লিজ নেওয়া কোম্পানির কোটি টাকার বেশি বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করেছে বাংলাদেশ হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষ। আবার শিক্ষাগত যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা না থাকার পরও পরামর্শক নিয়োগ দিয়েছে তারা। এ রকম ছয়টি বিষয়ে অনিয়মের ওপর নিরীক্ষা প্রতিবেদন দিয়েছে মহা হিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের (সিএজি) কার্যালয়। প্রতিবেদনে কর্তৃপক্ষের ৫০ কোটি ৫৮ লাখ ২৭ হাজার ৪০ টাকার ক্ষতির বিবরণ উঠে এসেছে।
তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি বিভাগের অধীন হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষের ২০১৯–২০ ও ২০–২১ অর্থবছরের আয়–ব্যয়, তহবিল ও বাজেট বরাদ্দের বিপরীতে ওই নিরীক্ষা করে সরকারের সর্বোচ্চ হিসাব নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠানটি। চলতি জুলাই মাসে নিরীক্ষা প্রতিবেদন সংসদে উপস্থাপন করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে যেসব বিষয়ে অনিয়মজনিত ক্ষতির কথা বলা হয়েছে, সেগুলো হলো ভাড়া অনাদায় থাকা, অন্যের বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ, ভ্যাট বাবদ রাজস্ব ক্ষতি, অতিরিক্ত অনুদান গ্রহণ, মজুরি পরিশোধে অনিয়মিত ব্যয় ও পরামর্শক নিয়োগে অনিয়ম। এসব অনিয়মে নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক সংস্থা ক্ষেত্রবিশেষে সরকারি কোষাগারে টাকা জমা দেওয়া, প্রশাসনিক ব্যবস্থা ও অনিয়মে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করেছে।
প্রথম আলোর পক্ষ থেকে নিরীক্ষা প্রতিবেদন বিষয়ে হাইটেক কর্তৃপক্ষের কাছে জানতে চাওয়া হলে লিখিত বক্তব্যে তারা বলেছে, কোনো বিষয়ে অডিট আপত্তি হলেই যে সেখানে অনিয়ম হয়েছে এমনটা বলার সুযোগ নেই। অডিট নিষ্পত্তি চলমান প্রক্রিয়া। ভাড়া বকেয়ার ক্ষেত্রে পরবর্তী অর্থবছরে বিনিয়োগকারীরা পরিশোধ করেছে। এ ছাড়া আপত্তিকৃত নিজস্ব আয়ের অর্থ ইতিমধ্যে বাজেটভুক্ত করা হয়েছে। পাশাপাশি যে অংশ সরকারি কোষাগারে জমা দেওয়া প্রয়োজন, তা আদায়পূর্বক জমা দেওয়া হবে।
পরামর্শক নিয়োগের বিষয়ে পার্ক কর্তৃপক্ষ বলছে, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি একমাত্র যোগ্য এবং তাঁর নিয়োগে পাবলিক প্রকিউরমেন্ট আইন ও বিধি মানা হয়েছে।
হাইটেক পার্কগুলোতে ভাড়া বা লিজ দেওয়া প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে কর্তৃপক্ষ ভাড়া আদায় না করায় ২ কোটি ৯৫ লাখ ৩ হাজার ৫৬৩ টাকার ক্ষতি হয়েছে। রাজধানীর জনতা টাওয়ার টেকনোলজি পার্ক, গাজীপুরের বঙ্গবন্ধু হাইটেক সিটি ও যশোরের শেখ হাসিনা সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক থেকে দুই বছরে ভাড়ার এই অর্থ আদায় করা হয়নি। চুক্তিপত্রের শর্ত অনুযায়ী প্রতিবছরের অগ্রিম ভাড়া জানুয়ারির প্রথম ১০ দিনের মধ্যে পরিশোধ করতে হবে। এ ক্ষেত্রেও চুক্তিপত্রের শর্ত লঙ্ঘন করা হয়েছে।
পার্ক কর্তৃপক্ষের জবাব উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অবকাঠামো নির্মাণের কারণে ও করোনা মহামারির সময় অর্থনৈতিক মন্দায় বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের ব্যবসায়িক কার্যক্রম যথাসময়ে শুরু করতে পারেনি। চলতি বছরের মধ্যে এসব প্রতিষ্ঠান ব্যবসায়িক কার্যক্রম শুরু করবে এবং বকেয়াসহ সব ভাড়া দেবে।
তবে নিরীক্ষা মন্তব্যে বলা হয়, এ জবাব আপত্তি নিষ্পত্তিতে সহায়ক নয়। এ ছাড়া নিরীক্ষিত প্রতিষ্ঠান নিরীক্ষাকালীন পূর্ণাঙ্গ তথ্য দেয়নি।
যশোরের শেখ হাসিনা সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্কটিকে ১৫ বছরের জন্য প্রোপার্টি ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি (পিএমসি) ‘টেকসিটি বাংলাদেশ লিমিটেড’কে পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি ওই দুই অর্থবছরে বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করেনি। বরং পার্ক কর্তৃপক্ষ এ বিল পরিশোধ করেছে। এতে তাদের ১ কোটি ২৪ লাখ ২৩ হাজার ৬৯৫ টাকার ক্ষতি হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, পরিচালনার দায়িত্বে থাকা কোম্পানির সঙ্গে যশোরে ২৯টি প্রতিষ্ঠান চুক্তি করে কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। পার্কের প্রতিষ্ঠানগুলোর ২০১৯ সালের মে, জুন, জুলাইয়ের বিদ্যুৎ বিল পিএমসিকে পরিশোধে হাইটেকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নির্দেশনা দেন। কিন্তু এ তিন মাসের বিদ্যুৎ বিলের ৩৭ লাখ ১৩ হাজার ৯৪১ টাকা হাইটেক নিজে পরিশোধ করে।
একইভাবে ২০২০-২১ অর্থবছরে মার্চ থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিদ্যুৎ বিলের ৮৭ লাখ ৯ হাজার ৭৫৪ টাকা পিএমসির পরিশোধ করার কথা থাকলেও তা পরিশোধ করেছে হাইটেক কর্তৃপক্ষ।
২০১৯ সালের ৮ মে হাইটেক কর্তৃপক্ষের নির্বাহী কমিটির ২৫তম সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রতিটি কোম্পানির অনুকূলে বিদ্যুৎ বিলের জন্য পৃথক মিটার স্থাপন হবে। পার্ক কর্তৃপক্ষ আর কোনো বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করবে না। এ মিটার স্থাপনের কাজ শেষ হয় ২০১৯ সালের জুনে। কিন্তু নিজেদের সভার সিদ্ধান্ত না মেনে কর্তৃপক্ষ নিজেরা বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করায় অনিয়ম হয়েছে।
তবে হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষ জবাবে বলেছে, নির্বাহী কমিটির ২৭তম সভায় করোনা পরিস্থিতি বিবেচনা করে যশোরের পার্কের বিনিয়োগকারীদের জন্য আর্থিক ক্ষতি নিরসনে বিশেষ প্রণোদনা হিসেবে ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বকেয়া বিদ্যুৎ বিল পরিশোধের অনুমোদন দেওয়া হয়।
সিলেটে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব হাইটেক পার্ক প্রকল্পে ২০১৯-২০ অর্থবছরে চুক্তির শর্ত অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট কাজের জন্য বিমা করার কথা থাকলেও তা করা হয়নি। ফলে পরিশোধযোগ্য প্রিমিয়ামের ওপর ভ্যাট বাবদ সরকারের ১০ লাখ ৯৮ হাজার ৮৭৬ টাকা রাজস্ব ক্ষতি হয়েছে।
এ বিষয়ে প্রকল্প থেকে জবাব দেওয়া হয়নি উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, বিধি অনুযায়ী জবাব দেওয়ার বাধ্যবাধকতা থাকলেও তা অনুসরণ করা হয়নি।
হাইটেক কর্তৃপক্ষের ২০১৯-২০ ও ২০২০-২১ অর্থবছরে মোট পুঞ্জীভূত আয়ের পরিমাণ ৪৫ কোটি ৯২ লাখ ৭ হাজার ৫০৬ টাকা। কিন্তু সংবিধিবদ্ধ কর্তৃপক্ষ হিসেবে হাইটেক পার্ক সরকারের কাছ থেকে এ দুই অর্থবছরে ৪৪ কোটি ৫৮ লাখ ৬৪ হাজার টাকা অনুদান গ্রহণ করে। তবে ওই দুই বছরে ৪৩ কোটি ৫০ লাখ ৮ হাজার ৩২৩ টাকা ব্যয় হয়।
পার্ক কর্তৃপক্ষ নিজেদের আয়ের অর্থ বাজেটে অন্তর্ভুক্ত না করে দুই অর্থবছরের ব্যয়ের সম্পূর্ণ অর্থ সরকারের কাছ থেকে অনুদান নেয়। অথচ সরকার প্রতিবছর ঘাটতি বাজেট প্রণয়ন করে। এ অবস্থায় ৪৫ কোটি ৯২ লাখ ৭ হাজার ৫০৬ টাকার ক্ষতি হয়েছে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, এতে বাংলাদেশ হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষ আইন, ২০১০–এর সম্ভাব্য আয়-ব্যয়সহ পরবর্তী অর্থবছরের বার্ষিক বাজেট বিবরণী সরকারের কাছে পেশ করাসংক্রান্ত ধারা ৩০ লঙ্ঘিত হয়েছে।
হাইটেক কর্তৃপক্ষ জবাবে জানিয়েছে, এটি একটি নতুন প্রতিষ্ঠান; যার অবকাঠামো উন্নয়ন এখনো শেষ হয়নি। অফিস পরিচালনায় নিজস্ব আয় ব্যবহারের আর্থিক বিধিমালা এখনো তৈরি করা সম্ভব হয়নি। তবে স্বল্প পরিসরে কিছু ক্ষেত্রে নিজস্ব আয়ের অর্থ বাজেটভুক্ত করে ব্যয় করা হচ্ছে।
তিনটি পার্ক ও দুটি ইনকিউবেশন সেন্টারে ২০২০ সালের জুন থেকে ২০২১ সালের জুলাই পর্যন্ত শ্রমিকের মজুরি বাবদ ১১ লাখ ৪৩ হাজার ৪০০ টাকা পরিশোধ করা হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয় প্রতিবেদনে।
কিন্তু অর্থ মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনায় আছে, দৈনিকভিত্তিক শ্রমিক আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে নিয়োগ করতে হবে। আউটসোর্সিং না করে হাইটেক কর্তৃপক্ষ দৈনিক ভিত্তিতে মজুরি পরিশোধ করেছে। এ ক্ষেত্রে তারা অর্থ মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা লঙ্ঘন করায় অনিয়মিত ব্যয় করা হয়েছে।
হাইটেক কর্তৃপক্ষ জবাবে বলেছে, আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে ২৬ জন কর্মচারী নিয়োগের সংস্থান রয়েছে। কিন্তু দেশের বিভিন্ন জায়গায় পার্ক, ট্রেনিং সেন্টার স্থাপন করায় লোকবলসংকট দেখা দেয়। সে ক্ষেত্রে জরুরি কার্যক্রম পরিচালনায় আটজনকে শ্রমিক হিসেবে নিয়োগ দিয়ে দৈনিক ভিত্তিতে মজুরি পরিশোধ করা হয়। এখানে কোনো অনিয়ম করা হয়নি। তবে নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক সংস্থা এ জবাব আপত্তি নিষ্পত্তিতে সহায়ক নয় বলে জানিয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ইনোভেশন ও স্টার্টআপ–বিষয়ক পরামর্শকের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট ব্যক্তিকে নিয়োগ দিতে ‘টার্মস অব রেফারেন্স’–এ শিক্ষাগত যোগ্যতা উল্লেখ না করে শুধু অভিজ্ঞতা উল্লেখ করা হয়।
পরামর্শক পদে নিয়োগ পাওয়া মো. আশিকুর রহমানের (রূপক) সংশ্লিষ্ট বিষয়ে অভিজ্ঞতার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। পাশাপাশি টার্মস অব রেফারেন্সে বর্ণিত অভিজ্ঞতার কোনো সনদ তাঁর নেই।
বিধি অনুযায়ী, ব্যক্তিভিত্তিক পরামর্শক নির্বাচনপদ্ধতি, আগ্রহ ব্যক্তকরণপত্র দাখিল, আবেদনপত্র উন্মুক্তকরণ, আবেদনপত্র মূল্যায়ন ও সংক্ষিপ্ত তালিকার অনুমোদন থাকতে হবে। কিন্তু বিধি লঙ্ঘন করে শিক্ষাগত যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা না থাকা এবং যথাযথ পদ্ধতি অনুসরণ না করে এ পরামর্শককে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এতে ২৪ লাখ ৫০ হাজার টাকার ক্ষতি হয়েছে।
এ ক্ষেত্রে হাইটেক পার্কের জবাব হচ্ছে, সংশ্লিষ্ট কাজের জন্য অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ব্যক্তি বাংলাদেশে অত্যন্ত কম। আশিকুর রহমান স্টার্টআপ ইকোসিস্টেম নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে আসছেন। তাঁর শিক্ষাগত যোগ্যতা কিছুটা কম হলেও এ বিষয়ে বিশেষায়িত অভিজ্ঞতা ও কর্মদক্ষতার কারণে তাঁকে পরামর্শক হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে পাবলিক প্রকিউরমেন্ট বিধিমালা যথাযথভাবে অনুসরণ করা হয়েছে।
নিরীক্ষার সুপারিশে এ পরামর্শক নিয়োগে দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা আবশ্যক বলে উল্লেখ করা হয়।
এ বিষয়ে আশিকুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, নিয়ম অনুযায়ীই তিনি জীবনবৃত্তান্তসহ আবেদন করেন। নিয়োগপ্রক্রিয়ার সঙ্গে কারা যুক্ত, সেটি তাঁর জানার কথা নয়।