দেশের অর্থনীতিতে তথ্যপ্রযুক্তির প্রভাব বিবেচনায় বাংলাদেশের দুর্বল দিক হচ্ছে দক্ষ মানবসম্পদ। তথ্যপ্রযুক্তিতে দক্ষতা, ইন্টারনেটের ব্যবহার, গবেষণা, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় (এআই) বিনিয়োগের মতো ক্ষেত্রেও বাংলাদেশের অবস্থান ভালো নয়। এ ছাড়া এশিয়া–প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের মধ্যে চারটি স্তম্ভ প্রযুক্তি, মানবসম্পদ, শাসন ও প্রভাবের গড় সূচকেও বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে।
যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়, সাইদ বিজনেস স্কুল ও যুক্তরাষ্ট্রের পোর্টুলানস ইনস্টিটিউট তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তির (আইসিটি) প্রয়োগ ও প্রভাবের সূচকসম্পর্কিত নেটওয়ার্ক রেডিনেস ইনডেক্স (এনআরআই) ২০২৪ প্রকাশ করেছে। এনআরআই হলো বিশ্বব্যাপী অর্থনীতিতে তথ্যপ্রযুক্তির প্রয়োগ ও প্রভাবের একটি শীর্ষস্থানীয় বৈশ্বিক সূচক। এনআরআইয়ের সাম্প্রতিক সংস্করণটির নাম ‘বিল্ডিং আ ডিজিটাল টুমরো: পাবলিক–প্রাইভেট ইনভেস্টমেন্টস অ্যান্ড গ্লোবাল কোলাবোরেশন ফর ডিজিটাল রেডিনেস’। এতে চলতি বছর ১৩৩টি দেশের নেটওয়ার্ক প্রস্তুতির চিত্র উঠে এসেছে। এনআরই প্রতিবেদনটিতে প্রযুক্তি, মানবসম্পদ, শাসন ও প্রভাব—এ চারটি বিষয় বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। এসবের অধীন আরও কিছু মানদণ্ড রয়েছে।
বাংলাদেশ এনআরআইয়ের র্যাঙ্কিংয়ে ১৩৩টি দেশের মধ্যে ৪৩ দশমিক ৫৬ স্কোর পেয়ে ৮৯তম অবস্থানে রয়েছে। ২০২৩ সালে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ৯১তম এবং ২০২২ সালে ছিল ৮৮তম। এ ছাড়া ভারত ৪৯তম, পাকিস্তান ৯৭তম, শ্রীলঙ্কা ৯৫তম, ভিয়েতনাম ৪৫তম, ইন্দোনেশিয়া ৪৮তম এবং ফিলিপাইন ৬৩তম অবস্থানে রয়েছে। এ তালিকায় ৭৮ দশমিক ৯৬ স্কোর নিয়ে শীর্ষে যুক্তরাষ্ট্র। পরের দুটি অবস্থান সিঙ্গাপুর ও ফিনল্যান্ডের।
এনআরআই সূচকের চারটি স্তম্ভের মধ্যে বাংলাদেশ প্রযুক্তিতে ৪৩ দশমিক ৭৩, মানবসম্পদে ৩৪ দশমিক শূন্য ৯, শাসনে ৪৫ দশমিক ৮৮ এবং প্রভাবে ৫০ দশমিক ৫৩ স্কোর করেছে।
নিম্ন মধ্য আয়ের দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ ১১তম অবস্থানে আছে। এই শ্রেণির দেশগুলোর মধ্যে প্রযুক্তি, শাসন ও প্রভাবে গড় সূচকের চেয়ে বাংলাদেশ এগিয়ে থাকলেও মানবসম্পদে পিছিয়ে।
তবে এশিয়া–প্রশান্তমহাসাগরীয় অঞ্চলের চারটি স্তম্ভের গড় সূচকের সবকটিতেই বাংলাদেশ পিছিয়ে। এ অঞ্চলে বাংলাদেশের পরে আছে পাকিস্তান, নেপাল, শ্রীলঙ্কা ও লাওস। এনআরআইয়ের প্রতিবেদন অনুযায়ী, এশিয়া–প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে যে ১৩টি দেশ প্রত্যাশা অতিক্রম করতে পেরেছে, সেখানে বাংলাদেশ রয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের আধেয়, অর্থনীতি ও এক্সেসের স্কোর শক্তিশালী দিককে তুলে ধরে। তবে ভবিষ্যৎ প্রযুক্তি, শাসনকাঠামো, অন্তর্ভুক্তি, জীবনযাপনের মান, ব্যক্তিসত্তা, আস্থা, এসডিজির অবদান, নীতি ও ব্যবসা বাংলাদেশে বেশ পিছিয়ে। সবচেয়ে বেশি পিছিয়ে নীতি ও ব্যবসা।
তথ্যপ্রযুক্তি খাতে বাংলাদেশের অবস্থা বোঝাতে আরও নির্ণায়কের মান উঠেছে এনআরআই প্রতিবেদনে। এতে বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য ভালো দিকগুলো হচ্ছে—ইন্টারনেট গ্রাহক বাড়ানো, সাশ্রয়ী মূল্য ও পরিবেশবান্ধব জ্বালানি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে বৈজ্ঞানিক প্রকাশনা, পছন্দের জীবন বেছে নেওয়ার স্বাধীনতা, আন্তর্জাতিক ইন্টারনেট ব্যান্ডউইডথ, মোবাইল ইন্টারনেট ট্রাফিক, ডিজিটাল লেনদেন।
অন্যদিকে বাংলাদেশের দুর্বল দিকগুলো হচ্ছে—এআইভিত্তিক উদ্যোগে বিনিয়োগ, ই–কমার্স আইন, ইন্টারনেট ব্যবহারে লিঙ্গবৈষম্য, প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইট, আইসিটি নিয়ন্ত্রক পরিবেশ, ইন্টারনেটে কেনাকাটা, আর্থিক অ্যাকাউন্টে অনলাইন সুবিধা, নিয়ন্ত্রণ কাঠামোর মান ও নারীর অর্থনৈতিক সুবিধা। পাবলিক ক্লাউড কম্পিউটিং মার্কেটের আকার, উচ্চশিক্ষায় গবেষণা ও উন্নয়নের ব্যয়েও বাংলাদেশ দুর্বল অবস্থানে।
বিশ্ব কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় এগিয়ে গেলেও বাংলাদেশের অবস্থা শোচনীয়। এআই–সম্পর্কিত প্রতিটি সূচকেই বাংলাদেশের অবস্থা বেশ খারাপ। বিশেষ করেএআইভিত্তিক বিনিয়োগ ও প্রতিভা খোঁজায়। এ ছাড়া তথ্যপ্রযুক্তির প্রভাবের ক্ষেত্রে তথ্যপ্রযুক্তি সেবা রপ্তানি, গিগ অর্থনীতির বিস্তারে বাংলাদেশ এখনো অনেক পিছিয়ে।
এনআরঅইয়ের প্রতিবেদনটি দেখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যপ্রযুক্তি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক বি এম মইনুল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, উচ্চশিক্ষায় গবেষণা ও উন্নয়নের জন্য যথেষ্ট ফান্ড নেই, এটা সবাই জানেন। কিন্তু উদ্যোগ নেই। আইসিটির সব সূচকেই এআইকে রাখা হচ্ছে। বাংলাদেশকে এখন সেদিকে মনোযোগ দিতে হবে।
দক্ষতা প্রসঙ্গে এই অধ্যাপক বলেন, প্রযুক্তি প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হয়। কিন্তু এখানে প্রশিক্ষণসংক্রান্ত যেসব উদ্যোগ নেওয়া হয়, সেগুলো সময়ের সঙ্গে যথার্থ কি না, তা পর্যালোচনার সময় এসেছে। দক্ষতা উন্নয়নবিষয়ক কোনো প্রকল্প পরিকল্পনার সময় সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা করতে হবে।