নিজের একটা স্থায়ী ঠিকানার স্বপ্ন কম-বেশি সবারই থাকে। নিজের জন্য না হলেও পরবর্তী প্রজন্মের সুখের কথা ভেবে অনেকেই এক টুকরো জমি বা ফ্ল্যাটের বন্দোবস্ত করার চিন্তা করেন। অনেক সময় জমি ও ফ্ল্যাটের খুঁটিনাটি বিষয়গুলো সম্পর্কে পুরোপুরি ধারণা না থাকার কারণে প্রতারিত হওয়ার ঝুঁকি থেকে যায়। সেই সঙ্গে আইনি জটিলতা তো আছেই। অনেকেই সারা জীবনের সঞ্চিত অর্থ লগ্নি করেই স্থায়ী আবাসের স্বপ্ন দেখেন। কিন্তু জমি বা ফ্ল্যাট কেনার সময় অনেক ক্ষেত্রে স্বপ্ন আর বাস্তবের মধ্যে সমন্বয়হীনতা থেকে যায়। তাই জমি বা ফ্ল্যাট কেনার আগে অভিজ্ঞ ও বিশেষজ্ঞের মাধ্যমে যাচাই করে নিতে হবে।
এ ক্ষেত্রে কী ধরনের আইনি প্রস্তুতি গ্রহণ করা যায়, সে বিষয়ে পরামর্শ দিয়েছেন বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী তানজিম আল ইসলাম। পাশাপাশি ফ্ল্যাট বা জমি কেনার ক্ষেত্রে দরকারি সচেতনতা সম্পর্কেও জানিয়েছেন তিনি।
প্রথমেই প্রস্তাবিত জমিটি সরেজমিনে দেখতে হবে। সংলগ্ন জমির মালিক বা এলাকাবাসীর কাছ থেকে জমির বিষয়ে খোঁজখবর নিতে হবে। বিক্রেতার কাছ থেকে তার মালিকানার প্রমাণস্বরূপ দলিলাদি ও অন্যান্য কাগজপত্রের সত্যায়িত ফটোকপি চেয়ে নিতে হবে। জমির দলিল, ওয়ারিশ সনদ (প্রযোজ্য ক্ষেত্রে), সিএস/ এসএ/ আরএস/ মহানগর/ মিউটেশন পরচা, ডিসিআর, খাজনার দাখিলা ইত্যাদির ফটোকপি সংগ্রহের চেষ্টা করতে হবে। তহসিল অফিসে কর্মরত কারও থেকে কাগজপত্রগুলো যাচাইয়ের জন্য সহায়তা নিতে পারেন। কারণ জমির প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে সঠিক তথ্য কেবল তহসিল অফিস থেকেই পেতে পারেন।
জমিটির কাগজপত্র যাচাইয়ে সন্তুষ্ট হয়ে কেনার বিষয়ে মনস্থির করলে বা বায়না করলে আপনার নাম, ঠিকানা, জমির দাগ-খতিয়ান উল্লেখ করে জমিতে একটি সাইনবোর্ড দিন। একই সঙ্গে পত্রিকায় ছোট আকারের হলেও একটি বিজ্ঞাপন দিন। এতে পরে কোনো সমস্যা হলেও আপনি আইনগত সুবিধা পাবেন। তা ছাড়া এই জমির অন্য কোনো দাবিদার বা ওয়ারিশ থাকলে, মামলা-মোকদ্দমাসহ অন্য কোনো সমস্যা থাকলে তা প্রকাশিত হবে এবং আপনি ভবিষ্যতের একটি স্থায়ী ও জটিল সমস্যা থেকে রক্ষা পাবেন।
ফ্ল্যাট কেনার ক্ষেত্রে সবার আগে দেখতে হবে, যে প্রতিষ্ঠান থেকে ফ্ল্যাট কেনার পরিকল্পনা করছেন, সেই প্রতিষ্ঠানটির বৈধতা ও ফ্ল্যাট হস্তান্তরের অতীত ইতিহাস। এরপর দেখতে হবে, যে প্রকল্পে বা ভবনে আপনি ফ্ল্যাট কেনার কথা ভাবছেন, সেই প্রকল্প যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদিত কিনা। পাশাপাশি যে জমির ওপর আপনার ফ্ল্যাটটি থাকবে, ওই স্থানের জমির দলিলপত্র যাচাই করে নেওয়া ভালো। ওপরের বিষয়গুলোতে সন্তুষ্ট হওয়ার পর দেখতে হবে, যে ফ্ল্যাটটি কিনছেন, সেটির আয়তন ঠিক আছে কি না।
এখানে জেনে রাখা ভালো, ফ্ল্যাট বা প্লট কিনতে হলে ক্রেতার অবশ্যই কর শনাক্তকরণ নম্বর (টিআইএন) থাকতে হবে। কারণ, টিআইএন ছাড়া ফ্ল্যাট বা জমি নিবন্ধন করা যাবে না। ফ্ল্যাট কেনার ক্ষেত্রে আরেকটি জরুরি বিষয় হচ্ছে, কী ধরনের ভবনে কিনছেন। এ ছাড়া ফ্ল্যাট ক্রয়-বিক্রয়সংক্রান্ত সব শর্ত ভালো করে বুঝে ও দেখে নিতে হবে। এরপরও কোনো সমস্যার সম্মুখীন হলে ‘রিয়েল এস্টেট উন্নয়ন এবং ব্যবস্থাপনা আইন ২০১০’-এর সাহায্য নিতে পারবেন। যখন আপনি ফ্ল্যাট কেনার উদ্যোগ নিচ্ছেন, তখনই আইনি সহায়তায় চুক্তি করতে পারেন।
চুক্তিতে সুস্পষ্টভাবে ফ্ল্যাট কেনার শর্তগুলো, ভবন নির্মাণে ব্যবহৃত উপকরণ, ফ্ল্যাটের অনুমোদিত নকশা, ভবনের যে ফ্ল্যাটটি কিনছেন এবং ক্রেতা যদি কোনো উন্নত মানের সরঞ্জাম ব্যবহার করতে চান তার দুই পক্ষের পারস্পরিক সম্মতি—এ বিষয়গুলো উল্লেখ থাকতে হবে। উপরিউক্ত যেকোনো বিষয় আবাসন নির্মাতা কর্তৃপক্ষ ক্রেতাকে দেখাতে এবং তা দিতে বাধ্য থাকবেন।
চুক্তি অনুযায়ী ফ্ল্যাট বা জমি বুঝে না পেলে প্রথমে নিজেদের মধ্যে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করবেন। সমাধান না হলে বিষয়টি ‘সালিস আইন ২০০১’ মোতাবেক সালিশি ট্রাইব্যুনালের শরণাপন্ন হতে হবে।
সর্বোপরি বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী তানজিম আল ইসলাম বলেন, ‘বিক্রেতাপ্রতিষ্ঠান বা যে ব্যক্তি থেকে কিনছেন তাঁর বা তাঁদের সম্পর্কে ভালোভাবে খোঁজখবর নেওয়ার পাশাপাশি জমির দলিলপত্র ও চুক্তিপত্রগুলো একজন আইনজীবীকে দেখিয়ে নিয়ে ফ্ল্যাট বা জমি বুকিং দেওয়া ভালো। এ ক্ষেত্রে অনেকে আছেন আইনি ঝামেলায় পড়লে নিজেই সমাধান করার চেষ্টা করেন, যা হিতে বিপরীত হয়। তাই ক্রেতাকে কারও দ্বারা প্রলুব্ধ হয়ে তাড়াহুড়ো করে কেনার চুক্তি না করাই হবে বুদ্ধিমানের কাজ।’