ডান হাত কনুইয়ের ওপর থেকে কাটা। তারপরও ১৯ বছর বয়সী আতিকুল ইসলামের মুখে হাসি লেগেই আছে। বললেন, ‘এক হাত কেটে ফেলতে হয়েছে তো কী হয়েছে, আরেকটা হাত আছে। জীবনটাও আছে। অনেকে তো জীবনটাই হারিয়ে ফেলছেন। আর দেশের প্রয়োজনের সময় কিছু একটা করতে পারলাম, এইটাই তো অনেক।’
ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর সেদিন বিকেল চারটার দিকে রাজধানীর উত্তরা পূর্ব থানার কাছে আতিকুলের হাতে গুলি লাগে। সেদিন তাঁকে নিয়ে প্রথমে আন্দোলনকারীদের কয়েকজন এবং পরে স্বজনেরা পাঁচটি হাসপাতাল ঘোরেন। একটি হাসপাতালের চিকিৎসকেরা তাঁর হাতের গুলিটি বের করেন। ৬ আগস্ট দুপুরে জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে (পঙ্গু হাসপাতাল) তাঁকে ভর্তি করা হয়। আর ৭ আগস্ট অস্ত্রোপচার করে হাতটি কেটে ফেলতে হয়।
বাঁ হাতে মুঠোফোনে টাইপ করাসহ কিছু কাজ রপ্ত করেছেন আতিকুল ইসলাম। তবে দৈনন্দিন খাওয়া বা অন্য কাজগুলো করে দিচ্ছেন তাঁর মা আমেনা বেগম।
১৮ সেপ্টেম্বর হাসপাতাল থেকে ছাড়া পান আতিকুল। তিনি এক হাত নিয়ে হাসিমুখে পঙ্গু হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরেছেন। বাড়ি ফেরার আগে এদিন বেলা তিনটার দিকে হাসপাতালের নিচেই আতিকুলের সঙ্গে কথা হয়। তিনি হাসপাতালের ‘বি-ওয়ার্ড, বেড নং ৩৯’–এর রোগী ছিলেন। রোগীর স্বজনদের জন্য হাসপাতালের দেওয়া ‘অ্যাটেনডেন্ট পাস’ গলায় ঝুলিয়ে আতিকুল নিচে নেমেছিলেন। মা-বাবা বাড়ি চলে গেছেন ততক্ষণে। একটি সংগঠনের পক্ষ থেকে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ থাকায় হাসপাতাল থেকেই সেই অনুষ্ঠানে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন আতিকুল। সেই অনুষ্ঠানে যাওয়ার জন্য মুঠোফোনে আহত আরও কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলছিলেন।
এই প্রতিবেদককে সঙ্গে নিয়েই আতিকুল আবার হাসপাতালের বি-ওয়ার্ডে গেলেন। হাসিমুখে নিজের খালি বিছানা দেখিয়ে বললেন, তিনি এ বিছানাতেই ছিলেন। হাসপাতালের লিফট থেকে শুরু করে ওয়ার্ড পর্যন্ত যেতে আতিকুলের সঙ্গে অনেকেই কুশল বিনিময় করলেন। ওয়ার্ডে গিয়ে আন্দোলনে আহত যাঁরা সেখানে ভর্তি ছিলেন, তাঁদের কাছ থেকে বিদায় নিলেন। এক চিকিৎসক আতিকুলের সঙ্গে সেলফি তুলছিলেন। ওই চিকিৎসক বললেন, তিনি অন্য ওয়ার্ডের দায়িত্বে আছেন। আতিকুল বাড়ি যাচ্ছে শুনে দেখা করতে এসেছেন। আতিকুলকে তাঁর ওয়ার্ডের দায়িত্বরত নার্স, ওয়ার্ড বয়সহ অন্যরাও বিদায় জানালেন।
আতিকুল বললেন, তিনি হাসপাতালে ভর্তি অবস্থায় ঘুরে ঘুরে অন্য রোগীদের কাছে গেছেন, কষ্টের কথা শুনেছেন। এতে এই কয় দিনে অনেকেই স্বজনের মতো হয়ে গেছেন।
নবম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছেন আতিকুল। উত্তরার আজমপুরে রাজলক্ষ্মী কমপ্লেক্সে একটি দোকানে বিক্রয়কর্মী হিসেবে কাজ করতেন। বেতন পেতেন ৯ হাজার ৫০০ টাকা। তবে কাজটি আপাতত আর করা হবে না তাঁর।
আতিকুল বলেন, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সময় মার্কেট বন্ধ ছিল। তাই শুরু থেকেই আন্দোলনে অংশ নিচ্ছিলেন। ৫ আগস্টের আগেও তাঁর শরীরে ছররা গুলি লেগেছিল। ৫ আগস্টের কথা উল্লেখ করে আতিকুল বলেন, সকাল থেকেই আন্দোলনে ছিলেন। দুপুরের দিকে ততক্ষণে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে শেখ হাসিনা চলে গেছেন। আর কেউ গুলি করবে না, এমন খবর সবাই জেনে গেছেন। তবে গোলাগুলি থামেনি। আতিকুলের চোখের সামনেই একজনের গুলি লাগে, সেখানেই ওই ব্যক্তি মারা যান। পরে আরও একজনের গুলি লাগে, আতিকুল তাঁর দিকে এগিয়ে যাওয়ার সময় নিজে গুলিবিদ্ধ হন। বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতাল ঘুরে জাতীয় হৃদ্রোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে ভর্তি হন আতিকুল।
আতিকুল বলেন, ‘প্রথমে বেসরকারি একটি হাসপাতালে গুলি বের করার পর ১৮ ঘণ্টা পার হলেও আমার কোনো চিকিৎসাই হয়নি। ততক্ষণে হাতের অবস্থা খুব খারাপ হয়ে যায়। হৃদ্রোগ ইনস্টিটিউটের অস্ত্রোপচারকক্ষে নেওয়ার পর চিকিৎসকেরা জানান, হাত কাটা ছাড়া গতি নেই। তাঁরাই পঙ্গু হাসপাতালে যেতে বলেন। পরে পঙ্গু হাসপাতালে ভর্তি হলে চিকিৎসকেরা হাত কেটে ফেলতে বাধ্য হন।’
আতিকুল বললেন, ‘প্রথমে বেসরকারি একটি হাসপাতালে গুলি বের করার পর ১৮ ঘণ্টা পার হলেও আমার কোনো চিকিৎসাই হয়নি। ততক্ষণে হাতের অবস্থা খুব খারাপ হয়ে যায়। হৃদ্রোগ ইনস্টিটিউটের অস্ত্রোপচারকক্ষে নেওয়ার পর চিকিৎসকেরা জানান, হাত কাটা ছাড়া গতি নেই। তারাই পঙ্গু হাসপাতালে যেতে বলেন। পরে পঙ্গু হাসপাতালে ভর্তি হলে চিকিৎসকেরা হাত কেটে ফেলতে বাধ্য হন।’
আতিকুল জানান, প্রথম দু–তিন দিন হাতের জন্য তাঁর খারাপ লাগত। পরে নিজেকে শক্ত করার চেষ্টা করেন। ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করেন। আতিকুল বলেন, ‘এখন ভুলে থাকতে পারি। হয়তো মরব, নয়তো বিজয় নিয়ে ঘরে ফিরব—এ উদ্দেশ্য নিয়েই আন্দোলন করছি। আমি কিন্তু মারা যাই নাই। এক হাত দিয়ে হলেও স্বাধীনতা আনতে পারছি।’
বাঁ হাতে মুঠোফোনে টাইপ করাসহ কিছু কাজ রপ্ত করেছেন আতিকুল। তবে দৈনন্দিন খাওয়া বা অন্য কাজগুলো করে দিচ্ছেন তাঁর মা আমেনা বেগম।
আতিকুলের তিন বোনের বিয়ে হয়েছে। দুই ভাই বিয়ে করে আলাদা থাকেন। আতিকুল তাঁর মা ও বাবাকে নিয়ে আজমপুরে থাকেন। বাবা আলাল উদ্দিন ভাড়া করা দোকানে পুরোনো আসবাব বিক্রির ব্যবসা করেন। আতিকুল আর তাঁর বাবার আয়ে সংসারটা ভালোই চলছিল। আতিকুল নিজের খরচ এবং সংসারে সহায়তা করতেন। এখন একজনের আয় বন্ধ হয়ে গেল।
আতিকুল ইতালি যেতে চেয়েছিলেন। এর জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্রও ঠিকঠাক করছিলেন। ফটোগ্রাফি করা শখ ছিল। বললেন, ‘এখন তো আর আমি স্বাভাবিক মানুষ নেই। সোসাইটি ভিন্ন হয়ে গেছে। আমার চিন্তাভাবনাও চেঞ্জ করতে হবে।’
পঙ্গু হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার আগেই চিকিৎসার পেছনে প্রায় ২৫ হাজার টাকা খরচ হয়েছে বলে জানালেন আতিকুল। তবে পঙ্গু হাসপাতালে চিকিৎসায় কোনো টাকা লাগেনি, সরকারিভাবে চিকিৎসা হয়েছে। হাসপাতাল থেকে দেওয়া খাবার খেতে পারতেন না বলে খাবারের পেছনে খরচ করতে হয়েছে। হাসপাতালের চিকিৎসক ও নার্সদের কাছ থেকে খুব ভালো ব্যবহার পেয়েছেন বলেও জানালেন তিনি।
বিভিন্ন সংস্থা এবং সংগঠনের পক্ষ থেকে এ পর্যন্ত প্রায় দুই লাখ টাকা সহায়তা পেয়েছেন আতিকুল। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নিহত ব্যক্তিদের স্বজন ও আহত ব্যক্তিদের সহায়তার জন্য গঠিত ‘জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন’-এ ১০০ কোটি টাকা অনুদান দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। এ ফাউন্ডেশন থেকে আন্দোলনে আহত ব্যক্তিরা সর্বোচ্চ এক লাখ টাকা করে পাবেন—এ কথাও শুনেছেন আতিকুল। এ ছাড়া কৃত্রিম হাত লাগানোর বিষয়ে বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের সঙ্গে আতিকুলের কথা হয়েছে।
ভবিষ্যৎ দিনগুলো কীভাবে কাটবে, জানতে চাইলে আতিকুল হাসিমুখেই বললেন, ‘চিন্তা করে লাভ নেই। আমার এক হাত নেই, এটা মেনে নিতে হবে। আগে যা যা স্বপ্ন দেখতাম, তা তো এখন আর সম্ভব নয়। চিন্তা ও স্বপ্নে পরিবর্তন আনতে হবে। আর যে হাত কাটা গেছে, তার তো কোনো আর্থিক ক্ষতিপূরণ হয় না, কোটি টাকা দিলেও হাত ফিরে পাব না।’