ঢাকা জেলায় যৌতুকের মামলা এত বেশি কেন?

নারী নির্যাতন
প্রতীকী ছবি

যৌতুক নিরোধ আইনে সারা দেশে বিচারাধীন মামলার একটি হিসাব দিয়েছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। ৬৪ জেলার তালিকা থেকে দেখা গেছে, যৌতুক নিরোধ আইনে ঢাকা জেলায় মামলা সবচেয়ে বেশি আর রাঙামাটি জেলায় মামলা সবচেয়ে কম।

গতকাল বুধবার জাতীয় সংসদে টেবিলে উত্থাপিত প্রশ্নোত্তরে ফেনী-২ আসনে আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্য নিজাম উদ্দিন হাজারীর প্রশ্নের জবাবে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক জানান, দেশের ৬৪ জেলায় আদালতগুলোতে গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত যৌতুক নিরোধ আইনে বিচারাধীন মোট মামলার সংখ্যা ৪১ হাজার ৬৯৩টি। এর মধ্যে ঢাকা জেলায় সবচেয়ে বেশি ৩ হাজার ৮৭৯টি মামলা বিচারাধীন।

মন্ত্রীর কাছে সংসদ সদস্য জানতে চান, যৌতুক নিরোধ আইনে জেলাভিত্তিক কত মামলা নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে এবং মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তির লক্ষ্যে সরকারের কোনো পদক্ষেপ আছে কি না। জবাবে আইনমন্ত্রী আরও জানান, মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য ম্যাজিস্ট্রেটরা কাজ করে যাচ্ছেন। হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতিদের নেতৃত্বে গঠিত পর্যবেক্ষণ কমিটি মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির বিষয়ে বিচারকদের প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দিচ্ছেন।

সবচেয়ে বেশি ও কম মামলা যেসব জেলায়
আইনমন্ত্রীর দেওয়া তথ্য অনুসারে, যৌতুক নিরোধ আইনে সবচেয়ে বেশি বিচারাধীন মামলা রয়েছে ঢাকা জেলায়। সবচেয়ে বেশি মামলা রয়েছে এমন ৫ জেলার মধ্যে ঢাকা জেলায় ৩ হাজার ৮৭৯টি, চট্টগ্রামে ২ হাজার ৩৪০টি, নারায়ণগঞ্জে ১ হাজার ৯১৭টি, ময়মনসিংহে ১ হাজার ৭৫৪টি এবং যশোরে ১ হাজার ৭৪০টি মামলা বিচারাধীন।

সবচেয়ে কম মামলা বিচারাধীন রয়েছে এমন জেলাগুলোর মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামের তিনটি জেলাই রয়েছে। সবচেয়ে কম মামলা বিচারাধীন রয়েছে এমন ৫ জেলার মধ্যে রাঙামাটিতে ১৬টি, খাগড়াছড়িতে ৩১, বান্দরবানে ৬৩, বরগুনায় ৭২ এবং নড়াইল জেলায় ৭৭টি মামলা বিচারাধীন আছে।  

ঢাকা জেলা মামলা বেশি হওয়ার কারণ
মানবাধিকার কর্মী ও আইনজীবীদের মতে, জনসংখ্যার আধিক্য ও যৌতুকের ঘটনা বেশি ঘটে ও আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ আছে বলেই ঢাকা জেলায় মামলা বেশি হচ্ছে। এ ছাড়া আর্থিক সংশ্লিষ্টতা রয়েছে—এমন পারিবারিক সহিংসতার অনেক ঘটনা পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) ২০১০ আইনে না হয়ে যৌতুকসংক্রান্ত ধারায় হওয়ার কারণেও যৌতুকের মামলা বেশি হয় বলে মনে করেন তাঁরা। তাঁদের মতে, মামলার সংখ্যা বেশি হলে এবং বিচার প্রক্রিয়ায় ধীরগতি থাকলে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা বেশি থাকে।
বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির (বিএনডব্লিউএলএ) সভাপতি সালমা আলী প্রথম আলোকে বলেন, ঢাকা জেলায় অনেক বেশি সংখ্যক লোক বসবাস করে। এখানে আইনিসহ যেকোনো তথ্য প্রবাহ বেশি। এ জেলার মেয়েরাও তুলনামূলক সচেতন। এ কারণে যৌতুকের ঘটনা ঘটলে মামলা হয়। আবার অনেক পারিবারিক সহিংসতার ঘটনা ঘটে যেসব ক্ষেত্রে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) ২০১০ আইন আছে। কিন্তু আইনজীবীরা ও বাদীরা এ মামলার বিষয়ে জানেন না বলে যৌতুকের ধারায় মামলা করেন। এতে মামলা প্রমাণিত না হলে মেয়েটিই বিচার পেতে ক্ষতিগ্রস্ত হন। আবার রাজনৈতিক ইস্যুতেও অনেক সময় যৌতুকের ধারায় মামলা করা হয়। যেগুলোর ফলাফল নিয়ে সংশয় থাকে।

এ ক্ষেত্রে ভুয়া মামলা করার অভিযোগ আসে কি না জানতে চাইলে আইনজীবী সালমা আলী বলেন, ভুয়া বলার সুযোগ নেই। সঠিক ধারায় মামলা হয় না, সেটা বলা যায়।

বাংলাদশ মহিলা পরিষদের লিগ্যাল এইড বিভাগের আইনজীবী দীপ্তি রানি সিকদার প্রথম আলোকে বলেন, অনেক যৌতুকের মামলায় নারীরা স্বামীর সঙ্গে আপস করে ফেলেন। সেসব মামলা আর প্রমাণিত হয় না। তখন আসামি পক্ষ মামলাকে অনেক সময় ভুয়া বলে প্রচার চালায়। মামলা ভুয়া বলার সুযোগ নেই। কারণ, আদালত কখনো কোনো মামলাকে ‘ভুয়া’ বলে না, বরং ‘প্রমাণিত হয়নি’ বলে উল্লেখ করে। তিনি আরও বলেন, ঢাকা জেলায় অনেক বেশি জনসংখ্যা বলেই যৌতুকের ঘটনাও বেশি হচ্ছে, মামলাও বেশি হচ্ছে। আর্থিক সংশ্লিষ্টতা রয়েছে এমন পারিবারিক সহিংসতার ঘটনাগুলোতেও অনেক সময় যৌতুকের ধারায় মামলা হয়।

এই দুই আইনজীবী যৌতুককে কেন্দ্র করে নির্যাতন বন্ধে বিচার প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতা কমানো ও আইনের কঠোর প্রয়োগের দাবি করেন।

পার্বত্য জেলায় মামলা কম থাকার কারণ
তিন পার্বত্য জেলাতেই যৌতুক নিরোধ আইনে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা কম। এই তিন জেলায় ক্ষুদ্র জাতিসত্তার জনসংখ্যা বেশি। ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে যৌতুক প্রথা নেই।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ রাঙামাটির নারী অধিকারকর্মী টুকু তালুকদার প্রথম আলোকে বলেন, ‘পাহাড়ে যতগুলো ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী আছে, কারও মধ্যে যৌতুক প্রথা নেই। এ কারণে মামলার সংখ্যা কম হতে পারে।’ পার্বত্য জেলায় মোট জনসংখ্যার প্রায় ৫০ শতাংশ ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী। রাঙমাটির মোট জনসংখ্যার ৫৭ শতাংশ ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষ।

বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং বলেন, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর সমাজের ঐতিহ্য, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটের কারণেই তাই যৌতুক সংক্রান্ত কোনো সমস্যা নেই।

যৌতুকের কারণে নির্যাতন–হত্যা
যৌতুকের কারণে নির্যাতনের ঘটনায় যৌতুক নিরোধ আইন ২০১৮ এবং নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০–এর ১১ ধারা অনুযায়ী বিচার হয়।

যৌতুক নিরোধ আইন ২০১৮ অনুসারে, যদি বিবাহের কোনো এক পক্ষ, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে, বিবাহের অন্য কোনো পক্ষের কাছে কোনো যৌতুক দাবি করেন, তাহলে এ আইনের অধীন এটি একটি অপরাধ এবং এর জন্য সর্বোচ্চ ৫ বছর ও সর্বনিম্ন এক বছরের কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ড হবে। যৌতুক নিরোধ আইনে সংঘটিত অপরাধের তদন্ত, বিচার, আপিল এবং সংশ্লিষ্ট অন্যান্য বিষয়ে ফৌজদারি কার্যবিধির বিধানগুলো প্রযোজ্য হবে।

আর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে ‘যৌতুকের জন্য মৃত্যু ঘটানো, ইত্যাদির শাস্তি’ হিসেবে ১১ ধারায় বিচার হবে। (ক) ধারা অনুসারে, মৃত্যু ঘটালে বা মৃত্যু ঘটানোর চেষ্টার জন্য যাবজ্জীবন কারাদণ্ড, (খ) ধারা অনুসারে, মারাত্মক জখম করার জন্য সশ্রম কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ ১২ বছর ও সর্বনিম্ন ৫ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড এবং (গ) ধারা অনুসারে, সাধারণ জখম করার জন্য সর্বোচ্চ ৩ বছর ও সর্বনিম্ন এক বছরের সশ্রম কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে।

ঢাকা জেলার ধামরাইয়ের সামিনাকে (১৬) ২০০৫ সালের ৭ জুন যৌতুকের কারণে পুড়িয়ে হত্যার অভিযোগ ওঠে স্বামী জাফরের বিরুদ্ধে। মামলা হয়েছিল নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে। মামলার বাদী সামিনার মা নাজমা বেগম এবং মামলার আইনি সহায়তা দেওয়া সংস্থা বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের আইনজীবীদের কাছ থেকে জানা গেছে, ২০১৮ সালে ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৯ সামিনার স্বামী জাফরসহ ৬ জনের বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডের রায় দেন। ছয়জনের মধ্যে সামিনার স্বামীসহ তিনজন কারাগারে আছেন। মামলাটি এখন উচ্চ আদালতে বিচারাধীন।

বেসরকারি সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) এ বছরের জানুয়ারি থেকে জুন মাস পর্যন্ত সংকলিত তথ্য তুলে ধরে জানিয়েছে, এই ৬ মাসে শুধু যৌতুককে কেন্দ্র করে ৭৪টি সংবাদ প্রকাশ পেয়েছে। এর মধ্যে মামলা হওয়ার খবর পাওয়া গেছে ৪৯টির। এ সময়ে যৌতুকের কারণে শারীরিক নির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছে ৩৪ নারীকে। নির্যাতনের কারণে ৩ নারী আত্মহত্যা করেছেন। যৌতুকের কারণে নির্যাতন করে স্বামীর বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে ৪ নারীকে এবং যৌতুককে কেন্দ্র করে শারীরিক নির্যাতনের ঘটনার শিকার হয়েছেন ৩৩ নারী। আসক ১০টি জাতীয় পত্রিকা, কয়েকটি অনলাইন পোর্টাল ও নিজস্ব মাধ্যম থেকে নেওয়া তথ্য সংকলিত করে।