বাড়ির কাছেই হাসপাতাল তবে নেই দরকারি চিকিৎসা

১১টি জেলা সদর হাসপাতাল ও ৯২টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। এক্স–রে, ইসিজি, আলট্রাসনোগ্রাফি পরীক্ষার মতো সেবাগুলো অপর্যাপ্ত। 

মিরসরাইয়ের ইছাখালী ইউনিয়নের বাসিন্দা বিবি খাদিজা (৫৫) বুকে ব্যথা অনুভব করলে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু যন্ত্রপাতি না থাকায় সেখানে কাঙ্ক্ষিত চিকিৎসা তিনি পাননি। পরে তাঁকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের হৃদ্‌রোগ বিভাগে ভর্তি করা হয়। চার দিনের চিকিৎসা শেষে তিনি মিরসরাইয়ের বাড়িতে ফেরেন। পুনরায় অসুস্থ বোধ করলে বিবি খাদিজাকে আবার চমেক হাসপাতালে নেওয়া হয়। চিকিৎসা, যাতায়াতসহ ৩০ হাজার টাকা খরচ হয় পরিবারটির।

মিরসরাইয়ের মতো চট্টগ্রাম বিভাগের ১১টি জেলার ৯২টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে যন্ত্রপাতির স্বল্পতার কারণে প্রয়োজনীয় চিকিৎসাসেবা পাওয়া যায় না। উপজেলা হাসপাতালগুলোয় ২৪৪টি চিকিৎসা যন্ত্রপাতি ও জেনারেটর অচল পড়ে রয়েছে। এ ছাড়া ১১টি জেলা হাসপাতালের ৮১টি যন্ত্র অচল অবস্থায় রয়েছে। বিভাগের জেলা ও উপজেলার ১০৩ হাসপাতালে মোট বিকল যন্ত্রপাতির সংখ্যা ৩২৫। পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজেলা হাসপাতালগুলোয় যন্ত্রপাতির জন্য বেশি হাহাকার চলছে।

উপজেলা পর্যায়ে যদি এক্স-রে, ইসিজি কিংবা ছোটখাটো অস্ত্রোপচারের ব্যবস্থা থাকে, তাহলে প্রান্তিক পর্যায়ে ভালো চিকিৎসা পাওয়া যেত। অবকাঠামো খুব ভালো। কিন্তু যন্ত্রপাতি ও লোকবলের অভাব রয়েছে।
মাহফুজুর রহমান, জনস্বাস্থ্য রক্ষা কমিটি চট্টগ্রামের আহ্বায়ক ও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক

চিকিৎসাসেবা–সংকটের পাশাপাশি বিদ্যুৎ না থাকলে অন্ধকারেও ডুবে থাকতে হয় অনেক হাসপাতালকে। অনেক হাসপাতালে জেনারেটর নেই। আবার জেনারেটর থাকলেও জ্বালানির বরাদ্দ পর্যাপ্ত নয়। তাই প্রান্তিক পর্যায়ে কাঙ্ক্ষিত সেবা না পেয়ে লোকজন ছুটছেন বিভাগীয় হাসপাতালে। সাধারণত উপজেলা হাসপাতালগুলোয় ইসিজি, এক্স–রে, আলট্রাসাউন্ড, অ্যানেসথেসিয়া যন্ত্র, ডায়াথার্মিক যন্ত্র ও সাধারণ অস্ত্রোপচারের (সিজারিয়ানসহ) ব্যবস্থা থাকে।

চট্টগ্রাম বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক মো. মহিউদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, হাসপাতালগুলোর কিছু যন্ত্রপাতি নষ্ট রয়েছে। চাহিদা অনুযায়ী আবার কিছু কিছু দিচ্ছে, কিছু দেবে, এটা চলমান প্রক্রিয়া। উপজেলা পর্যায়ে বেশির ভাগ অস্ত্রোপচার বিশেষ করে সিজারিয়ান চালু রাখার ব্যাপারে তাঁরা সচেষ্ট রয়েছেন। অনেক ক্ষেত্রে কিছু রোগী শহরের হাসপাতালে চলে আসেন। তিন পার্বত্য জেলায় যন্ত্রপাতির সংকট একটু বেশি বলে তিনি জানান।

এক্স-রে মেশিন এখনো বসানো যায়নি। আলট্রাসাউন্ড মেশিনও নষ্ট।
উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ কর্মকর্তা ইউএইচএফপি মানস বিশ্বাস

এক্স–রে করতে হয় বাইরে

সন্দ্বীপ উপজেলার ৫০ শয্যাবিশিষ্ট স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটির অতিগুরুত্বপূর্ণ এক্স–রে মেশিনটি প্রায় চার বছর বাক্সবন্দী। আবার মেশিনটি চালানোর জন্য টেকনোলজিস্টও নেই। উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ কর্মকর্তা ইউএইচএফপি মানস বিশ্বাস বলেন, এক্স-রে মেশিন এখনো বসানো যায়নি। আলট্রাসাউন্ড মেশিনও নষ্ট।

আরেক দ্বীপ মহেশখালী স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স প্রতিষ্ঠার ৪৩ বছরেও এক্স-রে সেবা চালু করা যায়নি। ২০০৯ সালে এক্স–রে মেশিন দেওয়া হলেও অব্যবহৃত অবস্থায় তা নষ্ট হয়ে যায়। এখন নতুন করে আরেকটি এক্স–রে মেশিন দেওয়া হলেও চালু হয়নি।

গত ২২ ফেব্রুয়ারি মহেশখালী স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে প্রথম আলোর প্রতিনিধির সঙ্গে কথা হয় সড়ক দুর্ঘটনায় আহত ছোট মহেশখালী ইউনিয়নের লম্বাঘোনার বাসিন্দা নুরুল আলমের (৩৫)। তিনি বলেন, ‘৫০০ টাকা দিয়ে বাইরে থেকে এক্স–রে করিয়েছি। হাসপাতালে যদি এক্স–রের ব্যবস্থা থাকত, তাহলে খরচ ও ভোগান্তি হতো না।’

মহেশখালী উপজেলার ইউএইচএফপি মুহাম্মদ মাহফুজুল হক বলেন, বিদ্যুতের সাবস্টেশন বসলে নতুন এক্স-রে যন্ত্রটি চালু করা যাবে।

একইভাবে চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া, সাতকানিয়া ও চন্দনাইশ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সেও এক্স–রে সেবা নেই।

চন্দনাইশ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ২২ ফেব্রুয়ারি দুপুর ১২টায় দেখা যায়, বৃদ্ধ মো. করিম একটা এক্স–রে ফিল্ম নিয়ে চিকিৎসকের কক্ষ থেকে বের হচ্ছেন। তিনি বলেন, এই এক্স–রে হাসপাতালের বাইরে থেকে করা হয়েছে ৩৭০ টাকা দিয়ে। এখানে ১৯৯১ সালে একটা এক্স–রে মেশিন দেওয়া হয়। অনেক আগেই সেটা নষ্ট হয়ে গেছে। এখন এক্স–রে কক্ষটি ব্যবহৃত হচ্ছে স্টোরকক্ষ হিসেবে। কিন্তু সাঁটানো আছে এক্স–রে কক্ষ নামফলক।

৫০০ টাকা দিয়ে বাইরে থেকে এক্স–রে করিয়েছি। হাসপাতালে যদি এক্স–রের ব্যবস্থা থাকত, তাহলে খরচ ও ভোগান্তি হতো না।
লম্বাঘোনার বাসিন্দা নুরুল আলম

এভাবে চট্টগ্রাম বিভাগের ২২টি উপজেলা হাসপাতালের এক্স–রে যন্ত্র নষ্ট রয়েছে। এর মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলার ১২টি উপজেলা হাসপাতাল বর্তমানে এক্স–রে সেবা দিতে পারছে না। এ ছাড়া কুমিল্লার তিনটি, কক্সবাজারে একটি হাসপাতালে সেবা দেওয়া যাচ্ছে না। একইভাবে নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ, হাতিয়া ও সোনাইমুড়ি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সেও এক্স–রে মেশিনগুলো পুরোনো। এগুলো তেমন চলে না।

আবার অনেক হাসপাতালে এক্স–রে মেশিন সচল থাকলেও টেকনিশিয়ানের অভাবে সেবা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।

চট্টগ্রাম জেলার চারটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সেও অ্যানেসথেসিয়া যন্ত্র অচল। কিছু কিছু স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ছোটখাটো অস্ত্রোপচার হলেও প্রসূতির অস্ত্রোপচার বা সিজারিয়ান হওয়ার মতো সুবিধা নেই।

অস্ত্রোপচার হয় না

৯২টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মধ্যে ৪২টিতে অস্ত্রোপচারের টেবিলই নেই। অ্যানেসথেসিয়া যন্ত্র নেই ৪৫টি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। আর পার্বত্য চট্টগ্রামের ২২টি হাসপাতালের কোনোটিতে অস্ত্রোপচারের ব্যবস্থা নেই। চট্টগ্রাম জেলার চারটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সেও অ্যানেসথেসিয়া যন্ত্র অচল। কিছু কিছু স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ছোটখাটো অস্ত্রোপচার হলেও প্রসূতির অস্ত্রোপচার বা সিজারিয়ান হওয়ার মতো সুবিধা নেই।

জানতে চাইলে চট্টগ্রাম জেলা সিভিল সার্জন মোহাম্মদ ইলিয়াছ চৌধুরী দাবি করেন, সন্দ্বীপ ও কর্ণফুলী উপজেলা ছাড়া বাকি সব কটিতে অস্ত্রোপচার করা হয়। তবে অবেদনবিদের অভাবসহ নানা কারণে দু–একটি হাসপাতালে নিয়মিত অস্ত্রোপচার করা হয় না।

কিন্তু চমেক হাসপাতালে দেখা যায় উপজেলা থেকে আসা রোগীর ভিড়। এ হাসপাতালের প্রসূতি বিভাগের বারান্দায় কথা হয় হাটহাজারীর রাজমিস্ত্রি নূরে আলমের সঙ্গে। তাঁর স্ত্রী এখানে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে ৫ মে একটি পুত্রসন্তান প্রসব করেছেন। হাটহাজারী স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে অস্ত্রোপচার না করার কারণ হলো রক্ত দরকার হলে তা ব্যবস্থা করা যায় না।

কয়েকটি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কিছু যন্ত্রপাতি নষ্ট রয়েছে। ওটি সব কটিতে হয়, তবে নিয়মিত না। কনসালট্যান্টের অপ্রতুলতায় পালা করে কিছু কিছু সিজার হয়।
নোয়াখালীর সিভিল সার্জন মাসুম ইফতেখার

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জনবল ও যন্ত্রপাতিসংকটসহ নানা কারণে চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া ও রাউজান উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স হাসপাতালেও নিয়মিত অস্ত্রোপচার করা হয় না। এ ছাড়া চাঁদপুরের একটিতে, লক্ষ্মীপুরে দুটিতে, ফেনীতে চারটি, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় তিনটি, নোয়াখালীতে তিনটি ও কুমিল্লায় তিনটি উপজেলা হাসপাতালে নিয়মিত অস্ত্রোপচার হয় না।

নোয়াখালীর সিভিল সার্জন মাসুম ইফতেখার প্রথম আলোকে বলেন, ‘কয়েকটি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কিছু যন্ত্রপাতি নষ্ট রয়েছে। ওটি সব কটিতে হয়, তবে নিয়মিত না। কনসালট্যান্টের অপ্রতুলতায় পালা করে কিছু কিছু সিজার হয়।’

অন্ধকারে ৩৮ হাসপাতাল

চট্টগ্রাম বিভাগের ৩৮টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স বিদ্যুৎ চলে গেলে অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি সাতটি হাসপাতাল রয়েছে চট্টগ্রামের বিভিন্ন উপজেলায়। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রামের বান্দরবান। এখানে ছয়টি হাসপাতাল বিকল্প বিদ্যুতের ব্যবস্থা ছাড়া চলছে। ৯২টি উপজেলা হাসপাতালের ৪৬টি জেনারেটর ইতিমধ্যে বিকল হয়ে পড়ে রয়েছে। এর মধ্যে ৩২টি মেরামতযোগ্য হলেও সেগুলো পড়ে রয়েছে অযত্ন–অবহেলায়।

চাঁদপুরে চারটি, লক্ষ্মীপুরে একটি, কক্সবাজারে একটি, ফেনীতে চারটি, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় পাঁচটি, নোয়াখালীতে তিনটি, কুমিল্লায় একটি, রাঙামাটিতে দুটি ও খাগড়াছড়িতে চারটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স বিদ্যুৎ না থাকলে অন্ধকারে থাকে। কিছু কিছু হাসপাতাল চার্জলাইট কিংবা আইপিএস দিয়ে চলে কিছু সময়।

চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের জেনারেটর ১৮ বছর ধরে নষ্ট। বিকল্প হিসেবে চার্জলাইট ও সৌরবিদ্যুতে স্বল্প পরিসরে আলো জ্বালানো হয়।

নোয়াখালীর চাটখিল ও সোনাইমুড়ী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে জেনারেটর নেই। বিদ্যুৎ চলে গেলে ওখানে অন্ধকারে থাকতে হয় রোগী ও চিকিৎসকদের।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্র জানায়, চট্টগ্রাম বিভাগের ১১টি জেলা হাসপাতালের মধ্যে ছয়টি ১০০ শয্যার। বাকিগুলো ২৫০ শয্যার। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলো ৩১ থেকে ৫০ শয্যার মধ্যে। জেলা হাসপাতালের এক্স–রে যন্ত্র ৩৬টি, আলট্রাসনোগ্রাম যন্ত্র ২৪টি, ইসিজি মেশিন ৫৮টি ও জেনারেটর ১৭টি অচল রয়েছে। উপজেলা হাসপাতালগুলোর ২৯টিতে আলট্রাসাউন্ড মেশিন নেই। আবার আলট্রাসাউন্ড থাকলেও তার জন্য উপজেলা পর্যায়ে কোনো সনোলজিস্টের পদ নেই।

পার্বত্য চট্টগ্রামে বেশি সংকট

রাঙামাটির পাঁচটি উপজেলা হাসপাতালে এক্স–রে যন্ত্র, ডায়াথার্মিক যন্ত্র, অ্যানেসথেসিয়া যন্ত্র নষ্ট অথবা নেই। নেই ওটি টেবিলও। আবার দুটি হাসপাতালে এসব যন্ত্রের পাশাপাশি আলট্রাসাউন্ড যন্ত্র এবং জেনারেটর সুবিধাও নেই। বান্দরবানের তিনটি উপজেলা হাসপাতালে ডায়াথার্মিক, অ্যানেসথেসিয়া, এক্স–রে মেশিন, ওটি টেবিল ও জেনারেটর নেই। আবার পাঁচটিতে এক্স–রে মেশিন ও ইসিজি মেশিন ছাড়া বাকি কোনো যন্ত্র নেই। খাগড়াছড়ির সাতটি উপজেলা হাসপাতালে ডায়াথার্মিক, ওটি টেবিল, আলট্রাসাউন্ড নেই। এর মধ্যে তিনটিতে এসবের পাশাপাশি এক্স–রে মেশিনও নেই। আর একটি হাসপাতালে কোনো যন্ত্রই নেই।

জনস্বাস্থ্য রক্ষা কমিটি চট্টগ্রামের আহ্বায়ক, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক মাহফুজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, উপজেলা পর্যায়ে যদি এক্স–রে, ইসিজি কিংবা ছোটখাটো অস্ত্রোপচারের ব্যবস্থা থাকে, তাহলে প্রান্তিক পর্যায়ে ভালো চিকিৎসা পাওয়া যেত। অবকাঠামো খুব ভালো। কিন্তু যন্ত্রপাতি ও লোকবলের অভাব রয়েছে। এগুলোকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করা হলে আর জেলা হাসপাতালে রোগীদের আসতে হতো না।