বাংলাদেশের প্রসিদ্ধ স্থপতি মোহাম্মদ ফয়েজ উল্লাহর তিন দশকের কাজের সংকলন নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে ঢাকা’স ট্রপিক্যাল এক্সপ্রেসিভ আর্কিটেকচার। রাজধানীর একটি হোটেলে গতকাল শনিবার সন্ধ্যায় আনুষ্ঠানিকভাবে বইটির মোড়ক উন্মোচন করা হয়। অনুষ্ঠানে অতিথিরা বলেছেন, বাংলাদেশের স্থাপত্যকে জানতে ও বুঝতে বইটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। এই বইয়ের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা স্থাপত্য, নান্দনিকতা ও সততা সম্পর্কে জানতে পারবেন।
মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে বইটির লেখক মোহাম্মদ ফয়েজ উল্লাহ বলেন, ‘আমার ৩০ বছরের স্থাপত্যের পথচলার সংকলন হচ্ছে এই বই। চার-পাঁচ বছর আগে বইটি প্রকাশের প্রাথমিক কাজ শুরু হয়েছিল। গত বছরের শুরুর দিকে বইটি বিশ্বব্যাপী প্রকাশিত হয়। এবার আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশে প্রকাশ করা হলো।’
বইটি প্রকাশের সঙ্গে জড়িত সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে ফয়েজ উল্লাহ বলেন, ‘আমরা যখন ছাত্র ছিলাম, তখন ইন্টারনেট ছিল না। তখন স্থাপত্যের কাজ সম্পর্কে জানার একমাত্র উপায় ছিল গ্রন্থাগার ও ভারতের কিছু জার্নাল। আমাদের দেশের স্থপতিদের কাজ সম্পর্কে জানতে হলে, যে জায়গায় কাজটি হয়েছে, সেখানে যেতে হতো। প্রাসঙ্গিক কোনো ডকুমেন্ট বা বই ছিল না। এ বিবেচনায় বইটি সেই শূন্যতা পূরণ করবে। নবীন শিক্ষার্থীরা বইটির মাধ্যমে বাংলাদেশে স্থাপত্যের বিবর্তনের পাঠ ও অনুপ্রেরণা পাবেন।’
অনুষ্ঠানে ঢাকার স্থাপত্যের চর্চা বেশ সমৃদ্ধ বলে উল্লেখ করেন স্থপতি শামসুল ওয়ারেস। তিনি বলেন, বিশ্বের ৩৭টি মেগাসিটির একটি ঢাকা। ঢাকায় এত মানুষের অভিবাসন হয়েছে, যা বিশ্বের অন্য কোনো শহরে হয়নি। এমন অভিবাসন ঢাকার সবকিছু অকেজো করে দিয়েছে। কলকাতার সঙ্গে ঢাকার তুলনা করে শামসুল ওয়ারেস বলেন, ১৪০ বছর ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী ছিল কলকাতা। শহরটি পরিকল্পনার দিক দিয়ে অনেক ভালো। কিন্তু স্থাপত্যের দিক দিয়ে অনেক দুর্বল। অন্যদিকে ঢাকা পরিকল্পনার দিক দিয়ে অনেক পিছিয়ে। কিন্তু স্থাপত্যের দিক দিয়ে অনেক এগিয়ে আছে।
অনুষ্ঠানে অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, ‘মোহাম্মদ ফয়েজ উল্লাহর বইটির মতো ৩০-৪০টি বই থাকলে আমরা বিশ্বকে দেখাতে পারতাম বাংলাদেশে স্থাপত্য নিয়ে কী কী কাজ হয়েছে।’ মোহাম্মদ ফয়েজ উল্লাহর কাজের সঙ্গে তাঁর দীর্ঘদিনের পরিচয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, তাঁর কাজের মধ্যে একধরনের নতুনত্ব আছে। ‘ওয়েলকামিং’ একটি আবহ তৈরি করে তাঁর তৈরি দালান। আবহাওয়াকে অনুকূলে নিয়ে আসা এবং পরিবেশের বিরূপ শক্তিগুলোকে নিয়ন্ত্রণে আনার প্রচেষ্টাও আছে তাঁর দালানগুলোতে।
বইটির প্রশংসা করে বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউটের সহসভাপতি (জাতীয় বিষয়াদি) মোহাম্মদ আলী নকী বলেন, ‘মোহাম্মদ ফয়েজ উল্লাহর কাজের মধ্যে আধুনিক স্থাপত্যের সুস্পষ্ট ও শিক্ষণীয় নিদর্শন রয়েছে। ছাত্র অবস্থায় এ ধরনের বই পেলে আমি আরও ভালো স্থপতি হতে পারতাম। আজকের স্থপতিদের সৌভাগ্য যে এখন এ ধরনের বই বের হচ্ছে। বইটির মাধ্যমে স্থাপত্যের শিক্ষার্থীরা অনেক উপকৃত হবেন।’ স্থাপত্য একটি জাতিকে তৈরি করতে পারে উল্লেখ করে আলী নকী বলেন, এই বইয়ের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা স্থাপত্য, নান্দনিকতা ও সততা সম্পর্কে জানতে পারবেন।
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর ইনক্লুসিভ আর্কিটেকচার অ্যান্ড আরবানিজমের নির্বাহী পরিচালক আদনান জিল্লুর মোর্শেদ বলেন, ‘বই বের হওয়া মানে এখানেই শেষ নয়। জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গঠনের ক্ষেত্রে এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া। যত বেশি বই প্রকাশিত হবে, ততই আমরা জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গঠনের দিকে এগিয়ে যাব।’
স্থাপত্যের শিক্ষককের এ বিষয়ে ভূমিকা রাখার আহ্বান জানিয়ে আদনান জিল্লুর বলেন, ‘বাংলাদেশে ৩০টির বেশি বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থাপত্য বিভাগে অন্তত ৩০০ জন শিক্ষক আছেন। কিন্তু তাঁরা কী বিষয়ে গবেষণা করছেন তা আমরা দেখি না, জানি না।’
বইটি প্রকাশের জন্য মোহাম্মদ ফয়েজ উল্লাহকে অভিনন্দন জানিয়ে আদনান জিল্লুর বলেন, ‘৫-১০ বছর পরে কেউ যদি বুঝতে চান বাংলাদেশের স্থাপত্য কেমন ছিল, তবে স্থপতি ফয়েজ উল্লাহর বইটি দেখলে তা বোঝা যাবে। তবে অন্যান্য বইও পড়তে হবে।’
অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত অতিথিদের মধ্যে প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান, স্থপতি হারুনুর রশিদ, জালাল আহমেদ, কাজী গোলাম নাসির, কাজী খালিদ আশরাফ, সাইফুল হক, লুভা নাহিদ চৌধুরী, নাহাস আহমেদ, বণিক বার্তার সম্পাদক দেওয়ান হানিফ মাহমুদ, শিল্পী হামিদুজ্জামান খান প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
মোহাম্মদ ফয়েজ উল্লাহ বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) থেকে ১৯৯৩ সালে স্থাপত্যে স্নাতক সম্পন্ন করেন। এরপর ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত তিনি বুয়েটে শিক্ষকতা করেন। তিনি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ভলিউমজিরো লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক।