স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ

তিরস্কৃত হয়েও শুদ্ধাচার পুরস্কার

কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একাংশের বিরুদ্ধে দায়িত্বে অবহেলাসহ অনিয়ম-দুর্নীতির নানা অভিযোগ রয়েছে। কিন্তু কর্তৃপক্ষ দুর্নীতির বিষয়ে কঠোর নয়।

  • ৫৯ জনের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা, ৩২ জনই খালাস।

  • নারী কর্মীকে হয়রানি করা কর্মকর্তাকে পদোন্নতির সুপারিশ।

  • অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে চারজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুদকের তদন্ত চলছে।

দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগে ২০১৪ সালে বিভাগীয় মামলায় শাস্তি (তিরস্কার) পেয়েছিলেন বাংলাদেশ স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের উপপরিচালক মোহাম্মদ মাহফুজুল ইসলাম ভূঞা। ২০২০ সালে তিনিই সংস্থাটির শুদ্ধাচার পুরস্কার পান।

আবার নারী সহকর্মীকে হয়রানির অভিযোগ আছে আরেক কর্মকর্তা কবির খানের বিরুদ্ধে। সম্প্রতি তাঁকে সংস্থাটির উপপরিচালক (পরিকল্পনা) হিসেবে পদোন্নতি দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে।

দেশে আমদানি–রপ্তানির সঙ্গে জড়িত গুরুত্বপূর্ণ এ সংস্থায় এমন অনিয়মের নানা অভিযোগ রয়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অভিযোগের সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার হয় না। নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের অধীন এ সংস্থার মাধ্যমে ১২টি স্থলবন্দরের কার্যক্রম চলমান আছে।

সংস্থাটির বিভাগীয় মামলা ও দুর্নীতিসংক্রান্ত কাগজপত্র পর্যালোচনা করে দেখা যায়, গত মে মাস পর্যন্ত বিভিন্ন অভিযোগে সংস্থাটির ৫৮ জনের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা হয়েছে। মামলায় অসদাচরণ, চুরি, অর্থ আত্মসাৎ ও দায়িত্বে অবহেলার মতো অভিযোগ আনা হয়েছে। তবে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের ৩২ জনকেই পরে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।

যারা সরাসরি দুর্নীতি করছে শুধু তারাই দায়ী নয়, যারা দুর্নীতিবাজদের সুরক্ষা দিচ্ছে, তাদেরও জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে।
ইফতেখারুজ্জামান, নির্বাহী পরিচালক, টিআইবি

শুধু তিরস্কার করে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে ৯ জনকে। এ ছাড়া চারজনের এক বছরের জন্য বেতন বৃদ্ধি (ইনক্রিমেন্ট) বন্ধ, দুজনের সাত দিনের বেতন কাটা, দুজনের এক বছরের জন্য পদোন্নতি স্থগিত এবং দুজনকে ভবিষ্যতে একই ধরনের অপরাধ না করতে সতর্ক করা হয়েছে। সংস্থাটি প্রতিষ্ঠার পর থেকে এখন পর্যন্ত কেবল একজনকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছিল এবং একজনের কাছ থেকে পাঁচ হাজার টাকা আদায় করা হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মতে, এ চিত্রই বলে দেয় স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ দুর্নীতি-অনিয়মের বিষয়ে কঠোর নয়। বাংলাদেশ স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ কর্মচারী চাকরি প্রবিধানমালা ২০০৪ অনুসারে, কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ এলে প্রাথমিক তদন্ত করা হয়। এতে অভিযোগ সত্য বলে মনে হলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়। নোটিশে সন্তোষজনক জবাব পাওয়া গেলে অভিযোগ থেকে ওই কর্মকর্তা বা কর্মচারীকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। আর জবাব সন্তোষজনক না হলে বিভাগীয় মামলা করা হয়। এ প্রক্রিয়া অনুসারে যাঁদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা হয়, তাঁদের বেশির ভাগেরই সাজা হওয়ার কথা।

স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের দায়িত্বশীল একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই কর্মচারীদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা হয়। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বিভিন্নভাবে ঘটনা ধামাচাপা দেন অথবা প্রভাব খাটিয়ে প্রাথমিক তদন্ত নিজের পক্ষে নিয়ে যান। ফলে সেটি আর বিভাগীয় মামলা পর্যন্ত গড়ায় না।

অবশ্য স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান মো. আলমগীর প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, যাঁদের বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতির প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে, তাঁদের বিরুদ্ধে শাস্তি নেওয়া হচ্ছে। সংস্থাটির কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির বিস্তর অভিযোগের পেছনে সংস্থাটির কর্মকর্তাদের নিজেদের মধ্যে কাদা–ছোড়াছুড়ি অন্যতম কারণ।

এত অভিযোগ, তবু পুরস্কার

সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, ২০১৯-২০ অর্থবছরে শুদ্ধাচার পুরস্কার পান মোহাম্মদ মাহফুজুল ইসলাম ভূঞা। এর আগে দায়িত্ব পালনে অবহেলার অভিযোগে করা বিভাগীয় মামলায় ২০১৪ সালে তাঁকে ‘তিরস্কার’ দণ্ড দেওয়া হয়েছিল। আপিলেও তাঁর দণ্ড বহাল থাকে। ওই সময় তিনি সাতক্ষীরার ভোমরা স্থলবন্দরে ছিলেন, এখন আছেন সিলেটের তামাবিলে।

সিলেট যাওয়ার আগে লালমনিরহাটের বুড়িমারী স্থলবন্দরে কর্মরত ছিলেন তিনি। এ সময় (গত বছরের জুনে) তাঁর বিরুদ্ধে বন্দরের ১৫ জন কর্মচারী লিখিতভাবে সংস্থাটির চেয়ারম্যানের কাছে অভিযোগ করেন। তাতে অধীন কর্মীদের মানসিক নির্যাতন, স্থলবন্দরের কাজের কথা বলে টাকা নিয়ে নিয়ে ফেরত না দেওয়া, মেসে খেয়ে বিল না দেওয়ার মতো অভিযোগ আনা হয়। এরপর মাহফুজুলকে সিলেটে বদলি করা হয়।

মাহফুজুল ইসলাম ভূঞা প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, ‘বুড়িমারীতে বিভিন্ন অনিয়মের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার ফলে সংঘবদ্ধ হয়ে আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ করা হয়েছে।’

এই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাৎ ও ঠিকমতো অফিস না করাসহ নানা বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনেও (দুদক) একটি অভিযোগ জমা পড়ে। এ বিষয়ে তদন্তের জন্য গত এপ্রিলে দুদকের পক্ষ থেকে স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষকে বলা হয়। এরপর গত মে মাসে স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের পরিচালক (হিসাব) ছাদেকুর রহমানকে তদন্তকারী কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। তবে ছাদেকুর রহমান সম্প্রতি প্রথম আলোকে বলেন, অভ্যন্তরীণ কিছু সমস্যার কারণে তিনি তদন্তের কাজ শুরু করতে পারেননি।

দৈনিক মজুরির কর্মী হচ্ছেন উপপরিচালক

কাজ থাকলে মজুরি পাবেন, না থাকলে মজুরি নেই—এমন শর্তে সংস্থাটির কম্পিউটার অপারেটর পদে নিয়োগ পেয়েছিলেন কবির খান। এরপর তিনি সংস্থার জনসংযোগ কর্মকর্তা হন। ২০১৩ সাল থেকে সংস্থার চেয়ারম্যানের একান্ত সচিবের দায়িত্বে আছেন। তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতি, অনিয়ম ও নারী সহকর্মীকে হয়রানিসহ নানা অভিযোগ আছে।

সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানায়, এক নারী সহকর্মীকে হয়রানি সংক্রান্ত একটি অডিও রেকর্ড এর মধ্যে ফাঁস হয়েছে। ওই রেকর্ড অনুযায়ী, কবির খান টেলিফোনে এক নারী সহকর্মীকে আগাম কিছু তথ্য দেন। তথ্যের মাধ্যমে তিনি ওই নারীকে সংস্থাটির আইনের বিভিন্ন ধারা উল্লেখ করে ভবিষ্যৎ বিপদের ভয় দেখান। এরপর তিনি ওই নারীকে বিপদ থেকে উদ্ধারের আশ্বাস দেন। কীভাবে বিপদ থেকে উদ্ধার পাবেন, তা জানার জন্য কবির খান ওই নারী সহকর্মীকে একা বাসায় দেখা করতে বলেন। ওই নারী তাঁর স্বামীকে সঙ্গে নিয়ে আসতে চাইলে কবির খান রাজি হননি। ইঙ্গিতপূর্ণ এই কথোপকথনের রেকর্ডটি ১০ মিনিটি ৫ সেকেন্ডের।

কবির খান প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, অডিও রেকর্ডটি সঠিক নয়। তিনি কাউকে কখনো হয়রান করেননি।

তবে ওই নারী প্রথম আলোকে বলেন, ‘মানুষের কথার ধরন থেকেই বোঝা যায় কী ইঙ্গিত করা হচ্ছে। বিষয়টি আমি চেয়ারম্যানকে (তৎকালীন) জানিয়েছিলাম, কিন্তু কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।’

এদিকে গত বছরের অক্টোবরে পরিচালনা পর্ষদের সভায় কবির খানকে উপপরিচালক (পরিকল্পনা) পদে পদোন্নতি দেওয়ার সুপারিশ অনুমোদন করা হয়। তবে পদটি নতুন হওয়ায় সংস্থাটির নিয়োগবিধি সংশোধন–সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করতে বলা হয়েছে। এখনো সেই প্রজ্ঞাপন হয়নি।

তদন্তে দুদক

অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে কবির খানসহ সংস্থাটির সাবেক ও বর্তমান চারজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে তদন্ত করছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। তদন্তের জন্য গত নভেম্বরে স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের কাছে প্রয়োজনীয় নথিপত্র চেয়েছে দুদক। সে অনুযায়ী গত জানুয়ারিতে ১৩ হাজার ৮৫৭ পৃষ্ঠার নথিপত্র দুদকে জমা দিয়েছে সংস্থাটি।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ‘স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের অনিয়ম–দুর্নীতির যে চিত্র ফুটে উঠছে, তাতে বলা যায় দুর্নীতি একটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করেছে। যারা সরাসরি দুর্নীতি করছে শুধু তারাই দায়ী নয়, যারা দুর্নীতিবাজদের সুরক্ষা দিচ্ছে, তাদেরও জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে।’