কাউন্সিলরদের অপসারণে একাধিক কার্যালয়ের দায়িত্বে একজন কর্মকর্তা।
কার্যালয়ের ঠিকানা পরিবর্তনের কারণেও ভোগান্তিতে পড়ছেন নগরবাসী।
ছেলেকে বিদ্যালয়ে ভর্তি করার জন্য জন্মনিবন্ধন সনদ প্রয়োজন। সেই সনদ নিতে গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে ঢাকা উত্তর সিটির ১৮ নম্বর ওয়ার্ড কার্যালয়ে যান ফেরদৌস হোসেন। কার্যালয়টি নদ্দার কালাচাঁদপুর এলাকায়। তবে সেখানে গিয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে না পেয়ে ফিরে যেতে হয় তাঁকে। জানালেন, এ নিয়ে তৃতীয়বারের মতো ওয়ার্ড কার্যালয়ে এসেও ছেলের জন্মসনদ পেলেন না।
ফেরদৌস হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, সচিব না থাকায় তাঁকে আরেক দিন আসতে বলা হয়েছে। তবে কবে আসতে হবে, তা বলতে পারেননি কার্যালয়ের কেউ। এমন পরিস্থিতিতে ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে ছেলেকে কীভাবে বিদ্যালয়ে ভর্তি করাবেন, তা নিয়ে চিন্তিত এই অভিভাবক।
জন্ম–মৃত্যুসহ নানা ধরনের সনদ পেতে অনেক বেশি সময় লাগছে। কাউন্সিলরদের না থাকা ও কর্মী–সংকটের কথা বলছে কর্তৃপক্ষ।
১৮ নম্বর ওয়ার্ডের সচিব সালাহ উদ্দীন মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর মূল দায়িত্ব ১৯ নম্বর ওয়ার্ড কার্যালয়ে। সপ্তাহে দুই দিন আধবেলা এই ওয়ার্ডে বসেন। কারও জরুরি প্রয়োজন হলে ১৯ নম্বর ওয়ার্ডের কার্যালয়ে যেতে বলেন। এ কারণে সেবাপ্রত্যাশীদের ঠিক সময়ে সেবা দিতে পারছেন না।
গতকাল ঢাকা উত্তর সিটির ছয়টি ওয়ার্ডের কার্যালয় ও দক্ষিণ সিটির প্রধান কার্যালয় নগর ভবনে (সেখানে অঞ্চল-১ ও ৪–এর কার্যক্রম পরিচালিত হয়) গিয়ে দেখা যায়, সনদের জন্য এসেছেন অনেকে। কিন্তু সনদ পেতে ভোগান্তির বিষয়টি উঠে এল তাঁদের কথায়। তাঁদের কারও কারও সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, সেবা পেতে সময় লাগছে কয়েক দিন। কিছু ক্ষেত্রে লাগছে কয়েক সপ্তাহও।
খোঁজ নিয়ে জানা গেল, অনেক ক্ষেত্রে একজন সচিবকে একাধিক ওয়ার্ডের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এ কারণে তাঁদের পাওয়াও যাচ্ছে না। ঠিকানা বদলে যাওয়ার কারণে কার্যালয় খুঁজে পেতেও সমস্যা হচ্ছে। আন্দোলনে ভাঙচুর ও লুটপাটের পর প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম না পাওয়ায় বাধাগ্রস্ত হচ্ছে দাপ্তরিক কাজ। এ ছাড়া সেবাপ্রত্যাশীদের চাপ বেশি থাকায় তা সামলাতে হিমশিম খাচ্ছেন কর্মকর্তা–কর্মচারীরা।
ঢাকা উত্তর সিটির তিনটি ওয়ার্ডে একাধিক ওয়ার্ড সচিবকে অতিরিক্ত দায়িত্ব দিয়ে রাখা হয়েছে। কিন্তু ওই ওয়ার্ড সচিবেরা কখন, কোথায় দায়িত্ব পালন করবেন, সেটি নির্ধারণ করে দেওয়া হয়নি। ওয়ার্ড কার্যালয়গুলোয় এ–সংক্রান্ত নোটিশও টাঙানো নেই।
ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ২৬ সেপ্টেম্বর ঢাকা উত্তর, দক্ষিণ সিটিসহ দেশের অন্যান্য সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলরদের অপসারণ করা হয়। ১ অক্টোবর কাউন্সিলর কার্যালয়ে সেবাগুলোর জন্য দায়িত্ব দেওয়া হয় প্রতিটি অঞ্চলের আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তাদের। ঢাকার দুই সিটিতে ওয়ার্ড আছে ১২৯টি। দুই সিটিতে ২০টি অঞ্চল রয়েছে। মূলত তখন থেকেই সনদ–সংক্রান্ত সেবা পেতে নগরবাসীর ভোগান্তি শুরু হয়।
ঢাকা উত্তর সিটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মীর খায়রুল আলম গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, জনপ্রতিনিধি কিংবা ওয়ার্ড কাউন্সিলরদের কাছে এলাকাবাসী ব্যক্তিগতভাবে পরিচিত। কিন্তু কর্মকর্তারা স্থানীয় লোকজনকে চেনেন না। অনেক সময় সনদ দেওয়ার ক্ষেত্রে যাচাই করতে হয়। মূলত ভুলভ্রান্তি এড়াতে ও সঠিক তথ্য যাচাই করতে বিলম্ব হচ্ছে।
ওয়ার্ড কাউন্সিলরের কার্যালয় ১৪ ধরনের সেবা বা সনদ দেওয়া হয়ে থাকে। এর মধ্যে জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন, নাগরিক, চারিত্রিক, উত্তরাধিকারী (ওয়ারিশান) রয়েছে। পাশাপাশি বিভিন্ন প্রত্যয়ন, অনাপত্তিপত্র (প্রযোজ্য ক্ষেত্রে), জাতীয় পরিচয়পত্র ও ভোটার তালিকায় সত্যায়ন দেওয়া হয় কাউন্সিলর কার্যালয় থেকে।
একাধিক দায়িত্ব, ঠিকানা পরিবর্তন
ঢাকা উত্তর সিটির তিনটি ওয়ার্ডে একাধিক ওয়ার্ড সচিবকে অতিরিক্ত দায়িত্ব দিয়ে রাখা হয়েছে। কিন্তু ওই ওয়ার্ড সচিবেরা কখন, কোথায় দায়িত্ব পালন করবেন, সেটি নির্ধারণ করে দেওয়া হয়নি। ওয়ার্ড কার্যালয়গুলোয় এ–সংক্রান্ত নোটিশও টাঙানো নেই। যে কারণে অনেককে সচিবকে না পেয়ে ফিরে যেতে দেখা গেল গতকাল।
দক্ষিণ সিটির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দক্ষিণ সিটির ৭৫ জন কাউন্সিলর যে কাজ করতেন, সেই কাজ ১০ জন আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে পালন করছেন। তাই সেবা পেতে নাগরিকদের ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে।
মিরপুরের একটি ওয়ার্ডে উত্তরাধিকারী (ওয়ারিশান) সনদের জন্য আবেদন করেন সোলায়মান কবির। তিনি বলেন, সনদ পেতে তাঁর স্বজনেরা তিন সপ্তাহ ধরে ঘুরছেন। একাধিকবার কার্যালয়ে তাঁকে ডাকা হয়েছে। কাগজপত্রও চাওয়া হয়েছে। সেগুলো তিনি দিয়েছেন; কিন্তু এখন কার্যালয় থেকে বলা হচ্ছে, নথি আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে গেলে তাঁদেরও সেখানে যেতে হবে।
একাধিক ওয়ার্ডের সচিবেরা বলছেন, কাউন্সিলর থাকলে সনদ তাৎক্ষণিক দেওয়া যেত। কিন্তু এখন সব নথি আঞ্চলিক কার্যালয়ে যাচ্ছে। ফলে যেকোনো সনদ পেতেই কমপক্ষে তিন দিন সময় লাগছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আরও বেশি সময় লাগছে।
ঢাকা উত্তর সিটির অধিকাংশ ওয়ার্ডেই কাউন্সিলররা হয় নিজেদের বাসায়, নয়তো ভাড়া বাসায় কার্যক্রম পরিচালনা করতেন। কাউন্সিলর না থাকায় এমন বেশ কিছু কার্যালয়ের ঠিকানা বদলেছে। যদিও এর সঠিক হিসাব সিটি করপোরেশনে নেই।
মিরপুরের ইব্রাহিমপুর এলাকায় ছিল ঢাকা উত্তর সিটির ১৬ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলরের কার্যালয়। কিন্তু আগের ঠিকানায় গিয়ে কার্যালয় পাওয়া গেল না। পরে ওয়ার্ড সচিবের সঙ্গে কথা বলে নতুন কার্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, ফাইলপত্রের স্তূপের পাশে চেয়ার-টেবিল পেতে কাজ করছেন ওয়ার্ড সচিবসহ সিটি করপোরেশনের কর্মীরা। তাঁদের ঘিরে ধরে কাগজপত্র জমা দিচ্ছেন সেবাপ্রত্যাশীরা।
সেখানে নাগরিক সনদ নিতে যাওয়া মাসুদ হোসেন নামের একজন জানালেন, আগের ঠিকানায় গিয়ে দেখেছেন, কাউন্সিলর কার্যালয়ের সাইনবোর্ড থাকলেও ভেতরে কার্যালয় নেই। স্থানীয় লোকজনের কাছে শুনে এখানে এসেছেন।
ভাঙচুর ও লুটপাটের ঘটনার পরে এখনো অনেক ওয়ার্ডেই দাপ্তরিক কাজে প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম (কম্পিউটার, প্রিন্টার ও অন্যান্য জিনিস) আবার বরাদ্দ দেওয়া হয়নি। এসব ওয়ার্ডের সচিবেরা কেউ পুরোনো কম্পিউটার দিয়ে, কেউ ভাড়া করে কম্পিউটার এনে কিংবা কেউ কেউ মুঠোফোনে যতটুকু করা যায়, সেভাবে সেবা দিচ্ছেন। এ কারণেও সেবা দিতে বিলম্ব হচ্ছে বলে জানালেন তাঁরা।
জানতে চাইলে ঢাকা দক্ষিণ সিটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মিজানুর রহমান গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, আগে কাউন্সিলরদের সার্বক্ষণিক পাওয়া যেত। এখন নাগরিকদের হয়তো নির্দিষ্ট সময়ে এই সেবা নিতে হচ্ছে। তবে জরুরি বুঝে তাৎক্ষণিক সেবা দিতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সহযোগিতার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
ওয়ার্ড কাউন্সিলরের কার্যালয় ১৪ ধরনের সেবা বা সনদ দেওয়া হয়ে থাকে। এর মধ্যে জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন, নাগরিক, চারিত্রিক, উত্তরাধিকারী (ওয়ারিশান) রয়েছে। পাশাপাশি বিভিন্ন প্রত্যয়ন, অনাপত্তিপত্র (প্রযোজ্য ক্ষেত্রে), জাতীয় পরিচয়পত্র ও ভোটার তালিকায় সত্যায়ন দেওয়া হয় কাউন্সিলর কার্যালয় থেকে। এ ছাড়া মশক ও পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের কাজের তদারকি এবং টিসিবির পণ্য বিতরণের কাজও পরিচালিত হয় ওয়ার্ড কার্যালয় থেকে।