বৈশ্বিক মন্দা পরিস্থিতিতে অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশের মানুষ বেহেশতে আছেন বলে মন্তব্য করেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন। গতকাল শুক্রবার দুপুর ১২টার দিকে সিলেটে এক মতবিনিময় সভা শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী এ কথা বলেন।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কা হয়ে যাবে—একটি পক্ষ থেকে এমন প্যানিক (আতঙ্ক) ছড়ানো হচ্ছে। বাস্তবে এর কোনো ভিত্তি নেই। বৈশ্বিক মন্দায় অন্য দেশের তুলনায় আমরা বেহেশতে আছি।’
পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এই বক্তব্য সংবাদমাধ্যমে আসতেই সমালোচনা শুরু হয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। মন্ত্রীর নাম উল্লেখ না করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক সেলিম রায়হান ফেসবুকে লিখেছেন, ‘দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা দায়িত্বপূর্ণ কথা বলবেন, এই প্রত্যাশা কি আসলেই বেশি? তা না হলে অনেক কথাই তো কাটা ঘায়ে নুনের ছিটার মতো মনে হতে পারে!’
পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যের পর ফেসবুকে আরও অনেকে নানা মন্তব্য করেছেন। সুচিন্তা ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ এ আরাফাত তাঁর ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে লিখেছেন, ‘যে কথা কোনো সমাধান দেয় না; বরং আরও সমস্যা তৈরি করে, সে কথা বলার দরকার কী?’ তবে তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য বা তাঁর নাম উল্লেখ করেননি। তিনি আরও লিখেছেন, ‘পুরো বিশ্ব কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, সঙ্গে আমরাও। সরকার পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে। মানুষের কষ্ট নিয়ে কৌতুক করা আমাদের উচিত হবে না।’
‘আমরা বেহেশতে আছি’ বক্তব্য সম্পর্কে জানতে চাইলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন গত রাতে প্রথম আলোকে বলেন, ‘হ্যাঁ, ওই কথা বলেছি। বাংলাদেশের মানুষ অন্যান্য দেশের তুলনায় এই দুর্দিনেও অনেক ভালো আছে। কেউ যদি ইচ্ছা করে এটা টুইস্ট করে (অন্যভাবে নেয়), তাহলে আর কী করব। আমি যেটা বলেছি, আমার ইনফ্লেশন রেট (মূল্যস্ফীতি) ৭ পার্সেন্ট। আমেরিকায় ৯ দশমিক ৫ পার্সেন্ট, টার্কিতে ৬০ পার্সেন্ট, পাকিস্তানে ৩৭ পার্সেন্ট।’
পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘তবে আমি এটাও বলেছি, আমি খুব তাজ্জব হয়েছি যে ১ লিটার জ্বালানি তেলের দাম বাড়ল ৪০ টাকা, আর প্রতি কেজি বেগুনের দাম বাড়িয়ে দিল ২০ টাকা। এই ১ কেজি বেগুন পরিবহন করতে কত লিটার তেল লাগে? এটা কয়েক পয়সা কিংবা ১ টাকা, ২ টাকার বেশি বাড়া উচিত না। কিন্তু বাড়িয়ে দিল ২০ টাকা। এটা কী ঢং?’
দেশে গত জুনে মূল্যস্ফীতি ৯ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে ওঠে। যদিও অর্থনীতিবিদেরা বারবার বলছেন যে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে মূল্যস্ফীতির পুরো চিত্র আসে না। বাস্তবে মূল্যস্ফীতি আরও বেশি। মূল্যস্ফীতির হিসাব করা হচ্ছে ২০০৫-০৬ অর্থবছরকে ভিত্তি বছর ধরে। এত দিনে চাহিদার ধরন বদলেছে।
যা-ই হোক, মূল্যস্ফীতি যতটুকু উঠে আসছে, মানুষের আয় ততটুকু বাড়ছে না। বিবিএস বলছে, মূল্যস্ফীতির তুলনায় মানুষের মজুরি বেড়েছে কম হারে।
চালের দাম দিয়েই মূল্যবৃদ্ধির চিত্র তুলে ধরা যায়। সরকারি সংস্থা টিসিবির (ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ) হিসাবে ২০২০ সালের ১ জানুয়ারি ঢাকায় মোটা চালের দাম ছিল প্রতি কেজি সর্বনিম্ন ৩০ টাকা। গতকাল শুক্রবার ওই দাম দাঁড়ায় সর্বনিম্ন ৫০ টাকায়। মানে হলো, নিম্ন আয়ের মানুষকে চাল কিনতে প্রায় ৬৭ শতাংশ বেশি ব্যয় করতে হচ্ছে।
শুধু চাল নয়, ব্যাপকভাবে বেড়েছে ভোজ্যতেল, ডাল, আটা, চিনি, দুধ, মাংসসহ প্রায় সব নিত্যপণ্যের দাম। সাবান, টুথপেস্ট, শ্যাম্পু, খাতা, কলমসহ নিত্যব্যবহার্য পণ্য ও শিক্ষা উপকরণের দামও বেড়েছে।
প্রায় সব পণ্যের এতটা মূল্যবৃদ্ধির কারণ হিসেবে সামনে আনা হচ্ছে বিশ্ববাজারে দাম বেড়ে যাওয়া, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সরবরাহ–সংকট ও ডলারের মূল্যবৃদ্ধি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ব্যবস্থাপনায় দুর্বলতাও রয়েছে। যেমন চালের দাম তিন বছর ধরেই ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে। এর সঙ্গে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বা বিশ্ববাজার পরিস্থিতির সরাসরি সংযোগ নেই।
এদিকে এক সপ্তাহ ধরে দ্রব্যমূল্য আরেক দফা বাড়ছে। এর কারণ জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি। গত নভেম্বরে এক দফা বাড়ানোর পর জ্বালানি মন্ত্রণালয় ৫ আগস্ট রাতে ডিজেল ও কেরোসিনের দাম লিটারপ্রতি ৩৪ টাকা বাড়িয়ে ১১৪ টাকা নির্ধারণ করে। আর পেট্রলের দাম ৪৪ টাকা বাড়িয়ে ১৩০ টাকা এবং অকটেনের দাম ৪৬ টাকা বাড়িয়ে ১৩৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়। দেশের ইতিহাসে এটাই সর্বোচ্চ হারে মূল্যবৃদ্ধি এবং সেটা এমন সময়ে করা হয়েছে, যখন মূল্যস্ফীতি অনেক বেশি।
জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার পরপর যাত্রী ও পণ্য পরিবহন ব্যয়ও বেড়ে গেছে। এমন পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষ এমনিতে উদ্বেগের মধ্যে আছে। এ অবস্থায় মন্ত্রীদের বিভিন্ন বক্তব্য বিতর্ক তৈরি করছে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রীর আগে গত বুধবার ঢাকায় এক সংলাপে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী তাজুল ইসলাম বলেন, ‘গ্রামগঞ্জের কোনো মানুষ না খেয়ে নেই। প্রত্যেক মানুষের গায়ে জামাকাপড় আছে। আমি মনে করি না আমরা খুব খারাপ অবস্থায় আছি।’
ধর্ম প্রতিমন্ত্রী ফরিদুল হক খান গত ৩১ জুলাই বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়ের জন্য গম আমদানি কমাতে আটার রুটির বদলে চালের রুটি খাওয়ার পরামর্শ দেন। তখন অনেকে বলেছিলেন, চালও যে এখন আমদানি করতে হচ্ছে, সেটা সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের জানা উচিত।
অর্থনীতিবিদ সেলিম রায়হান গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, বর্তমানে সব দেশেই সংকটজনক পরিস্থিতি চলছে। কোথাও মাত্রা বেশি, কোথাও কম। সরকার পরিস্থিতি সামলাতে চেষ্টা করছে। তাঁর মতে, আসল পরিস্থিতি কী, সেটা সবাই অনুভব করছে। এখন উত্তরণের পথ নিয়েই কথা বলা উচিত।