বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশনের (বিসিআইসি) লোগো
বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশনের (বিসিআইসি) লোগো

২৮ বছরের মধ্যে ২৪ বছরই লোকসানে বিসিআইসি, ক্ষতি ৭৯৮০ কোটি টাকা

সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশন (বিসিআইসি) গত ২৮ বছরের মধ্যে ২৪ বছরই লোকসান দিয়েছে। এই সময়ে লোকসানের পরিমাণ ৭ হাজার ৯৮০ কোটি টাকা। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা ও শিল্প মন্ত্রণালয়ের বার্ষিক প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে এই তথ্য পাওয়া গেছে।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিসিআইসির লোকসান বাড়তে দেখা গেছে। ২৮ বছরের মধ্যে গত অর্থবছরে (২০২৩-২৪) বিসিআইসি রেকর্ড লোকসান দিয়েছে। পরিমাণ ৯১৩ কোটি টাকা।

তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, বর্তমানে বিসিআইসি উৎপাদিত প্রধান পণ্য সার। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, গ্যাস-সংকটের কারণে বিসিআইসির নিয়ন্ত্রণে থাকা বেশির ভাগ সার কারখানা বন্ধ থাকায় সংস্থাটির লোকসান বেড়েছে। আর সিমেন্ট, কাগজ, গ্লাস শিটের মতো পণ্য উৎপাদনকারী কারখানাগুলো বছরের পর বছর লোকসান দিয়ে যাচ্ছে। এ বিষয়টিও সংস্থাটির লোকসানের পরিমাণ বাড়িয়ে দিচ্ছে।

বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষার ২৭ বছর (১৯৯৬-৯৭ থেকে ২০২২-২৩ অর্থবছর) এবং শিল্প মন্ত্রণালয়ের গত অর্থবছরের (২০২৩-২৪) বার্ষিক প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এই ২৮ বছরের মধ্যে ২৪ বছরে ৭ হাজার ৯৮০ কোটি টাকা লোকসান দিয়েছে বিসিআইসি। সংস্থাটির লোকসান প্রথমবারের মতো ৫০০ কোটি টাকা ছাড়ায় ২০১৭-১৮ অর্থবছরে। অন্য চার অর্থবছরে সংস্থাটি লাভ করেছে। লাভের পরিমাণ ৬৫৭ কোটি টাকা। বিসিআইসি সবশেষ লাভে ছিল ২০১৪-১৫ অর্থবছরে।

বিসিআইসির চেয়ারম্যান মো. সাইদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘ইউরিয়া কারখানাগুলোই আমাদের মূল। কিন্তু গ্যাসের অভাবে উৎপাদন করতে না পারায় গত অর্থবছরে এমন (রেকর্ড) লোকসান হয়েছে। উৎপাদনে যেতে পারলে লোকসান কমে আসবে।’

গ্যাস–সংকটে উৎপাদন বন্ধ

বিসিআইসি যখন ১৯৭৬ সালে যাত্রা শুরু করে, তখন সংস্থাটির কারখানা ছিল ৮৮টি। বিসিআইসির জনসংযোগ দপ্তর থেকে জানা যায়, সংস্থার নিয়ন্ত্রণে এখন মোট ১৮টি কারখানা আছে। এর মধ্যে এখন ১১টি চালু, আর সাতটি স্থায়ীভাবে বন্ধ আছে। চালু কারখানাগুলোর মধ্যে সাতটিই সার কারখানা। এর মধ্যে পাঁচটি ইউরিয়া, একটি ডিএপি ও একটি টিএসপি সার কারখানা। এ ছাড়া একটি করে কাগজ, সিমেন্ট, গ্লাস শিট ও স্যানিটারিওয়্যার-ইনসুলেটর কারখানা চালু রয়েছে।

ইউরিয়া সার কারখানাগুলোর প্রধান কাঁচামাল গ্যাস। বিসিআইসি সূত্র জানায়, এখন গ্যাসের অভাবে পাঁচটির মধ্যে তিনটি ইউরিয়া সার কারখানা অস্থায়ীভাবে বন্ধ আছে।

সংশ্লিষ্ট কারখানাগুলোর খোঁজ নিয়ে জানা যায়, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে যমুনা সার কারখানা বন্ধ আছে। ফেব্রুয়ারি থেকে চিটাগাং ইউরিয়া ফার্টিলাইজার লিমিডেট বন্ধ ছিল। দীর্ঘ আট মাস পর গ্যাস পেয়ে গত রোববার দিবাগত রাতে পুরোদমে উৎপাদন শুরু হয় কারখানাটিতে। গত ফেব্রুয়ারি থেকে আশুগঞ্জ ফার্টিলাইজার অ্যান্ড কেমিক্যাল কোম্পানি লিমিটেড ও মার্চ থেকে শাহজালাল ফার্টিলাইজার কোম্পানি লিমিডেটে উৎপাদন বন্ধ আছে। কারখানা বন্ধের নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে অভ্যন্তরীণ সামগ্রিক উৎপাদনে।

শিল্প মন্ত্রণালয়ের বার্ষিক প্রতিবেদন বলছে, গত অর্থবছরে (২০২৩-২৪) বিসিআইসির চালু ১১টির মধ্যে ৯টি কারখানা উৎপাদনে ছিল। এর মধ্যে চারটি ইউরিয়া সার কারখানাই লোকসান দিয়েছে। লোকসানের পরিমাণ ৮৭৪ কোটি টাকার বেশি। এতে সামগ্রিকভাবে বিসিআইসির লোকসান বেড়েছে।

বিসিআইসি বলছে, গ্যাস–সংকট ছাড়াও সার কারখানাগুলো পুরোনো হওয়ায় উৎপাদন সক্ষমতা কমে গেছে। এগুলো নতুন করে করার জন্য সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়েছে। নতুন করে কারখানা করতে পারলেও লোকসান কমে আসবে বলে আশা করা হচ্ছে।

ঝুঁকিতে খাদ্য উৎপাদন

দেশের খাদ্য উৎপাদনে ইউরিয়া সার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বিসিআইসির কারখানাগুলোয় একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ ইউরিয়া সার উৎপাদিত হয়। বাকিটা আমদানির মাধ্যমে পূরণ করা হয়।

তবে শিল্প মন্ত্রণালয়ের গত চার অর্থবছরের বার্ষিক প্রতিবেদনের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, বিসিআইসির ইউরিয়া সারের উৎপাদন ধারাবাহিকভাবে কমছে। ২০২০-২১ অর্থবছরে বিসিআইসি ১০ লাখ ৩৩ হাজার মেট্রিক টন ইউরিয়া সার উৎপাদন করে, যা দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদার প্রায় ৪১ শতাংশ পূরণ করেছিল। উৎপাদন ধারাবাহিকভাবে কমে গত অর্থবছরে (২০২৩-২৪) তা দাঁড়ায় ৬ লাখ ৭২ হাজার মেট্রিক টন, যা দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদার মাত্র ২৫ শতাংশ পূরণে সক্ষম।

উৎপাদন কমায় ইউরিয়া সারের মজুতও ধারাবাহিকভাবে কমছে। তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০২০-২১ অর্থবছরে দেশে ইউরিয়া সারের মজুত ছিল ৮ লাখ ৬০ হাজার মেট্রিক টন। মজুত ধারাবাহিকভাবে কমে গত অর্থবছরে (২০২৩-২৪) তা দাঁড়ায় ৫ লাখ ১ হাজার মেট্রিক টন।

বিসিআইসির সংশ্লিষ্টরা কর্মকর্তারা বলছেন, গত অর্থবছরের মতো চলতি অর্থবছরেও (২০২৪-২৫) কয়েকটি কারখানায় ইউরিয়া সার উৎপাদন বন্ধ আছে। সামনে বোরো মৌসুম। এই সময় কয়েকটি কারখানায় ইউরিয়ার উৎপাদন বন্ধ থাকার বিষয়টি দেশের খাদ্য উৎপাদনকে ঝুঁকিতে ফেলছে।

সম্প্রতি বিসিআইসি কর্তৃপক্ষ প্রথম আলোকে বলেছিল, ২ অক্টোবর চিটাগাং ইউরিয়া ফার্টিলাইজার লিমিডেট ও শাহজালাল ফার্টিলাইজার কোম্পানি লিমিডেটে গ্যাস সরবরাহ করার বিষয়ে সরকারের কাছ থেকে সবুজ সংকেত পাওয়া গেছে। আর গ্যাস পেয়ে গত রোববার দিবাগত রাতে চিটাগাং ইউরিয়া ফার্টিলাইজার লিমিডেটে পুরোদমে উৎপাদন শুরু হয়।

সার উৎপাদনের ঘাটতি পূরণ করতে হলে আমদানি বাড়াতে হয়। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেন, সার আমদানির ক্ষেত্রে দুই ধরনের চুক্তি হয়। একটি হলো, নিশ্চিত আমদানি করা হবে। আরেকটা হলো, প্রয়োজন ছাড়া (অপশনাল) আমদানি করা হবে না। যদি কোনো কারণে অভ্যন্তরীণ উৎপাদন কম হয়, তখন এই অপশনাল সার আমদানি করা হবে। এর বাইরে দেড় লাখ মেট্রিক টন ইউরিয়া সার দরপত্রের মাধ্যমে কেনার অনুমতি দিয়েছে মন্ত্রণালয়। উৎপাদন কম হওয়ায় ইউরিয়া সারের যেন ঘাটতি না হয়, তাই এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।

যদিও বিসিআইসির কর্মকর্তারা বলছেন, ঠিকমতো ঋণপত্রের (এলসি) মূল্য পরিশোধ করতে না পারলে সারসংকট দেখা দিতে পারে। তা ছাড়া দেশে উৎপাদিত ইউরিয়া সারের মান ভালো। আমদানি করা ইউরিয়া সারের মান ততটা ভালো হয় না।

অন্য পণ্যের চার কারখানা টানা লোকসানে

তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ইউরিয়া সার কারখানা ছাড়াও গত অর্থবছরে (২০২৩-২৪) বিসিআইসির চারটি কারখানা ১১৫ কোটি টাকা লোকসান দিয়েছে। এর মধ্যে কাগজ উৎপাদনকারী কর্ণফুলী পেপার মিলস লিমিটেড ৩২ কোটি, সিমেন্ট উৎপাদনকারী ছাতক সিমেন্ট কোম্পানি লিমিটেড ৪২ কোটি, কাচ উৎপাদনকারী উসমানিয়া গ্লাস শিট ফ্যাক্টরি লিমিটেড ১২ কোটি এবং ফুলের টব, ফুলদানি, বেসিন, প্যান, সিংক প্রভৃতি পণ্য উৎপাদনকারী বাংলাদেশ ইনসুলেটর অ্যান্ড স্যানিটারিওয়্যার ফ্যাক্টরি লিমিডেট ২৯ কোটি টাকা লোকসান দিয়েছে। শুধু গত অর্থবছরই নয়, ১০ অর্থবছরের তথ্য ঘেঁটে দেখা যায়, এই পুরো সময় টানা লোকসান দিয়ে আসছে বিসিআইসির এই চারটি কারখানা।

এই চারটি কারখানা যেসব পণ্য উৎপাদন করে, তার প্রতিটি ক্ষেত্রে বেসরকারি খাত দাঁড়িয়ে গেছে বলে উল্লেখ করেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বেসরকারি খাত দাঁড়িয়ে যাওয়ায় বছরের পর বছর লোকসান দিয়ে এসব কারখানা টিকিয়ে রাখার যৌক্তিকতা নেই। এসব কারখানার দায়দেনা মিটিয়ে সেখানে বেসরকারি শিল্প হতে পারে।

আর সার কারখানার প্রসঙ্গে খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, যে কারখানা লাভজনক আছে, তা চালু রাখা উচিত। গ্যাস-সংকটের কারণে যেসব সার কারখানা লোকসানে আছে, সেগুলোয় গ্যাস সরবরাহ করে উৎপাদন স্বাভাবিক রাখার জন্য উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। গ্যাস–সংকটের বাইরে লোকসানের অন্য কোনো কারণ আছে কি না, তা খতিয়ে দেখা জরুরি।