মিয়ানমারের অভ্যন্তরে সংঘাতের জেরে দেশটি থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছেন আরও ১১৪ জন। তাঁদের মধ্যে আছেন মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সদস্য, সেনাসদস্য ও সরকারি কর্মকর্তা। গতকাল বিকেলে কক্সবাজারের উখিয়ার থাইংখালী বাজারে
মিয়ানমারের অভ্যন্তরে সংঘাতের জেরে দেশটি থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছেন আরও ১১৪ জন। তাঁদের মধ্যে আছেন মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সদস্য, সেনাসদস্য ও সরকারি কর্মকর্তা। গতকাল বিকেলে কক্সবাজারের উখিয়ার থাইংখালী বাজারে

ওপারে থেমে থেমে গুলি, এপারে আতঙ্ক

কক্সবাজার-টেকনাফ সড়কের উখিয়া উপজেলার থাইংখালী বাজার থেকে দেড় কিলোমিটার পূর্বে রহমতের বিল এলাকা। ওখান থেকে আধা কিলোমিটার পূর্বে মিয়ানমারের সীমান্ত ঢেঁকিবনিয়া। গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে রহমতের বিল এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, স্থানীয় বাসিন্দাদের চোখেমুখে আতঙ্ক।

অনেকে ঘর ছেড়ে আত্মীয়স্বজনদের বাড়িতে চলে যাচ্ছেন। চোখেমুখে আতঙ্কের ছাপ, কখন গুলি এসে গায়ে পড়ে!

দুপুর সাড়ে ১২টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত রহমতের বিল এলাকায় অবস্থান করে থেমে থেমে ওপার থেকে গুলির শব্দ শোনা গেছে। গুলির শব্দের সঙ্গে সঙ্গে লোকজন ঘরে ঢুকে যাচ্ছে। কিছুক্ষণ পর আবার বের হচ্ছে। সেখানে থাকা বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) সদস্যরা স্থানীয় বাসিন্দাদের সতর্ক করছেন। আবার স্থানীয় লোকজন গণমাধ্যমকর্মীদেরও সতর্ক করছেন।

আতঙ্কে এলাকা ছেড়ে আশ্রয়কেন্দ্রে উঠেছেন সীমান্তের বাসিন্দারা। গতকাল রাত সাড়ে আটটায় বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির ১ নম্বর উত্তর ঘুমধুম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে

একই অবস্থা বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম সীমান্ত এলাকায়। দিনের মতো রাতেও গুলি বর্ষণ হওয়ায় নির্ঘুম রাত কাটছে সীমান্ত এলাকার বাসিন্দাদের। এদিকে গতকাল উখিয়ার পালংখালী ইউনিয়নের রহমতের বিল সীমান্ত এলাকা দিয়ে মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বর্ডার গার্ড পুলিশের (বিজিপি) আরও ১৪৯ জন সদস্য ঢুকে পড়েছেন। পরে তাঁরা আত্মসমর্পণ করে অস্ত্র জমা দেন। বিজিবি তাঁদের হেফাজতে রাখে।

গত শুক্রবার রাত থেকে ওপারে বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মির সঙ্গে বিজিপির সংঘর্ষ চলছে। এই সংঘর্ষের রেশ বাংলাদেশের লোকালয়ে বিরাজ করছে। ইতিমধ্যে সীমান্তের ওপারে বিজিপিকে হটিয়ে তুমব্রু রাইট ক্যাম্প ও ঢেঁকিবনিয়া সীমান্তচৌকি আরাকান আর্মি দখলে নিয়েছে বলে খবর পাওয়া গেছে। গত রোববার দিবাগত রাত তিনটা থেকে দুই পক্ষের মধ্যে থেমে থেমে গোলাগুলি ও মর্টার শেল নিক্ষেপের ঘটনা ঘটছে। গত সোমবার বেলা ১১টা থেকে দুপুর ১২টা ১০ মিনিট পর্যন্ত মিয়ানমারের আকাশে হেলিকপ্টার চক্কর দিয়ে গোলাবর্ষণ করতে দেখা গেছে। সোমবার ঘুমধুম ইউনিয়নে জলপাইতলী গ্রামের একটি রান্নাঘরের ওপর মিয়ানমার থেকে ছোড়া মর্টার শেলের আঘাতে দুজন নিহত হয়েছেন। একজন বাংলাদেশি নারী, অন্যজন রোহিঙ্গা পুরুষ।

স্থানীয় লোকজন বলছেন, এর আগে ২৯ ও ৩১ জানুয়ারি ঘুমধুম সীমান্তের ওপার থেকে গোলাগুলির শব্দ শোনা যায়। সে সময় মর্টার শেল ও গোলার অন্তত চারটি অংশ তুমব্রু, কোনারপাড়া ও পশ্চিম ঘুমধুমে এসে পড়ে।

মুহুর্মুহু গুলির শব্দ

কান থেকে হাত নামাতেই পারছেন না বেওলা খাতুন (৬০)। ওপাশ থেকে আসছে মুহুর্মুহু গুলির শব্দ। গত শুক্রবার থেকে টানা পাঁচ দিন এভাবে কাটছে বেওলা খাতুনের। তাঁর ঘর থেকে আধা কিলোমিটার দূরে মিয়ানমার সীমান্তের ঢেঁকিবনিয়া। গতকাল দুপুরে কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলা পালংখালী ইউনিয়নের মিয়ানমার সীমান্ত এলাকার রহমতের বিল এলাকায় তাঁর ঘরের সামনে গিয়ে দেখা গেছে এই চিত্র। বেলা দেড়টার দিকে যখন তাঁর সঙ্গে কথা হচ্ছিল, তখনো গুলির শব্দ শোনা যাচ্ছিল। আর ভয়ে কাঁপতে থাকেন তিনি। মঙ্গলবার সকাল ১০টার দিকে মিয়ানমার থেকে ছোড়া গুলি তাঁর ঘরের চালে এসে পড়ে। ফুটো হয়ে গেছে ঘরের টিন। বেওলা খাতুন প্রথম আলোকে বলেন, পাঁচ দিন ধরে কিছুক্ষণ পরপর গুলি শব্দ শুনতে পাচ্ছেন। মঙ্গলবার ঘরের চালে এবং পুকুরে গুলি এসে পড়ে। এরপর ছেলের বউ ও নাতি–নাতনিদের এক আত্মীয়ের বাড়িতে পাঠিয়ে দেন। পরিস্থিতি বুঝে বেওলা খাতুনও চলে যাবেন।

বেওলার ঘর থেকে ৫০০ গজ দূরে মমতাজ বেগম নামের এক নারী উঠানে বসে আছেন। তাঁর কানেও দুই হাত। মমতাজ বেগম প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা আতঙ্কে আছেন। গুলির শব্দে শিশুরা কান্না করছে। নিরাপত্তার জন্য তাদের অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া উচিত। মমতাজের সঙ্গে সুর মিলিয়ে একই মন্তব্য করলেন সানোয়ারা বেগম। তিনি বলেন, জান বাঁচাতে অনেক আগেই চলে যেতাম। কিন্তু বাড়িঘর, গরু–ছাগল রেখে কীভাবে যাব!

উখিয়া উপজেলার পালংখালী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এম গফুর উদ্দিন চৌধুরী নিজ কার্যালয়ে প্রথম আলোকে বলেন, কিছুক্ষণ পরপর গুলি শব্দ। এলাকার লোকজন আতঙ্কে আছেন। অনেকের বাড়িঘরে এসে গুলি পড়ছে। নিরাপত্তার জন্য তাঁদের অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া উচিত।

কৃষকশূন্য খেত

রহমতের বিল সীমান্ত এলাকার আশপাশে সব ধানের খেত। গতকাল সেখানে কোনো কৃষক দেখা যায়নি। রহমতের বিল এলাকার মোহাম্মদ রফিক প্রথম আলোকে বলেন, গত শুক্রবার রাত থেকে গুলির শব্দ শোনার পর তাঁরা আর জমিতে নামছেন না। এভাবে আর কত দিন তাঁদের বসে থাকতে হবে জানেন না।

কৃষক রফিকের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে আরেক কৃষক আবদুল বারেক বলেন, ঘরে যা কিছু আছে, তা দিয়ে কোনো রকম চলছে। এভাবে আর কয়েক দিন চললে না খেয়ে থাকতে হবে।

একই অবস্থা ঘুমধুম সীমান্ত এলাকার কৃষকদের। এখানকার বেশির ভাগ কৃষক বাদাম ও ধানের চাষ করেছেন। কৃষক মোহাম্মদ মিয়া বলেন, শুক্রবারের পর থেকে তাঁরা ঘরে বসে আছেন। আবার কেউ কেউ আত্মীয়স্বজনদের বাড়িতে ভয়ে চলে গেছেন। বেঁচে থাকাটাই তাঁদের জন্য এখন বড় হয়ে দাঁড়িয়েছে। আবার বেঁচে থাকলেও কী খাবেন, সেই চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে।

উখিয়ার পালংখালী ইউপি চেয়ারম্যান এম গফুর উদ্দিন চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, সীমান্ত এলাকায় প্রায় দুই হাজার কৃষক আতঙ্কে জমিতে নামতে পারছেন না। ঘুমধুম ইউপি চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আজিজ জানান, সীমান্ত এলাকায় প্রায় দুই হাজার কৃষকের দিন কাটছে আতঙ্কে।

নির্ঘুম রাত ১৩ গ্রামের বাসিন্দাদের

মিয়ানমারের ঢেঁকিবনিয়া সীমান্তচৌকি ঘিরে রাতভর মর্টার শেল ও গোলাবর্ষণে কেঁপে উঠছে বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকার অন্তত ১৩টি গ্রাম। সোমবার রাত নয়টা থেকে মঙ্গলবার সকাল ছয়টা পর্যন্ত অনবরত এই গোলাবর্ষণ ও মর্টার শেল নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে। ফলে নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুমের মধ্যমপাড়া, জলপাইতলী, মণ্ডলপাড়া, নয়াপাড়া, কোনারপাড়া, পশ্চিমকুল, বেতবুনিয়া বাজার পাড়া এবং উখিয়া উপজেলার পালংখালী ইউনিয়নের উখিয়ার ঘাট, পূর্ব ফাঁড়ির বিল, নলবনিয়া, আঞ্জুমান পাড়া, বালুখালী, দক্ষিণ বালুখালী এলাকা কেঁপে ওঠে।

স্থানীয় লোকজন বলেন, ঢেঁকিবনিয়া সীমান্তচৌকি দখলকে ঘিরে রোববার রাত ১১টার দিকে আক্রমণ শুরু করে বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরকান আর্মি। এর পর থেকে থেমে থেমে আরকান আর্মির সঙ্গে মিয়ানমার বিজিপির সংঘর্ষ চলছে। গত সোমবার দুপুরে মিয়ানমার সেনাবাহিনী হেলিকপ্টারে করে অন্তত পৌনে এক ঘণ্টা গোলাবর্ষণ করে। কয়েক ঘণ্টা বিরতি দিয়ে রাত নয়টা থেকে আবার সংঘর্ষ শুরু হয়। এই সংঘর্ষ সবচেয়ে ভয়াবহ হয়। রাতের অন্ধকারে হেলিকপ্টার থেকে গোলা ফেলা হয়, মর্টার নিক্ষেপ করা হয়।

পালিয়ে এলেন আরও ১৪৯ জন

মিয়ানমারের অভ্যন্তরে সংঘাতের জেরে দেশটি থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছেন আরও ১৪৯ জন। তাঁদের মধ্যে মিয়ানমারের সেনাসদস্য, সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিপির সদস্য ও সরকারি কর্মকর্তা রয়েছেন। এ নিয়ে গত রোববার থেকে দেশটির মোট ২৬৪ জন পালিয়ে বাংলাদেশে এসেছেন। এঁদের বেশির ভাগ বিজিপির সদস্য।

মঙ্গলবার সকাল নয়টার দিকে কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার পালংখালী ইউনিয়নের রহমতের বিল সীমান্ত দিয়ে নতুন করে মিয়ানমার থেকে বিজিপি, সেনা ও সরকারি কর্মকর্তাদের পালিয়ে আসার ঘটনা ঘটে। তাঁদের রহমতের বিল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে রাখা হয়।

রামু সেক্টর সদর দপ্তরের সেক্টর কমান্ডার কর্নেল মো. মেহেদি হোসাইন কবির সাংবাদিকদের বলেন, ‘দেশের ভেতরে যাতে প্রাণহানি না ঘটে, সে জন্য আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি। এখন পর্যন্ত যাঁরা এসেছেন, তাঁরা বর্ডার গার্ড পুলিশের অ্যাসোসিয়েটেড। ভাষাগত ও অন্যান্য সমস্যার কারণে এর বাইরে আমরা পরিচয় বের করতে পারিনি।’ এলাকাবাসীর উদ্দেশে তিনি বলেন, নিরাপদে থাকবেন। এই মুহূর্তে প্রয়োজন না হলে সীমান্তের কাছাকাছি যাবেন না।

১৩৭ জনের স্কুলে আশ্রয়

নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম সীমান্ত এলাকার ১৩৭ জন নারী–পুরুষ একটি স্কুলে আশ্রয় নিয়েছেন। গতকাল রাত আটটার দিকে উত্তর ঘুমধুম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, টেবিলের ওপর শুয়ে–বসে আছেন নারী-পুরুষেরা। সবার চোখেমুখে আতঙ্ক। তুমব্রু এলাকা থেকে আসা কুলসুম আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, গত সোমবার মিয়ানমার সীমান্ত থেকে ছোড়া গুলি তাঁদের ঘরে এসে পড়ে। গুলিতে তাঁদের দুই প্রতিবেশী মারা যান। এ কারণে তাঁরা ঘরে থাকতে পারছেন না।

আশ্রয়কেন্দ্রে দেখা হয় ঘুমধুম ইউনিয়নের ইউপি সদস্য দিল মোহাম্মদের সঙ্গে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ১৩৭ জন নারী–পুরুষ স্কুলে আশ্রয় নিয়েছেন। গুলিতে দুজন নিহত হওয়ার পর আতঙ্কে থাকা লোকজনকে আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়ে আসা হয়েছে। পরিষদের পক্ষ থেকে তাঁদের খাবার দেওয়া হচ্ছে।