কাজ করছেন এক স্বর্ণকার
কাজ করছেন এক স্বর্ণকার

স্বর্ণকারদের গড় আয়ু কম

নবী হোসেনের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। কিছুক্ষণ আগে সালফিউরিক অ্যাসিডে ধুয়ে সোনার বালা উজ্জ্বল করলেন। এরপর সোনার বালায় সোহাগা লাগাতে শুরু করলেন। বাঁকা নলে ফুঁ দিয়ে মোমের আগুন লাগাচ্ছেন বালায়। আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠছে বালা।

গবেষকেরা বলছেন, নবী হোসেনের মতো সোনার অলংকার তৈরি করা মানুষ (স্বর্ণকার) তুলনামূলক কম দিন বাঁচেন। দেশের সাধারণ মানুষের চেয়ে স্বর্ণকারদের গড় আয়ু ১২ দশমিক ৩ বছর কম।

স্বর্ণকার নবী হোসেনের বয়স ৫০ বছর পেরিয়েছে। রাজধানীর পুরান ঢাকার তাঁতীবাজারের ২৮ কোতোয়ালি রোডে তাঁর দোকান। নাম ফারুক জুয়েলারি ওয়ার্কস। ছোট একটি ঘর, তিন থেকে চারজন মানুষ কোনোরকমে বসে কাজ করতে পারেন। মোমের আগুন নিভে যায়, তাই বৈদ্যুতিক পাখা থাকলেও চালানো হয় না। ভ্যাপসা গরমের মধ্যেই কাজ করছিলেন এই স্বর্ণকার।

তাঁতীবাজারের ২৮ ও ২৮/১ কোতোয়ালি রোডে দুটি ভবনে ১৭০টি কক্ষে ১৭০টি ছোট কারখানা। কেউ কেউ বলেন ‘স্বর্ণকারের দোকান’।

ভবন দুটি ঘুরে দেখা গেল, সব কক্ষের পরিবেশ মোটামুটি একই। স্বল্প পরিসরে বসে মালিক ও কর্মীরা কাজ করছেন। কোথাও কয়লার তাওয়ায় আগুন গনগন করছে। কোথাও একই সঙ্গে দু-তিনটি মোমের আগুন জ্বলছে। কেউ ঘেমে একাকার। কারও কারও মুখে জ্বলন্ত সিগারেট। এই পরিবেশে কাজ হয় মাসের পর মাস, বছরের পর বছর, প্রজন্মের পর প্রজন্ম।

বিভিন্ন দোকানে কর্মরত স্বর্ণকারেরা বলেন, তাঁদের কাজটি পরিশ্রমের, ধৈর্যের। কাজের সময় নিশ্বাসের সঙ্গে ছাই, ধোঁয়া ও সালফিউরিক অ্যাসিড শরীরের ভেতরে যায়।

স্বর্ণকার নবী হোসেন বলেন, ‘ফ্যান ছাড়লে প্রদীপ নিভে যায়। গরমে ঘাম হয়। জ্বর হয় নিয়মিত।’

নবী হোসেনসহ একাধিক স্বর্ণকার বললেন, এখানে যাঁরা কাজ করেন, দিনের শেষে তাঁদের অনেকেই দুটি করে পাকা কলা খান। তাঁদের বিশ্বাস, সারা দিনের ছাই, ধোঁয়া ও অ্যাসিডের ক্ষতি পুষিয়ে দেয় কলা।

গবেষকেরা বলছেন, সারা দেশে দুই থেকে তিন লাখ স্বর্ণকার আছেন। বড় শহর, ছোট শহর, উপজেলা সদর বা পুরোনো বড় বড় বাজারে স্বর্ণকারদের দেখা যায়। অলংকার তৈরি করার সময় স্বর্ণকারেরা শরীরের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ নানা ধরনের রাসায়নিক দ্রব্যের সংস্পর্শে আসেন। এর মধ্যে আছে সায়ানাইড, সিসা, দস্তা, ক্যাডমিয়াম, সালফিউরিক অ্যাসিড, নাইট্রিক অ্যাসিড, সিলিকা। গবেষণায় দেখা গেছে, দীর্ঘদিন এসব রাসায়নিকের সংস্পর্শে থাকার কারণে তাঁরা বিষক্রিয়ার শিকার হন। নানা ধরনের রোগে ভোগেন।

যৌথ গবেষণা

গত বছরের জুনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) জার্নালে (সাময়িকী) একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। গবেষণাটি করেন সাতজন গবেষক। তাঁদের ছয়জন বিএসএমএমইউর শিক্ষক ও গবেষক। অপরজন ক্যাম্পেইন ফর টোব্যাকো ফ্রি কিডস নামের একটি বেসরকারি সংগঠনের গবেষক।

গবেষকেরা ২০ জন মৃত স্বর্ণকারের তথ্য বিশ্লেষণ করেন। এসব স্বর্ণকার ঢাকা শহরের তাঁতীবাজার, হাজারীবাগ, মোহাম্মদপুর, লালবাগ এবং মানিকগঞ্জের শিবালয় ও টাঙ্গাইলের নাগপুরে কাজ করতেন।

মৃত স্বর্ণকারদের তথ্য সংগ্রহের জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্ধারিত রীতি ও প্রশ্নপত্র ব্যবহার করেছিলেন গবেষকেরা। মৃত স্বর্ণকারদের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিদের কাছ থেকে এসব তথ্য ২০১৮ সালে সংগ্রহ করা হয়।

গবেষণার ফলাফল

গবেষণায় নমুনা হিসেবে নেওয়া মৃত স্বর্ণকারদের সবাই ছিলেন পুরুষ। তাঁদের চারজনের কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছিল না। ১৬ জনের প্রাথমিক শিক্ষা বা তার চেয়ে কিছু বেশি শিক্ষা ছিল। তাঁদের মধ্যে ১৪ জন (৭০ শতাংশ) নিয়মিত ধূমপান করতেন। ১০ জন (৫০ শতাংশ) নিয়মিত মদ্যপান করতেন। অর্থাৎ, একাধিক স্বর্ণকারের একই সঙ্গে ধূমপান ও মদ্যপানের অভ্যাস ছিল।

স্বর্ণকারদের মধ্যে ১৩ জনের উচ্চ রক্তচাপ, ৭ জনের হৃদ্‌রোগ, ৩ জনের স্ট্রোকের ইতিহাস, ৩ জনের ক্যানসার, ১০ জনের ডায়াবেটিস ও ৩ জনের শ্বাসতন্ত্রের দীর্ঘস্থায়ী রোগ ছিল। অর্থাৎ কোনো কোনো স্বর্ণকার একই সঙ্গে একাধিক রোগে ভুগেছিলেন।

এসব স্বর্ণকার কত বছর বেঁচে ছিলেন, সে তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ১৮ জন ৭০ বছরের কম বয়সে মারা যান। ২ জন মারা যান ৭০ বছরের বেশি বয়সে। গবেষকেরা বলছেন, এসব মানুষ গড়ে ৬০ বছর বেঁচে ছিলেন।

২০২৩ সালের হিসাবে, দেশে মানুষের গড় আয়ু ৭২ দশমিক ৩ বছর। অন্যদিকে গবেষণা অনুযায়ী, স্বর্ণকারদের গড় আয়ু ৬০ বছর। অর্থাৎ স্বর্ণকারেরা সাধারণ মানুষের চেয়ে গড়ে ১২ দশমিক ৩ বছর কম বাঁচেন।

করণীয়

গবেষণার তথ্য নিয়ে কথা হয় তাঁতীবাজারের মনীষা জুয়েলারি ওয়ার্কসের মালিক মহাবীর রায়ের সঙ্গে। বয়স তাঁর ষাটের কাছে। শৈশব থেকে এই পেশায় আছেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে দিনের পর দিন কাজ করি। কেমিক্যালের নানা ঝুঁকি আছে, তা–ও জানি। কিন্তু আমরা এত কম বাঁচি, এটা জানা ছিল না। আমরা কী করে আরও বেশি দিন বাঁচব, তা–ও গবেষকদের বলে দেওয়া উচিত।’

ছোট এই গবেষণায় দেশের একটি পেশার মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকির বিষয়টি উঠে এসেছে। এই গবেষণার নেতৃত্বে ছিলেন বিএসএমএমইউর পাবলিক হেলথ অ্যান্ড ইনফরমেটিকস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মো. খালেকুজ্জামান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘স্বর্ণকারদের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে হবে। কাজের সময় সুরক্ষামূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। অসংক্রামক রোগের ঝুঁকি বাড়ায়—এমন অভ্যাস, যেমন মদ্যপান, ধূমপান, এসব থেকে দূরে থাকতে হবে।’