কারও মৃত্যুর ভুল তথ্য; প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, সশস্ত্র বাহিনী নিয়ে বিভ্রান্তিকর সংবাদ; এমনকি শিক্ষা, ধর্ম, খেলা, বিনোদন, দুর্যোগের মতো নানা বিষয়ে ভুল তথ্যের ভিডিওর ছড়াছড়ি ইউটিউবে। ভিডিওগুলোতে আবার বিভিন্ন ব্র্যান্ড, পণ্যের বিজ্ঞাপন দেখানো হচ্ছে; যার মধ্যে আছে দেশীয় সুপরিচিত ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপনও।
দেশে অন্যতম জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ইউটিউব এভাবে নানা ভুল তথ্য ব্যবহার করে মুনাফা করছে। ভুল তথ্যের মধ্যে রাজনীতিবিষয়ক তথ্য সবচেয়ে বেশি। এসব বিষয়ে জানানো হলেও সামাজিক মাধ্যমটির কর্তৃপক্ষ বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সেসব আমলে নেয় না।
তথ্যব্যবস্থায় প্রযুক্তির প্রভাব নিয়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠান ডিজিটালি রাইটের গবেষণা ইউনিট ‘ডিসমিসল্যাব’ ইউটিউবের ভিডিও নিয়ে এক গবেষণা প্রতিবেদনে এসব তথ্য উল্লেখ করেছে। গত ১০ জুলাই প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়।
সাতটি ফ্যাক্ট চেকিং সংস্থার ওয়েবসাইটে প্রকাশিত নিবন্ধ থেকে মিথ্যা বা বিভ্রান্তিকর শিরোনামগুলো নিয়ে ইউটিউবে অনুসন্ধান চালানো হয়। এতে গবেষকেরা ভুল তথ্যসংবলিত ৭০০টি ভিডিও পান। এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ২৫ শতাংশ রাজনীতি ও প্রায় ১৫ শতাংশ ধর্মসংক্রান্ত। এরপর আছে খেলাধুলা ও দুর্যোগ-সম্পর্কিত বিষয়।
ডিসমিসল্যাবের গবেষকেরা রিউমর স্ক্যানার, বুম, নিউজচেকার, ফ্যাক্ট ক্রিসেন্ডো, ফ্যাক্ট-ওয়াচ এবং এএফপি ফ্যাক্ট চেকসহ দেশের সাতটি ফ্যাক্ট চেকিং সংস্থার ওয়েবসাইটে ২০২৩ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রকাশিত ২ হাজার ৪২টি নিবন্ধ বিশ্লেষণ করেছেন।
এই নিবন্ধগুলো থেকে মিথ্যা বা বিভ্রান্তিকর শিরোনামগুলো নিয়ে ২০২৩ সালের নভেম্বর থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে ইউটিউবে অনুসন্ধান চালানো হয়। এতে গবেষকেরা ভুল তথ্য–সংবলিত ৭০০টি ভিডিও পান। এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ২৫ শতাংশ রাজনীতি ও প্রায় ১৫ শতাংশ ধর্মসংক্রান্ত। এরপর আছে খেলাধুলা ও দুর্যোগ-সম্পর্কিত বিষয়।
ডিসমিসল্যাবের গবেষকেরা এ ৭০০ ভিডিও নিয়ে রিপোর্ট করেছেন। তাঁরা দেখেছেন, চলতি বছরের জুন পর্যন্ত ইউটিউব কর্তৃপক্ষ মাত্র ২৫টি ভিডিওর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে। বাকিগুলো সক্রিয় রয়েছে।
বিজ্ঞাপন সুরক্ষানীতির বিষয়ে আরও আলোচনা হওয়া উচিত। প্ল্যাটফর্মগুলোতে যারা বিজ্ঞাপন দিচ্ছে, তাদেরও সতর্ক হতে হবে এবং বিজ্ঞাপনগুলো কোথায় যাচ্ছে, সেগুলোর বিষয়ে সোচ্চার হতে হবে।ডিজিটালি রাইটের প্রতিষ্ঠাতা মিরাজ আহমেদ চৌধুরী
প্রতিবেদনে বলা হয়, ভুল তথ্যের এসব ভিডিও ৫৪১টি চ্যানেল থেকে প্রচারিত হয়েছে। ৬৪টি চ্যানেল একাধিকবার ভুল তথ্য ব্যবহার করেছে। এর মধ্যে ‘সবাই শিখি’ নামে একটি চ্যানেল থেকে ৯টির মতো ভুল তথ্য ব্যবহার করা হয়েছিল। গত মার্চে ডিসমিসল্যাবের এ–সংক্রান্ত এক প্রতিবেদন প্রকাশ হওয়ার পর চ্যানেলটি থেকে ভিডিওগুলো সরিয়ে নেওয়া হয়।
ভুল তথ্যের ভিডিওর প্রায় ৩০ শতাংশে বিজ্ঞাপন দেখানো হয়েছে; যার কয়েকটিতে দেখানো হয় একাধিক বিজ্ঞাপন। ভিডিওগুলোর প্রতিটিতে গড় ভিউ ২ লাখের বেশি। এতে ৮৩টি ব্র্যান্ডের বিজ্ঞাপন রয়েছে। এগুলোর এক–তৃতীয়াংশ বিদেশি কোম্পানির; যারা বাংলাদেশি দর্শকদের লক্ষ্য করে বিজ্ঞাপন দিয়েছে।
গেমিং অ্যাপ, মোবাইল অপারেটর, ভোগ্যপণ্যের ব্র্যান্ড, ই–কমার্সসহ বিভিন্ন খাতে দেশের শীর্ষ কিছু প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন প্রদর্শন করা হয়েছে এসব ভিডিওতে।
এ ভিডিওগুলো পোস্ট করা চ্যানেলগুলোর ১৬ দশমিক ৫ শতাংশ ইউটিউব ভেরিফায়েড। ভিডিওগুলোতে দেওয়া বিজ্ঞাপন থেকে কনটেন্ট ক্রিয়েটররা আয় করছেন কি না, সেটি নিশ্চিতভাবে বলা যাচ্ছে না। তবে ভুল তথ্য ব্যবহার করার প্ল্যাটফর্ম হিসেবে ইউটিউব অবশ্যই এখান থেকে মুনাফা করছে।
ডিজিটালি রাইটের প্রতিষ্ঠাতা মিরাজ আহমেদ চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, বিজ্ঞাপন সুরক্ষানীতির বিষয়ে আরও আলোচনা হওয়া উচিত। প্ল্যাটফর্মগুলোতে যারা বিজ্ঞাপন দিচ্ছে, তাদেরও সতর্ক হতে হবে এবং বিজ্ঞাপনগুলো কোথায় যাচ্ছে, সেগুলোর বিষয়ে সোচ্চার হতে হবে।
পরিসংখ্যানবিষয়ক জার্মান ওয়েবসাইট ‘স্ট্যাটিস্টা’র তথ্য অনুসারে, বাংলাদেশে গত এপ্রিল পর্যন্ত প্রায় ৩৭ মিলিয়ন (৩ কোটি ৭০ লাখ) ইউটিউব ব্যবহারকারী রয়েছেন। অনলাইনভিত্তিক রেফারেন্স লাইব্রেরি ‘ডেটারিপোর্টাল’ বলছে, গত জানুয়ারিতে ইউটিউবের মাধ্যমে প্রদর্শিত বিজ্ঞাপন বাংলাদেশের ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের ৪৩ দশমিক ৪ শতাংশের কাছে পৌঁছেছে।
বিজ্ঞাপন ইউটিউবের আয়ের প্রাথমিক উৎস; যা ব্যবহারকারীদেরও ভিডিও মনিটাইজেশনের (অর্থ আয়ের সুযোগ) মাধ্যমে উপার্জনের সুযোগ করে দেয়। ইউটিউবসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এখন অর্থ আয়ের অন্যতম উৎস।
ডিসমিসল্যাব জানিয়েছে, তারা গবেষণায় বিজ্ঞাপনদাতা ও বিশেষজ্ঞদের সাক্ষাৎকার নিয়েছে। এভাবে ভুল তথ্যের ভিডিওতে বিজ্ঞাপন দেখানোয় হতাশা প্রকাশ করেছেন বিজ্ঞাপনদাতারা।
ভুল তথ্য ছড়ানো রোধে ইউটিউবের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। ২০২২ সালে ৮০টি ফ্যাক্ট চেকিং গ্রুপ ইউটিউবের উদ্দেশে লেখা এক চিঠিতে বলেছিল, ইউটিউব তার প্ল্যাটফর্মকে অসাধুদের স্বার্থে ব্যবহৃত হতে দিচ্ছে; যেখানে এই ব্যক্তিরা নিজেদের সংগঠিত করতে পারছেন ও তহবিলও সংগ্রহ করছেন। কিন্তু এসবের বিরুদ্ধে ইউটিউবের নেওয়া পদক্ষেপ যথেষ্ট নয়।
সেন্টার ফর কাউন্টারিং ডিজিটাল হেইট নামের একটি প্রতিষ্ঠান তাদের গবেষণায় বলেছে, ইউটিউব জলবায়ুসংক্রান্ত ভুল তথ্য ছড়ায় এমন চ্যানেলের মাধ্যমে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার মুনাফা করছে। গত এপ্রিলে ডিসমিসল্যাব এক প্রতিবেদনে বলেছিল, দেশি–বিদেশি সুপরিচিত সংবাদমাধ্যমের নকল চ্যানেল তৈরি করে ভুল তথ্য ব্যবহার করা হয়। সেখান থেকেও ইউটিউব আয় করে।
কোন চ্যানেল ইউটিউবে আয় করছে আর কোনগুলো করছে না—সেই তথ্য দেওয়ার ক্ষেত্রেও ইউটিউব স্বচ্ছ নয়। গত বছরের ১৭ নভেম্বরের আগে কোনো চ্যানেলের মনিটাইজেশন–সংক্রান্ত তথ্য সবার জন্য উন্মুক্ত ছিল। চ্যানেলের সোর্স কোডে গিয়ে দেখা যেত মনিটাইজেশনের মাধ্যমে তারা আয় করছে কি না। কিন্তু ইউটিউব এখন তা দেখায় না।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কোন ভিডিওতে কোন ধরনের বিজ্ঞাপন দেখানো হচ্ছে, তা সুনির্দিষ্টভাবে দেখা সম্ভব নয়। ইউটিউবের মূল প্রতিষ্ঠান গুগল তাদের বিজ্ঞাপন সুরক্ষানীতিতে বলেছে, স্বয়ংক্রিয়ভাবে অশ্লীলতা, নগ্নতা, সন্ত্রাসবাদ এবং অন্যান্য সংবেদনশীল বিষয়ে বিজ্ঞাপন দেখানো হয় না। যদিও তারা ভুল বা বিভ্রান্তিকর কনটেন্টের বিষয়ে কিছু বলেনি। এমনকি বিজ্ঞাপনদাতাদেরও ভুল তথ্যের কনটেন্ট অন্য বিষয়গুলোর মতো বাদ দেওয়ার সুযোগ ইউটিউব দেয় না। কোনো ভিডিওতে বিজ্ঞাপন চলার পর বিজ্ঞাপনদাতারা দেখতে পারেন তাঁদের বিজ্ঞাপন কোথায় প্রদর্শিত হচ্ছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ইউটিউবের নীতিতে সীমাবদ্ধতা রয়েছে। কারণ, সেগুলো অস্পষ্ট ও যথেষ্ট নয়। ফেসবুক, টুইটার ব্যবহারকারীদের ভুল কনটেন্টের বিষয়ে সতর্ক করে লেবেল যুক্ত করে দেয়। কিন্তু ইউটিউব তা করে না। ভুল তথ্যের বিরুদ্ধে তারা তখনই ব্যবস্থা নেয়, যখন তাদের নীতির লঙ্ঘন ঘটে। কিন্তু সব ক্ষেত্রে সেটাও হয় না। তাদের স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতি প্রায়ই ভুল তথ্য শনাক্ত করতে ব্যর্থ।
ইউটিউবের বাজার বড়, কিন্তু সুরক্ষার ক্ষেত্রে তাদের নিষ্ক্রিয়তা কম। বিশেষ করে, বাংলাদেশের মতো দেশে বাংলা ভাষার মানুষের জন্য সুরক্ষানীতি বেশি উপেক্ষিত। এ ছাড়া প্রযুক্তিগত দায়বদ্ধতাবিষয়ক সংস্থার অভাব, গবেষণা এবং এসব ক্ষেত্রে শিক্ষার কম আগ্রহ ওই সমস্যা বাড়িয়ে তুলছে।
তথ্যব্যবস্থায় ইউটিউবের ভূমিকা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যপ্রযুক্তি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক বি এম মইনুল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, দেশের মানুষ এখনো ডিজিটাল স্বাক্ষরতায় পিছিয়ে। এখানে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভুল তথ্য ছড়ানোর মাধ্যমে সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটেছে। তাই বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর ক্ষেত্রে ইউটিউবের মতো প্ল্যাটফর্মগুলোকে আরও বেশি গ্রাহকসেবা ও পর্যবেক্ষণের বিষয়ে জোর দিতে হবে। এ ছাড়া সরকারকে ইউটিউবের কাছে ব্যাখ্যা চাইতে হবে ভুল তথ্যের ভিডিওর বিষয়ে।