মো. নাসির হোসেন
মো. নাসির হোসেন

আন্দোলনকারীদের জন্য ঠান্ডা পানি নিয়ে গিয়েছিলেন নাসির, শেষ পর্যন্ত নিজেও বাঁচলেন না

আগের দিন মধ্যরাতে বাড়ি ফেরেন মো. নাসির হোসেন (৩৯)। পরদিন দেরিতে ঘুম ভাঙে। বেলা ১১টার দিকে ঘুম থেকে উঠে তাড়াহুড়া করে বাসা থেকে বেরিয়ে যান তিনি। নাশতা খাওয়ার জন্য পেছন থেকে মায়ের ডাকাডাকিও শোনেননি।

২০-২৫ মিনিটের মধ্যে বাসায় ফিরে এসে মায়ের দেওয়া দুটো আটার রুটি চিনি দিয়ে মাখিয়ে খান নাসির। পাঁচ লিটারের পানির পাত্রে ফ্রিজের ঠান্ডা পানি ভরে আবার বেরিয়ে যান। ঘণ্টাখানেক পরই পরিবারের সদস্যরা বাইরে লোকজনের চিৎকার শুনতে পান। তাঁরা বলছিলেন, ‘নাসির গুলি খাইছে।’

গত ২০ জুলাইয়ের ঘটনাটি এভাবেই বর্ণনা করছিলেন নাসিরের মা নাজমা বেগম ও ছোট ভাই জিলানী ইসলাম।

কোটা সংস্কারের দাবিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকা ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ বা সর্বাত্মক অবরোধ কর্মসূচি চলাকালে ২০ জুলাই রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর রায়েরাগ এলাকায় মাথায় ও মুখমণ্ডলে গুলিবিদ্ধ হন নাসির। গুরুতর আহত অবস্থায় তাঁকে ভর্তি করা হয় মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সেখানকার নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় গত ২৩ জুলাই সকাল সাড়ে সাতটায় মারা যান নাসির।

১৭ আগস্ট রায়েরবাগে নাসিরদের বাসায় কথা হয় পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে। তিনতলা ভবনের প্রবেশপথে নাসিরের প্রতি শোক জানিয়ে ব্যানার ঝুলে থাকতে দেখা যায়। ভবনের দোতলায় তিন কক্ষের একটি ফ্ল্যাটে তাঁর পরিবারের সদস্যরা থাকেন। নাসিরদের গ্রামের বাড়ি লক্ষ্মীপুরের রায়পুর উপজেলায়।

মো. রফিকুল ইসলাম ও নাজমা বেগমের চার ছেলে, পাঁচ মেয়ের মধ্যে সবার বড় ছিলেন নাসির। অবিবাহিত নাসির পেশায় দরজি ছিলেন। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে গত ১৯ জুলাই শরিক হন তিনি। পরদিনই গুলিবিদ্ধ হন।

মারা যাওয়ার আগের দিন আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আলোচনা শেষে দিবাগত রাত একটার দিকে বাসায় ফিরেছিলেন নাসির। স্বভাবে শান্ত নাসির যে আন্দোলন ঘিরে এতটা সক্রিয় হবেন, তা কখনো ভাবেননি পরিবারের সদস্যরা।

দুই ভ্রুর ওপরে দুই পাশে ও মাথার ডান পাশে গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন নাসির। গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর তাঁর মাথা দিয়ে অনেক রক্ত ঝরছিল।

নাসির হোসেনের শার্ট হাতে মা নাজমা বেগম

রক্তপাত ঠেকাতে কেউ একজন নাসিরের পরনের আকাশি রঙের শার্টটি খুলে তাঁর মাথায় পেঁচিয়ে দিয়েছিলেন। সেই শার্টটি ধুয়ে যত্ন করে রেখে দিয়েছেন তাঁর মা নাজমা বেগম।

এই প্রতিবেদককে শার্টটি দেখিয়ে নাজমা বেগম বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে বলেন, ‘নাসির নিজেই বানাইছে। ও নিজের শার্ট-প্যান্ট নিজেই বানাইতো। আমার নাসির কী সুন্দর কইরা যে থ্রি-পিস বানাইতো।’

নাসিরের ছোট ভাইবোনের মধ্যে সপ্তম জিলানী। তিনি বললেন, সেদিন বাসায় এসে আন্দোলনকারীদের জন্য ঠান্ডা পানি নিয়ে যাচ্ছিলেন ভাই। ‘পানি কোথায় নিয়ে যাস’—মা জানতে চাইলে ভাই বলেন, অনেক গরম। পুলিশের ধাওয়া খেতে খেতে আন্দোলনকারীরা অনেক ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। তাঁদের জন্য ঠান্ডা পানি নিয়ে যাচ্ছেন। এর আগের দিন এলাকায় রান্না করা খিচুড়ি নিয়ে আন্দোলনকারীদের দিয়ে এসেছিলেন ভাই।

কথার এক ফাঁকে জিলানী বলেন, ‘আপনার কাছে এখন মন খুলে সব বলছি। কিন্তু যখন আমার ভাই গুলি খেল, ভয়ে কারও সঙ্গে কথা বলতে পারিনি। হাসপাতালে, মর্গে, এমনকি কবরস্থানে গিয়েও হয়রানির শিকার হয়েছি। বাসার সামনে এই ব্যানার টাঙানোর সাহসও ছিল না। বাসায় কুলখানির আয়োজন করতে পারিনি। ভয়ে মসজিদ থেকে কোনো হুজুর আসতে রাজি হচ্ছিলেন না।’

কাকে এত ভয় ছিল—জানতে চাইলে জিলানী বলেন, ‘পুলিশ ও আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের ভয়।’ এমনকি এখনো তাঁদের ভয় পুরোপুরি কাটেনি বলে জানান তিনি।

গুলিবিদ্ধ হয়ে বাসার কাছে এসেছিলেন নাসির

ছোট ভাই জিলানী বাসার বাইরে এসে একটি দোকান দেখান। বলেন, গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর তাঁর ভাই বাসার কাছের এই দোকানের দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। সেদিন এই এলাকা ছিল যুদ্ধক্ষেত্রের মতো। ক্রমাগত গুলিবর্ষণ চলছিল। ছোড়া হচ্ছিল কাঁদানে গ্যাসের শেল। তাঁদের বাসার ছাদে তিনটি কাঁদানে গ্যাসের শেল এসে পড়েছিল। সবাই বাড়ির দরজা-জানালা সব বন্ধ করে রেখেছিলেন। এরপরও ঘরে টেকা যাচ্ছিল না। তাঁর মা ও বোনেরা ধোঁয়ায় কাবু হয়ে বমি করছিলেন।

ভাই গুলিবিদ্ধ হওয়ার কথা শুনে জিলানী দৌড়ে নিচে নামেন। দেখেন, তাঁর ভাই দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে। মাথায় শার্ট বাঁধা। কোথায় গুলি লেগেছে, জানতে চান জিলানী। নাসির বলেছিলেন, ‘মাথায়।’

এটাই ছিল নাসিরের সঙ্গে জিলানীর শেষ কথা। তিনি রিকশা করে নাসিরকে নিয়ে এসএমসি নামের স্থানীয় একটি ক্লিনিকে যান। তাঁকে বলা হয়, এত গুরুতর আহত ব্যক্তির চিকিৎসা সেখানে সম্ভব নয়।

হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বিনা মূল্যে একটি অ্যাম্বুলেন্স দেয়। এই অ্যাম্বুলেন্সে করে মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নাসিরকে নিয়ে যান জিলানী, আরেক ভাই আল আমিন ও ভগ্নিপতি মুরাদ হোসেন।

চিকিৎসা থেকে শুরু করে দাফন পর্যন্ত নানা হয়রানির শিকার হওয়ার অভিযোগ করেন জিলানী। তিনি বলেন, ‘এক লোককে চার হাজার টাকা দিয়ে আইসিইউতে সিট পাই। প্রতিদিন ১০-১২ হাজার টাকার ওষুধ বাইরে থেকে কিনতে হতো। প্রতিদিন ১০ পিসের ডায়াপারের প্যাকেট নিত হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। এ ছাড়া প্রত্যেক রোগীর স্বজনের কাছ থেকে রুম স্প্রে নেওয়া হতো।’

ক্ষোভ প্রকাশ করে জিলানী বলেন, ‘প্রত্যেক রোগীর স্বজনের কাছ থেকে দিনে এত পিসের ডায়াপার ও রুম স্প্রে কেন লাগত, সেটা নিয়ে আমার প্রশ্ন আছে। কিনে দেওয়া ওষুধপত্র রোগীর পেছনে ঠিকমতো ব্যবহার করা হয়েছিল কি না, তা নিয়েও আমার সন্দেহ রয়েছে।’

নাসির মারা যাওয়ার পর তাঁর মরদেহ ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। জিলানী বলেন, সেখানে আট হাজার টাকা দিয়ে তিনি দ্রুত লাশ নেওয়ার ব্যবস্থা করেন। মরদেহ নিয়ে বিকেল পাঁচটার দিকে রায়েরবাগের কবরস্থানে গিয়ে আরেকবার হয়রানির মধ্যে পড়েন। কবরস্থান কর্তৃপক্ষ জানায়, স্থানীয় এক আওয়ামী লীগ নেতার অনুমতি ছাড়া গুলিবিদ্ধ লাশ দাফন করা যাবে না। ওই ব্যক্তিকে ফোনে পেতে পেতে সন্ধ্যা হয়ে যায়। পরে সন্ধ্যা সাতটার দিকে তাঁরা লাশ দাফন করতে পারেন।

নাসিরদের বাসা থেকে চলে আসার সময় তাঁর মা নাজমা বেগম জোরের সঙ্গে একটা দাবি জানান। তাঁর একটাই দাবি, প্রচলিত আইনে ছেলে হত্যার বিচার যেন হয়।