লেখক, গবেষক ও মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক বলেছেন, ঘৃণাকে অবলম্বন করে সমাজে বিভাজন তৈরি হচ্ছে। একে মোকাবিলার জন্য মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়েই ঘুরে দাঁড়াতে হবে। এ কাজে তরুণদের বড় ভূমিকা পালন করতে হবে।
বিশ্ব অহিংসা দিবস উপলক্ষে শনিবার বিকেলে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর মিলনায়তনে ‘গণহত্যা ও বিচার’বিষয়ক সার্টিফিকেট কোর্সের সমাপনী ও সনদ বিতরণ অনুষ্ঠানে মফিদুল হক এ কথা বলেন। তিনি বলেন, ‘তরুণদের অনেক দায়বদ্ধতা রয়েছে। আমরা যখন মুক্তিযুদ্ধের কথা বলি, তখন সম্প্রীতির সমাজকেই তুলে ধরার কথা বলি।
পাকিস্তান বাঙালির জন্য সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র ছিল। ধর্মের বিভাজন তৈরি করে সেখানে কলুষ তৈরি করা হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে নতুন করে আমরা একটা জাতিরাষ্ট্র তৈরি করেছি। যে রাষ্ট্র অসাম্প্রদায়িক, যে জাতিসত্তা হাজার বছরের লালিত গৌরবের, ধর্মীয় সহনশীলতা, সকল ধর্মের সমন্বয়, ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ, সাম্যের আদর্শ, গণতন্ত্রের আদর্শ ছিল আমাদের। সেই দেশে ঘৃণা ছড়ানো বন্ধ করতে হবে।’
মাসব্যাপী এ কোর্স সম্পন্ন করেন বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ৪৫ জন শিক্ষার্থী। অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি হিসেবে তাদের হাতে সনদ তুলে দেন বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম। তিনি বলেন, ‘এই কোর্স সম্পন্নের মধ্য দিয়ে এই তরুণদের ওপর আরও দায়বদ্ধতা তৈরি হলো। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার জায়গায় ঘাটতি তৈরি হয়েছে। এ কারণেই মানুষ এত দুর্নীতির আশ্রয় নেয়।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনার লালন ও তা বিকাশের প্রয়োজন এখনো ফুরিয়ে যায়নি। তরুণেরা ব্যক্তি, পারিবারিক, সামাজিক ও পেশাগত জীবনে এই চেতনাকে ধারণ ও লালন করলে আমাদের পূর্বসূরিরা যে দেশের জন্য আত্মোৎসর্গ করেছেন, সেখানে আমরা সার্থকতা খুঁজে পাব।’
অনুষ্ঠানে প্যানেল আলোচনা ‘শান্তির বার্তা দিয়ে ঘৃণাত্মক বক্তব্য প্রতিরোধ: জাতিসংঘের নিবেদন’ উপস্থাপন করেন তিন তরুণ গবেষক নুসাইবা জাহান, মো. জাহিদ-উল ইসলাম ও তাবাসসুম ইসলাম। তাঁদের ভাষ্যমতে, গণহত্যার মতো অপরাধের সূচনাও হয় ঘৃণা ছড়ানোর মধ্য দিয়ে। করোনাকালে ডিজিটাল মাধ্যমে ঘৃণা ছড়ানোর মাত্রা বেড়ে গেছে। কখনো ব্যক্তিবিশেষের বিশ্বাসের ভিত্তিতে ভুল, মিথ্যা ও একপেশে তথ্যের মাধ্যমেও ঘৃণা ছড়ানো হয়।
সূচনা বক্তব্যে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের অন্যতম ট্রাস্টি সারওয়ার আলী বলেন, কোনো জাতি বা ধর্ম যখন নিজেদের শ্রেষ্ঠত্বের দাবি করে, তখন জনমত তার পক্ষে নেওয়ার জন্য পরিকল্পিতভাবে ঘৃণা বা বিদ্বেষ ছড়ায়। এ ধরনের বিদ্বেষ পৃথিবীর মানুষকে কতটা কষ্টে ফেলতে পারে, এর সর্বশেষ নিদর্শন সম্ভবত রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা বিশ্বের পাল্টাপাল্টি নিষেধাজ্ঞার ফল সুদূর বাংলাদেশের মানুষ টের পাচ্ছে।
সারওয়ার আলী আরও বলেন, ‘সভ্যতার আদি থেকে দেখা গেছে, মতভিন্নতার সঙ্গে যখন ক্ষমতার বিষয়টি যুক্ত হয়, তখন সহিংস পদ্ধতি বেছে নেওয়া হয়। এ নিয়ে যিনি কাজ করে গেছেন, তিনি মহাত্মা গান্ধী। তিনি অহিংসার মধ্য দিয়ে ভারতবর্ষে শুধু স্বাধীনতা নয়, মানুষের মধ্যে বৈষম্য দূর করার জন্য অহিংসাকেই মূল পদ্ধতি হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। মার্টিন লুথার কিং জুনিয়রও বর্ণবাদ নিরসনে অহিংস অবস্থান নিয়েছিলেন।’
সমাপনী বক্তব্যে মফিদুল হক বলেন, যাঁরা এই সনদ পেয়েছেন, তাঁরা মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের দূত হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ, এর অন্তর্নিহিত মূল্যবোধ ও সত্যিকারের মানুষ হয়ে ওঠা, সত্যিকারের মানবিক সমাজ গড়ে তুলতে যাঁর যাঁর জায়গা থেকে কাজ করবেন।
করোনা মহামারিতে অনলাইনে ‘গণহত্যা ও বিচার’বিষয়ক কোর্সটি পরিচালনা করে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের সেন্টার ফর দ্য স্টাডি অব জেনোসাইড অ্যান্ড জাস্টিস। গত মাস থেকে কোর্সটি সরাসরি শুরু করা হয়। একাদশতম এই কোর্সের শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে সেন্টার ফর দ্য স্টাডি অব জেনোসাইড অ্যান্ড জাস্টিসের পরিচালক মফিদুল হক বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের সঙ্গে নানাভাবে সম্পৃক্ত হচ্ছেন তরুণেরা। এটি মুক্তিযুদ্ধের শক্তির বহমানতা। একে নতুনভাবে ধারণ করে সমাজের কল্যাণে নিয়োগ করা যায়, সেটা আমাদের তরুণ গবেষকেরা তুলে ধরেছেন। ঘৃণাত্মক বক্তব্য আজ ভয়ংকর রূপ ধারণ করছে।’ আন্তর্জাতিকভাবেও তার যে উপস্থাপনা ও জাতীয় সংকট মিলিয়ে বিশ্ব অহিংসা দিবসে এর চেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ উপস্থাপনা আর হতে পারে না।