খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ১০০% রোগী অ্যান্টিবায়োটিক পেয়েছিলেন।
১ হাজার ২১৬ জন রোগীকে ১০ দিনের বেশি অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করতে বলা হয়েছিল।
সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয়েছে সেফট্রিয়াক্সন।
করোনা মহামারিতে অ্যান্টিবায়োটিকের অযৌক্তিক ব্যবহার অনেক বেড়ে যায়। গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে করোনা রোগীদের ৭৫ শতাংশকে অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া হয়েছিল প্রয়োজন ছাড়াই। অ্যান্টিবায়োটিকের এই অতিরিক্ত ও অপ্রয়োজনীয় ব্যবহার জনস্বাস্থ্যের ঝুঁকি বাড়িয়েছে।
মহামারিতে অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার নিয়ে দেশে-বিদেশে অনেক গবেষণা হয়েছে। জুন মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে সংক্রামক রোগবিষয়ক সাময়িকী ইন্টারন্যাশনাল সোসাইটি ফর ইনফেকশাস ডিজিজেস-এ প্রকাশিত গবেষণা প্রবন্ধে করোনাকালে বাংলাদেশে ব্যাপকভাবে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের বিষয়টি উঠে এসেছে। তাতে বলা হয়েছে, করোনার চিকিৎসায় অ্যান্টিবায়োটিকের প্রয়োজন ছিল খুবই সীমিত, কিন্তু বাংলাদেশে অত্যধিক মাত্রায় অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা হয়েছে।
গবেষণাটি হয়েছে পাঁচটি হাসপাতালে ভর্তি থাকা ৩ হাজার ৬৯৩ জন করোনা রোগীর ওপর। হাসপাতাল পাঁচটি হচ্ছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ), ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, সিলেট শহীদ শামসুদ্দিন আহমদ হাসপাতাল, রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। এসব হাসপাতালে ২০২০ সালের জুলাই থেকে ২০২১ সালের জুনের মধ্যে ভর্তি হওয়া রোগীদের কী পরিমাণ অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া হয়েছিল, তা দেখা হয়েছে।
করোনার চিকিৎসায় অ্যান্টিবায়োটিকের ভূমিকা কম। রোগীদের যথেচ্ছ অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া হয়েছিল।
গবেষণায় হাসপাতালের নথির তথ্য নেওয়ার পাশাপাশি অনেক রোগীর সাক্ষাৎকারের তথ্য ব্যবহার করা হয়। অ্যান্টিবায়োটিকের স্পর্শকাতরতার তথ্য নেওয়া হয়েছিল রোগনির্ণয় প্রতিবেদন থেকে।
গবেষণায় যুক্ত ছিলেন বিএসএমএমইউর ইন্টারনাল মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ফজলে রাব্বি চৌধুরী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘কোভিড-১৯ হচ্ছে ভাইরাসজনিত রোগ। ভাইরাসের ক্ষেত্রে অ্যান্টিবায়োটিকের ভূমিকা না থাকলেও রোগীদের তা দেওয়া হচ্ছিল বাছবিচারহীনভাবে। এ বিষয়ে সারা দেশের চিত্র আমাদের জানা ছিল না। সেটা জানার জন্য আমরা এ গবেষণার উদ্যোগ নিই। কারণ, অ্যান্টিবায়োটিক কার্যকর থাকা না থাকার সঙ্গে এর ব্যবহারের সম্পর্ক আছে। এটি গুরুত্বপূর্ণ জনস্বাস্থ্যের বিষয়।’
বাংলাদেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয় ২০২০ সালের ৮ মার্চ। মহামারির প্রকোপ ব্যাপকভাবে দেখা দেওয়ার আগে থেকেই দেশে নির্বিচার অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহৃত হয়ে আসছিল। সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণাপ্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) ছাড়াও একাধিক প্রতিষ্ঠান বলে আসছিল যে ব্যাপক ব্যবহারের কারণে কিছু কিছু অ্যান্টিবায়োটিক তাদের কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলছে। মহামারি শুরু হওয়ার পর অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার বেড়ে যায়, প্রয়োজন আছে কি নেই, তা বিবেচনায় নেওয়া হয়নি।
গবেষকেরা কী পেয়েছেন
গবেষণায় অংশ নেওয়া রোগীর ৬৫ শতাংশ ছিলেন পুরুষ, বাকি ৩৫ শতাংশ নারী। রোগীদের গড় বয়স ছিল ৫২ বছর। তবে কোনো রোগীর বয়স ১১ বছরও ছিল, কারও ১১০ বছরও ছিল। মোট ৩ হাজার ৬৯৩ জন রোগীর মধ্যে ১ হাজার ২৩ জনের করোনার পাশাপাশি উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, শ্বাসতন্ত্রের রোগ ও হৃদ্রোগ ছিল।
গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত পাঁচটি হাসপাতালের ৯৪ দশমিক ৪ শতাংশ রোগীকে অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া হয়েছিল। এর মধ্যে অ্যান্টিবায়োটিক দরকার ছিল ১৮ দশমিক ৯ শতাংশ রোগীর। অর্থাৎ বাকি ৭৫ শতাংশ রোগীর অ্যান্টিবায়োটিকের দরকার ছিল না।
সাধারণত সাত দিন পর্যন্ত অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করতে বলা হয়। কিন্তু গবেষণায় দেখা যায়, ১ হাজার ২১৬ জন রোগীকে ১০ দিনের বেশি ব্যবহারের পরামর্শ দেওয়া হয়। এমন রোগী পাওয়া গেছে, যাঁকে ৩২ দিন ব্যবহার করতে বলা হয়।
তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ৮৮ দশমিক ৩ শতাংশ রোগীকে একটিমাত্র অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া হয়েছে। ৬ দশমিক ৫ শতাংশ রোগীকে একাধিক অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া হয়। যেসব অ্যান্টিবায়োটিক বেশি ব্যবহৃত হয়েছিল, এর মধ্যে আছে সেফট্রিয়াক্সন, কো-অ্যামোক্সিক্লেভ, অ্যাজিথ্রোমাইসিন, মেরোপেনাম।
অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের হার সবচেয়ে বেশি দেখা গেছে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। ওই হাসপাতালের ১০০ শতাংশ করোনা রোগীকে অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া হয়েছিল। সবচেয়ে হার কম দেখা গেছে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। এই হাসপাতালে ৮৮ শতাংশ করোনা রোগীকে অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া হয়।
ক্ষতি কী হয়েছে
ওষুধবিশেষজ্ঞরা বলেন, যতটুকু অ্যান্টিবায়োটিক দরকার, ঠিক ততটুকু ব্যবহার করতে হয়। বেশি ব্যবহৃত হলে অ্যান্টিবায়োটিকের কার্যকারিতা নষ্ট হয়। অর্থাৎ অ্যান্টিবায়োটিকে অসুখ ভালো হয় না। তখন নতুন অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করতে হয়। এতে রোগীর খরচ বাড়ে। নতুন অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার যৌক্তিক না হলে তা-ও কার্যকারিতা হারায়। তবে গবেষণার আওতায় যেসব রোগী অপ্রয়োজনীয় অ্যান্টিবায়োটিক পেয়েছেন, তাঁদের সম্ভাব্য ক্ষতি কী, সে বিষয়টি গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত ছিল না। এটি শুধু বাংলাদেশের নয়, এটি বৈশ্বিক সমস্যা।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা গত ২৬ এপ্রিল এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলেছে, কোভিড-১৯ মহামারিতে বিশ্বব্যাপী ব্যাপকভাবে অ্যান্টিবায়োটিকের অতি ব্যবহার হয়েছে, যা অ্যান্টিবায়োটিকের অকার্যকারিতার বিস্তারকে আরও খারাপের দিকে নিয়েছে। ব্যাকটেরিয়াজনিত সংক্রমণের কারণে হাসপাতালে ভর্তি ৮ শতাংশ রোগীর অ্যান্টিবায়োটিকের দরকার ছিল। যদি তা কোনো কাজে লাগে, এ অনুমান থেকে বিশ্বব্যাপী প্রতি চারজন রোগীর তিনজনকে অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া হয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আরও বলছে, কোভিড-১৯ থেকে সেরে ওঠার ক্ষেত্রে অ্যান্টিবায়োটিকের কোনো ভূমিকা ছিল না। তবে যেসব রোগীর কোভিডের পাশাপাশি অন্য রোগ ছিল না, তাঁদের ক্ষেত্রে অ্যান্টিবায়োটিক ক্ষতি করেছে।
বিএসএমএমইউর ফার্মাকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান এবং এই গবেষণাপত্রের সহলেখক অধ্যাপক মো. সাইদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘অ্যান্টিবায়োটিকের যথেচ্ছ ব্যবহার একটি ভয়ানক প্রবণতা। এটা অনেকটা অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। পেশাজীবীদের প্রশিক্ষণ, আইন প্রয়োগ, জনসচেতনতা বৃদ্ধি—সবকিছু একসঙ্গে করতে হবে এবং এখনই করতে হবে। না করলে আমাদের প্রত্যেকের স্বাস্থ্য বড় ঝুঁকিতে পড়বে।’