মানবাধিকার রক্ষা ও উন্নয়নে ভূমিকা রাখার ক্ষেত্রে ১১টি দেশের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বনিম্ন স্কোর পেয়েছে বাংলাদেশের জাতীয় মানবাধিকার কমিশন (এনএইচআরসিবি)। মোট ৪৪ স্কোরের মধ্যে মানবাধিকার কমিশন পেয়েছে ১৭ দশমিক ২৫। সবচেয়ে খারাপ অবস্থানে ভারত। মঙ্গোলিয়া রয়েছে সবচেয়ে ভালো অবস্থানে। দ্য এশিয়ান এনজিও নেটওয়ার্ক অন ন্যাশনাল হিউম্যান রাইটস ইনস্টিটিউশনস (এএনএনআই) এই প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ভিন্নমত দমন ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে খর্ব করার জন্য সরকারকে জবাবদিহি করার ক্ষেত্রে মানবাধিকার কমিশনের সাহসের অভাব রয়েছে। র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাতেও খুব কমই ভূমিকা রেখেছে কমিশন।
এএনএনআইয়ের সদস্যভুক্ত ২৩টি দেশের ৮৫টি সংস্থার মধ্যে ১১টি দেশের মানবাধিকার কমিশনের কাজের মূল্যায়ন করে এ প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে। ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত মানবাধিকার সুরক্ষা ও উন্নয়নে কমিশনগুলোর ভূমিকা পর্যালোচনা করা হয়েছে। দেশগুলো হচ্ছে বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, মঙ্গোলিয়া, নেপাল, ফিলিপাইন, দক্ষিণ কোরিয়া, শ্রীলঙ্কা ও তাইওয়ান। ৫টি মূল শ্রেণি ও ১৬টি উপশ্রেণিভুক্ত মোট প্রশ্ন ছিল ৪৪টি। স্বাধীনতা, কর্তৃত্ব, বহুত্ববাদ, উন্নয়ন, সুরক্ষা এই ৫টি মূল শ্রেণিভুক্ত বিষয়ে কমিশনগুলোর কাজের মূল্যায়ন করা হয়।
মূল্যায়নে মোট ৪৪ স্কোরের মধ্যে বাংলাদেশের চেয়ে ভালো স্কোর করেছে শ্রীলঙ্কা, নেপাল ও পাকিস্তানের জাতীয় মানবাধিকার কমিশন। সর্বনিম্ন স্কোরের দিক দিয়ে তালিকা অনুসারে, সবচেয়ে খারাপ স্থানে ভারত। দেশটির স্কোর ১৫–এর বেশি। দ্বিতীয় অবস্থানে বাংলাদেশ। অন্য দেশগুলোর স্কোর ইন্দোনেশিয়া (১৯), তাইওয়ান (প্রায় ২০), শ্রীলঙ্কা (২১), মালয়েশিয়া (প্রায় ২৯), পাকিস্তান (২৯–এর বেশি), নেপাল (৩০), ফিলিপাইন (প্রায় ৩৩), দক্ষিণ কোরিয়া (প্রায় ৩৩) এবং মঙ্গোলিয়া (প্রায় ৩৪)।
প্রতিবেদনে বাংলাদেশের জাতীয় মানবাধিকার কমিশন সম্পর্কে বলা হয়েছে, অভিযোগ ও মানবাধিকারের উন্নয়নে বিশিষ্ট নাগরিকদের সঙ্গে সভা করার মতো কিছু কাজ করেছে কমিশন। তবে বাছাই করা কাজে তাদের সম্পৃক্ত হতে দেখা গেছে। ভিন্নমত দমন ও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের (ডিএসএ) মতো আইন করে মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে খর্ব করার জন্য সরকারকে জবাবদিহি করার ক্ষেত্রে কমিশনের সাহসের অভাব রয়েছে।
র্যাবের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাতেও খুব কম ভূমিকা রাখতে দেখা গেছে কমিশনকে। আবার কোনো ঘটনায় মানবাধিকার কমিশন তদন্ত করে সুপারিশ করলে সরকারকে পাত্তা না দিতে দেখা গেছে। ওই সব ঘটনার ফলোআপও হয়নি। এ ধরনের অকার্যকারিতারই প্রভাব পড়েছে মূল্যায়নে এবং স্কোর কম এসেছে।
বাংলাদেশের জাতীয় মানবাধিকার কমিশন ২০২১ সালে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে ৭৫টি এবং ২০২২ সালে ৭৭টি অভিযোগ নেয়। অভিযোগগুলো পারিবারিক নির্যাতন, নারী ও শিশু নির্যাতন, হত্যা, ধর্ষণ, ভূমি দখল, সংখ্যালঘুদের অভিযোগবিষয়ক। আইন অনুসারে, সরকারের কাছে প্রতিবেদন চাইতে পারে কমিশন। কমিশন কোনো সুপারিশ করলে তা ছয় মাসের মধ্যে বাস্তবায়ন করতে হবে। তবে গত ১৪ বছরে দুটি ঘটনা ছাড়া এই সময়ের মধ্যে সুপারিশ বাস্তবায়নের কোনো নজির নেই।
কমিশনের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে বলা হয়, সরকারের প্রতিনিধি কমিশনের সদস্যের নির্বাচিত করেন। এই নির্বাচনপ্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতার অভাব রয়েছে। পূর্ণাঙ্গ আর্থিক স্বাধীনতা নেই। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্তের ক্ষমতা সীমিত।
বহুত্ববাদের ক্ষেত্রে বলা হয়, বিশিষ্ট নাগরিকদের সংগঠন ও সরকারি–বেসরকারি অংশীদার হিসেবে তাদেরই সম্পৃক্ত করে, যারা সরকারের পক্ষে রয়েছে। উন্নয়ন ও অগ্রগতির ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, কমিশন প্রতিবছর বার্ষিক প্রতিবেদন করে। কিন্তু সেখানে সরকারের কার্যকলাপ ও অর্জনের প্রশংসাই বেশি থাকে।
সুরক্ষার ক্ষেত্রে ভুক্তভোগীদের অভিযোগে দ্রুত সাড়া না দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। কমিশনের প্রতিনিধিরা কারাগার পরিদর্শনে অনিয়মিত। যাওয়ার আগে কারাগার কর্তৃপক্ষকে বলে যান। ফলে সেই পরিদর্শন সৌজন্য পরিদর্শনের মতো হয়ে যায়। ভুক্তভোগীদের সুরক্ষা নিশ্চিতের কথা আইনে বলা থাকলেও যাঁরা কমিশনে অভিযোগ করেন, তাঁদের অনেকেই পুলিশের হয়রানির শিকার হন।
এই প্রতিবেদনের বিষয়ে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কামাল উদ্দিন আহমেদের কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি রোববার বলেন, প্রতিবেদনটি এখনো দেখেননি। তিনি বলেন, ‘আন্দাজে কথা লিখলে তো আর হবে না। এগুলো ভিত্তিহীন। কমিশনের বিরুদ্ধে মুখস্থ কথা বলে যায়। এভাবে একটি প্রতিষ্ঠানকে হেয় করার কোনো মানে নেই। আমাদের কাছে সব পরিসংখ্যান আছে। আপনারা অফিসে এসে তথ্য যাচাই করে দেখুন। প্রত্যেকটি বিষয়ে আমরা জবাব দিতে পারব। সরকারের বিরুদ্ধে আমাদের প্রচুর কাজ হয়েছে, ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। সরকার সাড়া দেয়নি, এই কথাও ঠিক নয়। র্যাবের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। গুম–খুনের বিরুদ্ধে আমরা স্পষ্ট কথা বলেছি।’
সবচেয়ে ভালো স্কোর করা মঙ্গোলিয়ার জাতীয় মানবাধিকার কমিশন সম্পর্কে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অভিযোগের বিষয়গুলোতে সাড়া দেওয়া ও দক্ষতার সঙ্গে সমাধান করার কারণে ভালো স্কোর পেয়েছে দেশটির মানবাধিকার কমিশন। দেশটির বিভিন্ন আইন পর্যালোচনায় ভূমিকা রাখছে প্রতিষ্ঠানটি। এ ছাড়া কমিশনে অনেক নারী রয়েছে এবং সব প্রদেশে কমিশনের স্থানীয় কার্যালয় থাকাও প্রতিষ্ঠানকে ভালো অবস্থানে নিয়ে গেছে।