জেনেভায় মানবাধিকার পরিষদের ৫১তম অধিবেশনে গুমের আলোচনায় বাংলাদেশ প্রসঙ্গ।
গুমের প্রায় সব অভিযোগের তথ্য জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞ কমিটিকে দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদে এ তথ্য জানানো হয়েছে। একই সঙ্গে বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি নিখোঁজ বলে জানানো হলে স্বজনদের দেওয়া তথ্য আইন অনুযায়ী যথাযথ তদন্ত সাপেক্ষে ভুক্তভোগীকে উদ্ধারে সরকার বদ্ধপরিকর।
বাংলাদেশের পক্ষ থেকে এ–ও বলা হয়েছে, অনেক ক্ষেত্রে গুমের শিকার বলে ধারণা করা ব্যক্তি ফেরত এসে প্রমাণ করেছেন, গুমের অভিযোগ ঠিক নয়।
সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় চলমান মানবাধিকার পরিষদের ৫১তম অধিবেশনে গতকাল মঙ্গলবার সকালে গুমবিষয়ক বিশেষজ্ঞ কমিটি ওয়ার্কিং গ্রুপ অন এনফোর্সড অর ইনভলান্টারি ডিজঅ্যাপিয়ারেন্সের সর্বসাম্প্রতিক প্রতিবেদন পেশের পর তা নিয়ে আলোচনায় বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে এমন বক্তব্য দেওয়া হয়।
জেনেভায় জাতিসংঘের দপ্তরে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধির পক্ষ থেকে গুমের অভিযোগ সম্পর্কে সরকারের অবস্থান তুলে ধরা হয়। স্থায়ী প্রতিনিধির পক্ষে বক্তব্য দেন জেনেভায় বাংলাদেশ মিশনের দ্বিতীয় সচিব আবদুল্লাহ আল ফরহাদ।
ওই অধিবেশনে বেসরকারি মানবাধিকার সংগঠনগুলোর মধ্যে এশিয়ান লিগ্যাল রিসোর্সেস সেন্টারের পক্ষ থেকে গুমের বিষয়ে বিভিন্ন দেশের সরকারগুলোর ভূমিকায় উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। এ সময় বলা হয় যে গত মাসে জাতিসংঘের সাবেক মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার মিশেল ব্যাশেলেতের ঢাকা সফরের পর গুমের শিকার পরিবারগুলোকে সরকার ভয় দেখাচ্ছে।
দক্ষিণ এশিয়ার আরও দুটি দেশ শ্রীলঙ্কা ও ভারতের পাশাপাশি বাংলাদেশ প্রসঙ্গে সংগঠনটির প্রতিনিধি মো. আশরাফুজ্জামান বলেন, মানবাধিকার কর্মী ও প্রবাসী সাংবাদিকদের স্বজনদের দেশে হয়রানি করা হচ্ছে।
জাতিসংঘের গুমবিষয়ক বিশেষজ্ঞ কমিটি মানবাধিকার পরিষদে গতকাল যে প্রতিবেদন পেশ করেছে, তাতে দেখা গেছে, বাংলাদেশে গুমের অভিযোগ বেড়েছে। গত বছরের ২২ মে থেকে এ বছরের ১৩ মে পর্যন্ত এক বছরে কমিটির কাছে আসা বাংলাদেশে গুমের অভিযোগের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৮৮, যা আগে ছিল ৭৬।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ওই সময়ে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে বিশেষজ্ঞ কমিটিকে আটজনের বিষয়ে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক তথ্য দেওয়া হয়েছে। এখনো ৮১ জনের গুমের অভিযোগের কোনো সুরাহা হয়নি বলেও এই প্রতিবেদনে উল্লেখ রয়েছে।
যদিও বাংলাদেশ সরকার অধিকাংশ অভিযোগের বিষয়ে বিশেষজ্ঞ কমিটিকে কী তথ্য দিয়েছে তা জানা যায়নি। আর যে আটটি অভিযোগের বিষয়ে বাংলাদেশ সরকার ‘উল্লেখযোগ্যসংখ্যক তথ্য’ দিয়েছে বলে উল্লেখ রয়েছে, তার সব কটি যথাযথ কি না, সে বিষয়েও কিছু জানা যায়নি।
মানবাধিকার পরিষদে বিভিন্ন সময়ে সরকারের ভাষ্যে বলা হয়, কিছু স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর প্রবণতা হচ্ছে, সরকারের ক্ষতি করার উদ্দেশ্যে নিখোঁজের সব ঘটনাকে ‘গুম’ হিসেবে অভিহিত করা। তাই অভিযোগগুলো কতটা তথ্যভিত্তিক এবং তার প্রমাণ যাচাইয়ে বিশেষজ্ঞ কমিটির প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে।
সরকারের পক্ষ থেকে আরও বলা হয়, ‘দুষ্কৃতকারীরা’ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য পরিচয়ে ‘অপহরণের’ মতো অপরাধে লিপ্ত হচ্ছে বলে একটি প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সরকার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কোনো সদস্যের অপকর্ম, অপরাধ বা সীমা লঙ্ঘনের বিষয়ে ‘শূন্য সহনশীলতা’ নীতি অনুসরণ করে চলেছে। বাংলাদেশ মানবাধিকারের আন্তর্জাতিক বাধ্যবাধকতা থেকে কখনো সরে যায়নি উল্লেখ করে বলা হয়, ওয়ার্কিং গ্রুপের সঙ্গে সরকার গঠনমূলকভাবে কাজ করে যাচ্ছে।
গুমের শিকার পরিবারগুলোর সংগঠন ‘মায়ের ডাক’–এর পক্ষ থেকেও কমিটির কাছে লিখিত অভিযোগ পাঠানো হয়েছে। গত আগস্টে ব্যাশেলেতের সফরের পর থেকে বিভিন্ন সময়ে ভুক্তভোগী পরিবারগুলো কী ধরনের হুমকি ও হয়রানির শিকার হচ্ছে, তার কিছু নজির চিঠিতে তুলে ধরা হয়েছে।
মায়ের ডাকের সংগঠক এমন কয়েক নারীর ছবি অপব্যবহার করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাঁদের চরিত্র হননে প্রচার এবং হুমকির কথাও এতে উল্লেখ করা হয়।
মায়ের ডাকের সমন্বয়কারী সানজিদা ইসলাম গতকাল এই প্রতিবেদককে জানান, ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে গুমের শিকার মাজহারুল ইসলামের ময়মনসিংহের বাসায় গত সোমবার পুলিশের গোয়েন্দা শাখার কর্মকর্তা পরিচয় দিয়ে এক ব্যক্তি তাঁর পরিবারের সবার ছবি, পরিচয়পত্র, ফোন নম্বরসহ বিভিন্ন তথ্য নিয়ে গেছে। যশোরে গুমের শিকার আওয়ামী লীগের কর্মী সাঈদের মাকে একই দিন পুলিশের বিশেষ শাখার কার্যালয়ে ডেকে নিয়ে তাঁর পরিচয়পত্রের অনুলিপি রাখা হয় এবং একটি সাদা কাগজে সই করতে বলা হয়। তিনি সই করেননি।
ভুক্তভোগী বিভিন্ন পরিবারের পক্ষ থেকে এর আগেও এমন অভিযোগ উঠেছিল। তখন সরকারের পক্ষে বলা হয়েছিল, তদন্তের জন্য তথ্য সংগ্রহের উদ্দেশ্যেই পরিবারগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করা হচ্ছে। সরকারের সেই ভাষ্য অবশ্য পরিবারগুলো প্রত্যাখ্যান করে ভীতি প্রদর্শন ও হয়রানির অভিযোগ করে আসছে।
জাতিসংঘের গুমবিষয়ক বিশেষজ্ঞ কমিটির ১২৮তম সভা গত সোমবার শুরু হয়েছে এবং তা আগামী মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত চলার কথা। রুদ্ধদ্বার ওই সভায় বাংলাদেশসহ ২১টি দেশের প্রায় ৭০০ অভিযোগ পর্যালোচনার কথা রয়েছে।