এ ধরনের কেনাকাটার প্রস্তাব মাত্র চার দিনে মূল্যায়ন অসম্ভব কাজ। এ ক্ষেত্রে পদে পদে নিয়ম ভঙ্গের অভিযোগ উঠেছে।
দরপত্রে অংশ নেওয়া তিনটি প্রতিষ্ঠানের আর্থিক প্রস্তাব মাত্র চার দিনে মূল্যায়ন শেষ করে চীনা একটি কোম্পানিকে কাজ দিয়ে নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ কোম্পানি লিমিটেড (বিটিসিএল)। পরদিনই পরিচালনা পর্ষদের সভায় ৩২৬ কোটি টাকায় কাজ দেওয়ার প্রস্তাব অনুমোদন করা হয়। এ ঘটনা ঘটেছে উচ্চ গতির ইন্টারনেট সেবা ফাইভ–জি উপযোগী অপটিক্যাল ফাইবার (বিশেষ তার) প্রকল্পের একটি দরপত্রে।
তবে সরকারি ক্রয়বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ ধরনের বিশাল কারিগরি যন্ত্রপাতি কেনাকাটায় আর্থিক প্রস্তাব মূল্যায়ন করতে সময় লাগে অন্তত এক মাস। মাত্র চার দিনে এমন জটিল হিসাব মূল্যায়ন করা অসম্ভব কাজ। অভিযোগ উঠেছে, একটি প্রতিষ্ঠানকে কাজটি দিতে এমন তড়িঘড়ি করা হয়েছে।
এত কম সময়ে মূল্যায়ন শেষ করে কার্যাদেশ দেওয়ার অর্থ হচ্ছে, এখানে কোনো ভেজাল আছে।ফজলুল করিম, সাবেক মহাপরিচালক, সিপিটিইউ
এর আগে একই দরপত্রের কারিগরি প্রস্তাব মূল্যায়ন করা হয়। তখন কেউ-ই উত্তীর্ণ হয়নি। পরে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সেন্ট্রাল প্রকিউরমেন্ট টেকনিক্যাল ইউনিটের (সিপিটিইউ) রিভিউ প্যানেলের সিদ্ধান্তে সবার প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। অভিযোগ রয়েছে, ‘এক ধাপ দুই খাম’ পদ্ধতির এ দরপত্রে পদে পদে নিয়ম ভঙ্গ করে পছন্দের একটি কোম্পানিকে কাজ দেয় বিটিসিএল।
এ–সংক্রান্ত নথিপত্র পর্যালোচনা করে দেখা যায়, দরপত্রের শর্ত (আইটিটি) অনুযায়ী, আর্থিক প্রস্তাব উন্মুক্ত করার আগে কারিগরি যোগ্য প্রতিষ্ঠানগুলোকে অন্তত এক সপ্তাহ আগে চিঠি দিতে হবে, যাতে আর্থিক প্রস্তাব খোলার দিন নির্বাচিত সব প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি অংশ নিতে পারে।
কিন্তু এ দরপত্রে আর্থিক প্রস্তাব উন্মুক্ত করার মাত্র দুই দিন আগে প্রতিষ্ঠানগুলোকে চিঠি দেওয়া হয়। এ কারণে একটি প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে প্রকল্প পরিচালক বরাবর চিঠি দিয়ে বলা হয়, মাত্র দুই দিনের নোটিশে তাদের পক্ষে কাউকে পাঠানো সম্ভব নয়। আইন অনুযায়ী, এক সপ্তাহ সময় দেওয়ার অনুরোধ জানায় প্রতিষ্ঠানটি। কিন্তু বিটিসিএল তা আমলে নেয়নি।
টেলিযোগাযোগ বিভাগ থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, ফাইভ–জি উপযোগী অপটিক্যাল ফাইবার বসানোর উদ্যোগ নেওয়া হয় ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে। এর মাধ্যমে জেলা ও উপজেলাকে অপটিক্যাল ফাইবার সংযোগের আওতায় আনার কথা। প্রকল্পের মোট ব্যয় ১ হাজার ৫৯ কোটি টাকা। প্রকল্প প্রস্তাবে (ডিপিপি) সরঞ্জাম কেনার ব্যয় ধরা হয় ৪৬৩ কোটি টাকা।
এ–সংক্রান্ত নথি বলছে, যন্ত্রপাতি কেনার দরপত্রে অংশ নেয় তিনটি কোম্পানি—জেডটিই করপোরেশন, হুয়াওয়ে টেকনোলজিস লিমিটেড ও নকিয়া সলিউশন। কারিগরি মূল্যায়ন প্রতিবেদন অনুযায়ী, তিন প্রতিষ্ঠানের কেউ দরপত্রের শর্ত পূরণ করতে পারেনি। তবু তাদের সবাইকে যোগ্য হিসেবে মূল্যায়ন করে সাত সদস্যের কারিগরি কমিটি। কারিগরি মূল্যায়ন অনুমোদনকারী কর্তৃপক্ষ হিসেবে বিটিসিএলের তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক আসাদুজ্জামান চৌধুরী এমন মূল্যায়ন প্রতিবেদন অনুমোদন করেননি। এতে টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয় থেকে বিটিসিএলের এমডিকে বদলি ও পরে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়; যা পরে আদালত স্থগিত করেছেন।
নথিপত্র পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ৮ নভেম্বর জেডটিই, হুয়াওয়ে এবং নকিয়ার আর্থিক প্রস্তাব খোলা হয়। দেখা যায়, ৩২৬ কোটি টাকা প্রস্তাব দিয়ে সর্বনিম্ন দরদাতা হয় হুয়াওয়ে টেকনোলজিস লিমিটেড। চার দিন (সাপ্তাহিক ছুটিসহ) পর ১২ নভেম্বর মূল্যায়ন প্রতিবেদন জমা হয়। পরদিন ১৩ নভেম্বর বিটিসিএলের পরিচালনা পর্ষদের ২১৬তম সভায় হুয়াওয়ের ক্রয় প্রস্তাবটি অনুমোদনের সুপারিশ করা হয়। তার পরদিনই ওই কোম্পানিকে নোটিফিকেশন অব অ্যাওয়ার্ড বা কার্যাদেশ দেওয়া হয়।
সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আর্থিক প্রস্তাব খোলার পর সেটি মূল্যায়নে অনেকগুলো কাজ থাকে। দরপত্রের শর্তে আছে, মূল্যায়ন শুরুর আগে প্রয়োজনে ব্যাখ্যা নিতে হবে, যোগ-বিয়োগে বা হিসাবে কোনো ভুল আছে কি না, তা যাচাই করতে হবে এবং মুদ্রা বিনিময় হার অনুযায়ী সবার দরকে টাকায় আনতে হবে। এরপর আইন, বিধি ও দরপত্রের শর্তানুযায়ী মূল্যায়ন করতে হবে। সবার মূল্যায়িত দরের তুলনা করে সর্বনিম্ন দরদাতা চিহ্নিত হবে। সর্বনিম্ন দরদাতাকে কার্যাদেশ দেওয়ার সুপারিশের আগে দরপত্রে চাওয়া কারিগরি ও আর্থিক অভিজ্ঞতার হালনাগাদ তথ্য সংগ্রহ করে তাদের যোগ্যতা নিশ্চিত হতে হবে।
শর্তাবলিতে আরও আছে, প্রয়োজনে কারিগরি মূল্যায়ন কমিটি দরপত্রে অংশগ্রহণকারী প্রতিষ্ঠানের কার্যালয় ও কারখানা পরিদর্শনে যাবে। তাদের দরপত্রে দেওয়া সব তথ্য যাচাই-বাছাই করে চুক্তি সম্পাদনে সক্ষমতা নিশ্চিত করে তারপর সুপারিশ করা যাবে। এত সব কার্যক্রম শেষ করতে একটা লম্বা সময় লাগে। কিন্তু বিটিসিএলের উল্লিখিত দরপত্রে মাত্র চার দিনে এত সব কার্যক্রম শেষ করে একটি প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেওয়ার সুপারিশ করে মূল্যায়ন কমিটি। এরপর এক দিনে তা অনুমোদন করে বিটিসিএলের পরিচালনা পর্ষদ।
বিটিসিএলের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, ৮ নভেম্বর সকালে দরপত্রের আর্থিক প্রস্তাব খোলা হয়। আর সেটা ১৩ নভেম্বর বিটিসিএলের পরিচালনা পর্ষদে অনুমোদন করা হয়। ওই সভা ডাকার নোটিশে তারিখ লেখা ৮ নভেম্বর। তাই প্রশ্ন উঠেছে, বিটিসিএলের পরিচালনা পর্ষদ কীভাবে জানত, ১৩ নভেম্বরের আগেই মূল্যায়ন কাজ শেষ হবে।
সিপিটিইউর সাবেক মহাপরিচালক ফজলুল করিম প্রথম আলোকে বলেন, বিটিসিএলের যন্ত্রপাতি কেনাকাটাসংক্রান্ত দরপত্র বেশ জটিল। সে জন্য আর্থিক প্রস্তাব মূল্যায়নে সময় বেশি দিতে হয়। মাত্র চার দিনে সব কাগজপত্র মূল্যায়ন শেষ করা অসম্ভব। কারণ, দরদাতাদের সব কাগজপত্র যাচাই-বাছাই, তাদের দেওয়া ব্যাংকের হিসাব সঠিক আছে কি না—এসব দেখতে হয়। অফিস ও জনবল ঠিক আছে কি না দেখতে হয়। এসব দেখতে সময় নেয় এক মাসের মতো। তিনি বলেন, এত কম সময়ে মূল্যায়ন শেষ করে কার্যাদেশ দেওয়ার অর্থ হচ্ছে, এখানে কোনো ভেজাল আছে।
অনুসন্ধানে এই দরপত্রে আরও অসংগতি পাওয়া গেছে। সাধারণত যেকোনো দরপত্র পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দেওয়ার আগে দাপ্তরিক প্রাক্কলিত ব্যয় প্রস্তুত এবং অনুমোদন করে সিলগালা খামে সংরক্ষণ করতে হয়। যেটি আর্থিক প্রস্তাব খোলার দিন সবার সামনে খুলতে হয়। একই সঙ্গে একটি অনুলিপি সবাইকে দিতে হয়, যা গণ খাতে ক্রয় আইনের বিধি ১৬ (৫ ক) ও (৫ খ) এবং ৯৭–এ উল্লেখ আছে। এই অনুমোদিত দাপ্তরিক প্রাক্কলিত ব্যয়ের সঙ্গে দরপত্রদাতাদের দামের তুলনা করে কার্যাদেশ দেওয়ার সুপারিশ করতে হয়। কিন্তু উল্লিখিত দরপত্রে নিয়মটি মানা হয়নি।
এ ছাড়া দরপত্র মূল্যায়ন শেষে যে সুপারিশ করা হয়, তাতে দাপ্তরিক প্রাক্কলিত ব্যয়ের তুলনায় দরদাতার দাম কত শতাংশ কম, সেটা উল্লেখ করা হয়। কিন্তু এই ক্ষেত্রে বিটিসিএলের পরিচালনা পর্ষদে উপস্থাপিত কার্যপত্রে দাপ্তরিক কার্যপত্রের উল্লেখ নেই। এর বদলে প্রকল্প প্রস্তাবে (ডিপিপি) সরকারের বরাদ্দের কথা উল্লেখ আছে।
এসব বিষয়ে বক্তব্য জানতে প্রকল্প পরিচালকের মঞ্জির আহমেদের সঙ্গে চেষ্টা করেও যোগাযোগ করা যায়নি। উপপ্রকল্প পরিচালক মো. বদরুদ্দোজা ও পরিচালনা পর্ষদের সচিব আনোয়ার হোসেন এ নিয়ে কথা বলতে রাজি হননি। পরে বিটিসিএলের মুখপাত্র মহাব্যবস্থাপক (জনসংযোগ) মীর মোহাম্মদ মোরশেদের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এ বিষয়ে একটি মামলা আদালতে বিচারাধীন রয়েছে। বিচারাধীন বিষয়ে কোনো মতামত দেওয়া সম্ভব নয়।
বিটিসিএল সূত্র বলছে, সরঞ্জাম সরবরাহে ২০২২ সালের ১৪ আগস্ট দরপত্র আহ্বান করা হলেও কাজ দিতে সময় লেগেছে ১৫ মাসের বেশি। সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, যেসব যন্ত্রপাতি কেনার প্রক্রিয়া চলছে, তা দরপত্রের শর্ত পূরণ করে না। তা ছাড়া কারিগরি মূল্যায়ন প্রতিবেদনে অযোগ্য হলেও একটি প্রতিষ্ঠানকে কাজটি দেওয়া হচ্ছে।
সিপিটিইউর সাবেক মহাপরিচালক ফজলুল করিম প্রথম আলোকে বলেন, এত কম সময়ে নোটিশ দিয়ে তাড়াহুড়া করে কেন আর্থিক প্রস্তাব খোলা হলো, তা নিয়ে সন্দেহ আছে। আর্থিক প্রস্তাব খোলার আগে কত দিন সময় দিতে হয়, তা দরপত্রে বলা থাকে। তবে এত কম সময় থাকে না। তাই দরপত্রের পুরো প্রক্রিয়া খতিয়ে দেখা উচিত।