ফেনীর সোনাগাজী উপজেলার বড় ফেনী নদীতে ইদানীং বেশ ইলিশ ধরা পড়ছে। নদীটিতে এত ইলিশ ধরা পড়ায় স্থানীয় জেলেরা বেজায় খুশি। তাঁদের এই খুশিতে নতুন মাত্রা যুক্ত করছে বড় আকারের ইলিশ।
এই তো গত বৃহস্পতিবার বিকেলে বড় ফেনী নদীতে জেলেদের জালে ধরা পড়ে ৩ কেজি ও ২ কেজির ওজনের ৩৫টি ইলিশ। সোনাগাজী উপজেলার আদর্শগ্রাম এলাকার জেলেদের জালে এই ইলিশগুলো ধরা পড়ে।
ওজন করে দেখা যায়, ৩৫টি ইলিশের মধ্যে ৫টির ওজন প্রায় ৩ কেজি করে। বাকি ৩০টি ইলিশের প্রতিটির ওজন ২ কেজির ওপরে।
স্থানীয় জেলে, মৎস্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তা ও ইলিশগবেষকেরা বলছেন, বড় ফেনী নদীতে যে বেশি বেশি ও বড় বড় ইলিশ ধরা পড়ছে, তা অত্যন্ত আনন্দের খবর। কারণ, নদীটি তার হারানো সম্পদ ফিরে পেতে চলছে। কেননা, ১৫ থেকে ২০ বছর আগে নদীটিতে প্রচুর ইলিশ ধরা পড়ত। সেই ইলিশের আকারও ছিল বড়। মাঝে কিছুকাল নদীটি তার এই রুপালি সম্পদ হারিয়ে ফেলেছিল। এখন তা ফিরে পাওয়ার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে।
বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট, নদীকেন্দ্র চাঁদপুরের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. আনিছুর রহমান বলেন, ‘বড় ফেনী নদীতে বেশি ইলিশ পাওয়াটা প্রাকৃতিক দিক থেকে তাৎপর্যপূর্ণ। নদীটিতে যে স্বাভাবিকতা ফিরে আসছে, এটা তারই প্রমাণ।’
সীমান্ত নদী
বড় ফেনী একটি সীমান্ত নদী। নদীটির উৎপত্তিস্থল ভারতের ত্রিপুরা সীমান্তসংলগ্ন বাংলাদেশের খাগড়াছড়ির মাটিরাঙ্গা উপজেলা।
পানিবিশেষজ্ঞ ম. ইনামুল হক বলেন, মাটিরাঙ্গার ফেনীছড়া থেকে বড় ফেনী নদীর জন্ম। নদীটি বাংলাদেশ-ভারতের সীমান্ত এলাকা দিয়ে ৮০ কিলোমিটার প্রবাহিত হয়েছে। তারপর নদীটি ফেনীর আমলিঘাটের কাছে বাংলাদেশে পুরোপুরি প্রবেশ করেছে। ফেনী সেচ প্রকল্প এই নদীর অববাহিকাতেই। এরপর নদীটি ফেনী রেগুলেটর হয়ে সন্দ্বীপ চ্যানেলে গিয়ে পড়েছে।
ইলিশের ইতিকথা
হরলাল জলদাস প্রায় ৪০ বছর ধরে ফেনী নদীতে মাছ ধরেন। তাঁর বাড়ি চরখন্দকার জেলেপাড়ায়। জেলেপাড়াটি সোনাগাজী উপজেলা সদর থেকে দক্ষিণ–পূর্ব দিকে অবস্থিত। উপজেলা সদর থেকে থেকে এই জেলেপাড়ার দূরত্ব প্রায় সাত কিলোমিটার।
ইলিশের মৌসুমে বড় ফেনী ও ছোট ফেনী নদীর শেষ প্রান্তে বঙ্গোপসাগরের মোহনায় ইলিশ শিকার করেন হরলাল। তিনি জানান, ১৫ থেকে ২০ বছর আগে এই নদীতে প্রচুর ইলিশ ধরা পড়ত। কিন্তু মাঝখানে ইলিশ কমে যায়। যেটুকু ইলিশ পাওয়া যেতে, তা ধরাও কঠিন হয়ে উঠেছিল। কারণ, জলদস্যুর ভয়ে জেলেরা সাগরের মোহনার দিকে যেতে ভয় পেতেন।
হরলাল বলেন, তবে দুই থেকে তিন বছর ধরে ফেনী নদীতে ভালোই ইলিশ ধরা পড়ছে। জেলেরা এখন সাগরের মোহনাতেও যেতে পারছেন। কারণ, প্রশাসনের কঠোর নজরদারিতে এখন জলদস্যু নেই বললেই চলে।
সোনাগাজী উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা তূর্য সাহা বলেন, ‘আমি তিন বছর ধরে এখানে আছি। এখানে এত ইলিশ আগে দেখিনি। তবে শুনেছি, ১৫ থেকে ২০ বছর আগে এখনে অনেক ইলিশ ধরা পড়ত। মাঝখানে তা প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।’
এত ইলিশ কেন
দেশে কয়েক বছর ধরে ইলিশের উৎপাদন বাড়ছে। ইলিশ তার আগের বিচরণক্ষেত্রগুলোয় ফিরে আসছে। এর পেছনে সরকারি নিষেধাজ্ঞার সুফলের কথা বলা হচ্ছে।
প্রতিবছর ২০ মে থেকে ২৩ জুলাই সাগরে মাছ ধরায় নিষেধাজ্ঞা থাকে। আবার অক্টোবরে ইলিশের প্রজনন মৌসুমে ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা থাকে। এসব নিষেধাজ্ঞা সুফল দিচ্ছে বলে খোদ জেলেরাই স্বীকার করছেন।
সোনাগাজী উপজেলার জেলে নুর নবী বলেন, আগে স্থানীয় জেলেরা পেটের দায়ে সরকারি নিষেধাজ্ঞা অমান্য করতেন। তাঁরা নিষেধাজ্ঞা চলাকালে চুরি করে নদীতে মাছ শিকার করতেন। কিন্তু কয়েক বছর ধরে তাঁরা সরকারি সহযোগিতা পেয়ে সব ধরনের নিষেধাজ্ঞা পালন করছেন। এতে নদীতে ইলিশসহ অন্য মাছ বেড়েছে।
বড় ফেনী নদীতে এখন বেশি ইলিশ ধরা পড়ার কারণ হিসেবে আরও কিছু বিষয়ের কথা জানালেন মৎস্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা।
সোনাগাজী উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা তূর্য সাহা প্রথম আলোকে বলেন, বড় ফেনী নদীর যে জায়গায় ইলিশ ধরা পড়ছে, সেটি উপজেলার চরখন্দকার জলদাসপাড়ার কাছাকাছি এলাকা। এখান থেকে সন্দ্বীপ চ্যানেলের দূরত্ব বড়জোর ১২ কিলোমিটার। সাগরে জোয়ারের সময় পানি ফুলে উঠে বড় ফেনী নদীতে আছড়ে পড়ছে। এর সঙ্গে আসছে ইলিশ। তাই বড় ফেনী নদীতে যে ইলিশ ধরা পড়ছে, তা মূলত সাগরের।
মৎস্য অধিদপ্তরের ইলিশ শাখার প্রধান মাসুদ আরা মমি বলেন, ‘প্রতিবছর আমরা জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে মোট ১৫ দিন জাটকা বন্ধের উদ্যোগ নিই। এ বছর সেটি দুই মাসে ১৫ দিন করে ৩০ দিন করা হয়েছে। এ বছর যে পরিমাণ কারেন্ট জাল ও বিহুন্দি জাল ধ্বংস করা হয়েছে, তা আগে কখনো হয়নি। এসব কঠোর পদক্ষেপের ফল আমরা পেতে শুরু করেছি।’
বড় প্রজননক্ষেত্র
মৎস্যগবেষকেরা বলছেন, বড় ফেনী নদী ইলিশের একটি বড় প্রজননক্ষেত্র। ইলিশ উৎপাদনের স্বার্থেই এখানকার পরিবেশ ভালো রাখা দরকার। এখানে বেশি ইলিশ, বড় ইলিশ পাওয়ার বিষয়টি শুভ ইঙ্গিত দেয়।
বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট, নদীকেন্দ্র চাঁদপুরের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. আনিছুর রহমান বলেন, ‘দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলোর সঙ্গে সাগরের মোহনার সাত হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকা ইলিশের সূতিকাগার। তাই এখানে ইলিশের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি ও তা রক্ষার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।’
ইলিশ এত বড় কেন
বড় ফেনী নদীতে এখন বড় আকারের ইলিশ ধরা পড়তে দেখা যাচ্ছে। এগুলোর কোনো কোনোটির ওজন দুই কেজির মতন, কোনোটি তিন কেজি।
তিন কেজি ওজনের একটি ইলিশের বয়স অন্তত চার বছর বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক নিয়ামুল নাসের। তিনি বলেন, ‘এই ইলিশগুলো আগে যাওয়া-আসার পথে ধরা পড়েনি। তাই এগুলো এত বড় হতে পেরেছে।’
ইলিশ গবেষকদের মতে, ৩ কেজি ওজনের একটি ইলিশ ১৫ থেকে ২০ লাখ ডিম ছাড়তে পারে। আর ২ কেজি ওজনের একটি ইলিশ ছাড়তে পারে ১৫ লাখ পর্যন্ত ডিম।
নিয়ামুল নাসের বলেন, ‘বড় ফেনী নদীতে বড় ইলিশ পাওয়াটা সুখবর। কিন্তু এই ইলিশগুলো আরও কিছুকাল টিকে থাকলে ভালো হতো। কারণ, অক্টোবরেই ইলিশের প্রজনন মৌসুম। অক্টোবর পর্যন্ত বড় ইলিশগুলো টিকে থাকলে তা উৎপাদন বাড়াতে ভূমিকা রাখতে পারত।’
অবশ্য বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট, নদীকেন্দ্র চাঁদপুরের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা আনিছুর রহমান বলেন, ইলিশ সারা বছর ধরেই ডিম ছাড়ে। তার অর্থ এই নয় যে সারা বছর নিষেধাজ্ঞা দিয়ে তার প্রজনন নিশ্চিত করতে হবে। অক্টোবরে যে ২২ দিন নির্দিষ্ট করা হয়েছে, তা ইলিশের প্রজননের জন্য যথেষ্ট। পাশাপাশি বছরের বিভিন্ন সময় মাছ ধরার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি তো থাকছেই। তাই বিধিনিষেধের বাইরের সময় বড় ইলিশ ধরার ক্ষেত্রে জেলেদের মানা করার কিছু নেই।