষয় না, কেউ ভুক্তভোগীদের শায়েস্তা করতে চেয়েছিল, এটাই আসল বিষয়। এই আইন না থাকলেও সরকার ভিন্ন নামে, ভিন্ন রূপে নতুন কোনো নিবর্তনমূলক আইন করে নেবে।

গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি বলেন, ‘সরকার ক্ষমতায় থাকতে সব ধরনের কায়দাকানুন, ফন্দিফিকির ব্যবহার করছে। কতিপয় মাফিয়ার রাজত্বের মতো রাষ্ট্র চলছে। তাঁদের নিরাপত্তা দিতে নানা আইন হচ্ছে। সমালোচনাকারীদের একজনকে শিক্ষা দিয়ে বাকিদের ভয় দেখানো হচ্ছে, যে তোমাদেরও একই পরিণতি হতে পারে। ভয় দেখানোর এই চেষ্টাকে প্রতিরোধ করতে হবে।’

লেখক মুশতাকের সঙ্গে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় কারাবন্দী ছিলেন স্থপতি গোলাম মাহফুজ জোয়ার্দার। তিনি এই স্মরণসভা সঞ্চালনা করেন। তিনি বলেন, দুর্নীতি ও অরাজকতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছিলেন মুশতাক আহমেদ। এটা কি অপরাধ? মুশতাককে মানসিকভাবে নির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছে। মুশতাক চলে গেছেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন রয়ে গেছে। এই আইনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে।

সভায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় কারাবন্দী সাংবাদিক শফিকুল ইসলাম কাজল, ইমতিয়াজ আহমেদ, প্রীতম দাশ, শহীদুল হক হায়দারী প্রমুখ বক্তব্য দেন।

লেখক মুশতাক আহমেদ, কার্টুনিস্ট আহমেদ কবির কিশোর, রাষ্ট্রচিন্তার সদস্য দিদারুল ইসলাম ও ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের পরিচালক মিনহাজ মান্নানকে ২০২০ সালের মে মাসে র‍্যাব গ্রেপ্তার করে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রমূলক কথাবার্তা ও গুজব ছড়ানোর অভিযোগে তাঁরাসহ মোট ১১ জনের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করে র‍্যাব। ২০২১ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় কারাগারে মারা যান মুশতাক আহমেদ।